parbattanews

রাখাইন রাজ্যে নতুন করে চলছে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ

উখিয়া প্রতিনিধি:

বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের বিবৃতি, উদ্বেগ, নিন্দা ও জাতি সংঘের অবরোধের হুমকিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মগ ও উগ্র বৌদ্ধদের সহায়তায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরা আরো নতুন  মাত্রা হত্যাযজ্ঞে মিশন শুরু করেছে। জাতিগত মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে নেমেছে তারা। বহুমাত্রিক প্রতিহিংসা আগুনে জ্বলে পুড়ে ছারকার হয়ে গেছে রাখাইনের মুসলিম প্রদেশ। প্রতিদিন গ্রামের পর গ্রাম আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে সেনা সদস্যরা। যুবক দেখলেই গুলি করে হত্যা চালায়। যুবতি মেয়েদেরকে ধর্ষনের পর মেরে ফেলা হচ্ছে এমন পৈশাশিক করুন বর্ণনা দিচ্ছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।

উখিয়ার বালুখালী নতুন বস্তিতে আশ্রয় নেওয়া রহিম বকসু (৭২) জানান, কয়েকদিন ধরে রাখাইন প্রদেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরা নির্যাতন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষন ও লুটপাট বাড়িয়ে দিয়েছে। টেকনাফের শাপলাপুর উপকূল দিয়ে আসা রোহিঙ্গা দিল মোহাম্মদ (৬২) বলেন, মিয়ানমারের সেনারা এখন যুবতীদেরকে ধর্ষণ ও যুবকদেরকে গুলি করে হত্যার ঘটনা মনে পড়লে পৃথিবী থেকে চলে যেতে ইচ্ছা করে।

নতুন করে আসা মুসলিম রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা মংডু, আকিয়াব, বুচিদংয়ের কিছুটা নিরাপদ গ্রামগুলোতে থাকতেন। পরিবেশ পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আশায় প্রথম দিকে আসেননি। নেহায়েত শেষ পর্যন্ত  তারা আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এদের বেশিরভাগই দলে দলে বিভাজন হয়ে আসছেন। একটি পাড়া কিংবা গ্রামের লোকজন দল বেধে একটু একটু এদিকে অগ্রসর বা লক্ষ উদ্দেশ্যে পৌঁছেছেন। তবে এদের মধ্যে হতাহত অথবা সহায় সম্পদ হারানো রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা কম বলা যাবে না। তারা আসলে পাশের এলাকা গুলোতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বরর্বরতা হত্যাযজ্ঞ দেখে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসছেন।

রাচিদং জেলার উনচিপ্রা গ্রামের এক জায়গা থেকে এক দলে এসেছেন ২২০ জন রোহিঙ্গা। তাদের একজন মোহাম্মদ আলী (৬৫)। গতকাল রোববার এ প্রতিবেদকে তিনি উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে বলেছেন, তারা ২২টি পরিবার এক হয়ে বাংলাদেশে আসতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। যদি হামলা থেমে যায় তা হলে না আসারই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ও তাদের দোসরদের হামলা নিপড়নে চলে আসতে বাধ্য হন। খাবার সামগ্রী, স্বর্ণলংকার ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে গত ৮ সেপ্টেম্বর রাতেই তারা দল বেঁধে রওয়ানা দেয়।

দিনের বেলা সুযোগ বুঝে অল্প অল্প করে বাংলাদেশের দিকে রওয়ানা হয়েছেন। রাতে কখনো পাহাড়ের আড়ালে ঝোঁপজঙ্গলে ভোর হলে আবার যাত্রা শুরু। এভাবে টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপে পৌঁছেন। বুচিদং কোনার পাড়া থেকে আসা আমেনা খাতুন (৬০) জানান, তারা ১০ সেপ্টেম্বর ১০০ জনের একটি দল নিয়ে রওয়ানা হন। ৩ দিন পথ অতিক্রম করার পর কিছু রাখাইন তাদের জানায় কিছুই হবে না, ভয় না করতে। ঘর বাড়িতে ফিরে যেতে। ওই দিন রাতে তারা আবার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। কিছু দূর যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের আরেকটি পালিয়ে আসা লোকজনের সাথে দেখা হয়। তারা জানায়, খানকার পাড়ার পাশে গোজাদিয়ায় ওই দিন আগুন দেওয়া হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে তারা পুণরায় বাংলাদেশে দিকে আসতে শুরু করেন।

এদিকে বুচিদংয়ে ওয়াল পাড়া থেকে আরেকটি দলের সাথে এসেছেন হোছেন আহমদ (৭০)। বাড়ীতে তার ৭ একর জমি ছিল। বড় একটি দোকানও ছিল। ভিটেমাটি সহায় সম্পদ রেখে যখন পরিবার নিয়ে তারা বাংলাদেশে আসছিলেন তখন তারা প্রাণ হারার ভয়ে ছিলেন। সেই ভয় যে অমুলুক ছিল না তা দেখলেন ২দিন পর। সীমান্তের কাছের একটি এলাকায় আসার পর সেনা সৈন্যরা তাদের ঘিরে ধরে। আবার কিছু সৈন্য তাদের চলে আসার সুযোগ দিতেও বলে। এ সময় এইতো হাঁটা শুরু করলে পেছন থেকে ৩ জনের গায়ে গুলি লাগে। ১ জন সেখানে মারা যায় বাকী ২ জন কে অনেক কষ্টের সাথে করে নিয়ে আসেন তারা। গতকাল রোববার শাহপরীর দ্বীপ হয়ে কুতুপালংয়ে আসা অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থীর ক্যাম্পে দেখা হয়েছে যারা ৫/৬ দিন সময় নিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে ঢুকেছেন।

সকাল ৭ টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ১৮ হাজারেরও বেশী রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেখেছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। এদের বেশী ভাগই বুচিংদয়ের, উকিল পাড়া, কোনার পাড়া, শীলখালী, ধমখালী, ধামনখালী, মংডু সদর, উত্তর মংডু, কুয়াজিবন, শাহাদবাজার, কোনকারপাড়া, গোজাদিয়া ও রাচিডংয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সারাদিনে ২২/২৫ হাজার হবে। এছাড়াও উখিয়ার আমতলী, বালুখালী, নাইক্ষ্যংছড়ির, আজুহাইয়া, জলপাইতলী, তুমব্রু, ঘুমধুম ও কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের শাপলাপুরের হয়েও বেশ কিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার খবর পাওয়া গেছে।

রোহিঙ্গারা বলছেন, দীর্ঘ পথ হেঁটে আসতে গিয়ে তারা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেউ কেউ পিছিয়ে পড়েন। বাকীরা তাদের অনেক কষ্টে এগিয়ে এসেছেন। তারা বলছেন, মিয়ানমার সেনা, পুলিশ এখনো সেখানে নৈরাজ্য চালাচ্ছে। কখনো তাদের বাড়ী গিয়ে চলে যেতে হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। আবার কখনো বাড়ী ঘর ছাড়তে নিষেধ ও করছেন। মিয়ানমারের উপর আর্ন্তজাতিক চাপের কারণেই মিয়ানমার সৈন্যরা এমন করছে বলে দাবী করেন কেউ কেউ। তবে বাড়ী ঘর খালি ফেলে সাথে সাথে আগুণ দিয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছেন বলে জানান তারা।

Exit mobile version