parbattanews

রাঙামাটিতে অপহরণ: মামলা হয়নি, তথ্য নেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে: চার মাসেও উদ্ধার হননি ৫২ অপহূত

পার্থ শঙ্কর সাহা :

রাঙামাটিতে অপহূত সেই ৫২ জন এখনো উদ্ধার হননি। চার মাস ধরে তাঁদের পরিবার-পরিজন উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু এতগুলো মানুষকে উদ্ধারের ব্যাপারে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে কোনো তাগাদা নেই। এমনকি এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলাও হয়নি।
দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এতসংখ্যক মানুষকে অপহরণ এবং দীর্ঘদিন ধরে আটকে রাখার ঘটনা এই প্রথম। অথচ এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো তথ্য নেই বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব সি কিউ কে মুসতাক আহমেদ।
আর পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা বলেছেন, ‘অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারের বিষয়ে আমাদের কোনো কর্তৃত্ব নেই। এটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। তার পরও এ ব্যাপারে আমরা খবর নিচ্ছি। পুলিশও তৎপর আছে।’
গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠান শেষে ইঞ্জিননৌকায় ফেরার পথে লংগদু উপজেলার কাট্টলীর জোড়টিলা থেকে জেএসএসের ৬২ জন কর্মী ও সমর্থক অপহূত হন। কয়েক দিন পর নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ ১০ জনকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। বাকি ৫২ জনের মধ্যে ২৬ জন রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, ২৫ লংগদু ও একজন বরকল উপজেলার বাসিন্দা বলে পিসিজেএসএস জানিয়েছে।
অপহরণের এ ঘটনার জন্য পিসিজেএসএস দায়ী করছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টকে (ইউপিডিএফ)। অবশ্য ইউপিডিএফ এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
এ ঘটনায় পুলিশ বা পরিবারগুলোর পক্ষ থেকে কেউ কোনো মামলাও করেননি। মামলা করলে অপহূত ব্যক্তিদের হত্যা করা হবে—এমন হুমকি থাকায় মামলা করেননি বলে একাধিক পরিবারের সদস্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। এমনকি পিসিজেএসএসও দলের এসব কর্মী-সমর্থককে উদ্ধারে সরকারের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। চার মাসেও অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারের দাবিতে কোনো কর্মসূচিও দেয়নি দলটি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দিয়ে অনেকটা দায়িত্ব শেষ করেছে তারা।
জানতে চাইলে পিসিজেএসএসের সাংগঠনিক সম্পাদক শক্তিপদ ত্রিপুরা বলেন, ‘অপহরণের পর থেকে প্রশাসনকে আমরা বারবার জানিয়ে আসছি। এর চেয়ে আমরা আর কী করতে পারি?’ অপহূত ব্যক্তিদের পরিবারগুলোকে দলের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য করা হয়েছে কি না, এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কোত্থেকে করব? আমাদের সেই সামর্থ্য নেই।’
এদিকে এ ঘটনাকে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা’ বলে মন্তব্য করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ শাহ আলম। তিনি বলেন, এ জন্য গত মাসে পার্বত্য তিন জেলার পুলিশ সুপার ও পুলিশের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপমহাপরিদর্শককে (ডিআইজি) সংসদীয় কমিটির সভায় ডাকা হয়েছিল।
ডিআইজি মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটুকু বলতে পারি, আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে পার্বত্য অঞ্চলের পরিস্থিতি অন্যান্য অঞ্চলের মতো নয়। যেসব দুর্গম জায়গায় অপহূত ব্যক্তিদের রাখা হয়েছে, সেখানে পুলিশও সহজে যেতে পারে না।’
স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, পার্বত্য অঞ্চলের বিবদমান দুটি রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বের কারণে এই অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। তাই স্থানীয়ভাবেই উদ্ধারের চেষ্টা করছে পুলিশ।
লংগদু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল হক বলেন, অপহরণের পর পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী কয়েকটি অভিযান চালিয়েছিল। কিন্তু কোনো ফল পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, অভিযানগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর স্থানীয় লোকজনই সমঝোতার মাধ্যমে অপহূত ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগী হন। এরপর পুলিশ এ নিয়ে আর তৎপরতা চালায়নি।
অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারে স্থানীয়ভাবে যাঁরা চেষ্টা করেছেন, তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান দীপ্তিমান চাকমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারে ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলার প্রধান সমন্বয়ক প্রদীপন খীসার সঙ্গে একাধিকবার দেখা করেন। সে সময় প্রদীপন অপহূত ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য তাঁদের কয়েকটি দাবি জানান। এসব দাবি পিসিজেএসসের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমাকে জানাতে বলেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের পদ থেকে সন্তু লারমার পদত্যাগ, ইউপিডিএফ ও পিসিজেএসএসের মধ্যে সংঘাত বন্ধ করে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা।
দীপ্তিমান চাকমা জানান, তাঁরা গত ২১ ফেব্রুয়ারি সন্তু লারমার সঙ্গে দেখা করে অপহরণকারীদের এসব দাবি জানান। কিন্তু সন্তু লারমা এসব দাবি অগ্রাহ্য করেন। আর অপহরণকারীরাও তাদের দাবিতে অনড় রয়েছে। তিনি জানান, অপহূত ব্যক্তিরা এখনো সুস্থ আছেন বলে জানতে পেরেছেন। তাঁদের থাকা-খাওয়ার খরচ বাবদ জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা ধরে দুই লাখ ৬০ হাজার টাকা ইতিমধ্যে অপহরণকারীদের দেওয়া হয়েছে।
তবে ইউপিডিএফের নেতা প্রদীপন খীসা অপহূত ব্যক্তিদের উদ্ধারে সমঝোতাকারী কারও সঙ্গে সাক্ষাতের কথা অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, ‘অপহরণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আমাদের ওপর রাজনৈতিক চাপ দেওয়ার জন্যই পিসিজেএসএস অপহরণের রটনা রটিয়েছে।’
প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে জন্ম নেওয়া ইউপিডিএফ শুরু থেকেই পিসিজেএসএসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। দুই দলের বিরোধিতা সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নেয়। গত কয়েক বছরে প্রতিপক্ষের আক্রমণের মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়া ইউপিডিএফ এ অপরহণের ঘটনার পর আবার আলোচনায় এসেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ান মনে করেন, অপহরণের এ ঘটনায় সরকার, পিসিজেএসএস বা ইউপিডিএফ কেউ দায়িত্বশীল আচরণ করেনি। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে সরকার।

সৌজন্যে : দৈনিক প্রথম আলো

Exit mobile version