parbattanews

রাঙামাটিতে উন্মেষ নির্ভরতার একটি প্রতীক

দীপেন চাকমা

দীপেন চাকমা:

২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। আমার বড় ভাই হঠাৎ প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলেন। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে তাঁকে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা জানালেন, তাঁর টাইফয়েড আর ম্যালেরিয়া দুটোই হয়েছে। বাঁচাতে হলে রক্তের প্রয়োজন। লাগবে পাঁচ ব্যাগ। রক্তের জন্য শুরু হলো দুশ্চিন্তা। রক্ত না পেলে ভাই আমার মারা যাবে। বাবা-মা আর স্বজনেরা রক্তের জন্য এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন। বলাবলি করছেন, কীভাবে পাওয়া যাবে পাঁচ ব্যাগ রক্ত। অনেক দৌড়াদৌড়ি করে পাওয়া গেল মাত্র দুই ব্যাগ রক্ত। আর পাওয়া যাচ্ছে না দেখে এগিয়ে এলেন এক নার্স। মিলল আরও এক ব্যাগ। পাঁচ ব্যাগের জায়গায় দেওয়া হলো তিন ব্যাগ। রক্ত পর্যাপ্ত না হলেও ভাই বেঁচে গেলেন। বেঁচে গেল একটি পরিবার।

এই ঘটনায় আমার অপরিপক্ব ও কৌতূহলী মনজুড়ে তখন নানা প্রশ্নের আনাগোনা। মানুষের শরীরে তাহলে রক্তের প্রয়োজন এতটাই তীব্র? ভাইকে যাঁরা রক্ত দিলেন, কই, তাঁদের তো কোনো অসুবিধা হলো না? তাহলে মানুষকে বাঁচাতে মানুষ কেন রক্ত দেয় না?

যখন একটু বড় হলাম। বরকল উপজেলার দুর্গম অজপাড়া গাঁ থেকে এসে ষষ্ঠ শ্রেণিতে রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। মানুষের শরীরে রক্তের প্রয়োজনের চিন্তাটা তখনো আমার মাথা থেকে সরে যায়নি। যতই ওপরের শ্রেণিতে উঠছি, ততই ধীরে ধীরে বুঝতে শিখছি, কেন রক্তের প্রয়োজন এত বেশি।

দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন টেলিভিশনে একটি ঘটনা দেখলাম। তিন তরুণ ক্যানসারে আক্রান্ত এক শিশুর জন্য টাকা সংগ্রহ করছে। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, বাবা কেন গ্রামের অসহায় মানুষদের সাহায্য করেন। আমার নিজের মনেও কীভাবে যেন চিন্তার একটি স্ফুরণ ঘটল।

২০১০ সাল। আমার এক বন্ধুকে একদিন বললাম, ‘চলো, আমরা একটা সংগঠন করি। আমরা এমন একটা উদ্যোগ নিই যাতে রক্তের অভাবে অসহায় কোনো রোগীকে মরতে না হয়। রক্ত দিলে তো মানুষের কোনো ক্ষতি হয় না।’

বন্ধুটি বিস্মিত হয়ে উত্তর দিল, ‘বলো কী? ভাত খেতে পাই না ঠিকমতো, মানুষকে রক্ত দেব?’ বন্ধুটির এ উত্তরে আমি হতাশ হইনি। পরে আরও কয়েকজন বন্ধুকে ভালোভাবে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললে তারা রাজি হয়ে যায়।

২০১২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বন্ধু শিশির চাকমা ও পরম চাকমাসহ আমরা ছয়জন মিলে ‘উন্মেষ’ নাম দিয়ে সংগঠনের কাজ শুরু করি। সবাই মিলে সংগঠনের মূল থিম ঠিক করি, ‘সদা সর্বদা সর্বত্র মানবসেবায়’। আমাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল, স্বেচ্ছায় রক্ত দিতে মানুষকে সচেতন করে তোলা।

সে বছরই মাধ্যমিক পাস করে আমি কুমিল্লা মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছি। বন্ধুরাও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে সব সময়ই যোগাযোগ রইল।

প্রথমে আমরা নিজেরা রক্ত দিতে শুরু করলাম। এরপর আমরা প্রত্যেকে একজন-দুজন করে রক্তদাতা সদস্য সংগ্রহ করতে থাকি। প্রথম প্রথম অনেকে রক্ত দিতে ভয় পেতেন। কিন্তু কারও কোনো আত্মীয়ের রক্তের প্রয়োজন হলেই আমরা নিজেরা গিয়ে বিনা মূল্যে রক্ত দিয়ে আসতে শুরু করি। আমাদের উদ্যোগ দেখে এসব রোগীর তরুণ ও যুবক আত্মীয়রা অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের সংগঠনে যোগ দিয়ে নিজেরাও রক্ত দিতে শুরু করলেন। ২০১২ সালে ছয়জন সদস্য নিয়ে শুরু করা উন্মেষে এখন নিয়মিত সদস্য প্রায় ৪০০ জন। এঁদের ৯৫ শতাংশ তরুণ।

রক্তদাতার সংখ্যা বাড়াতে আমরা একটি কাজ করেছিলাম। আমরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস, মেলা, বৌদ্ধধর্মের পরব কঠিন চীবরদান অনুষ্ঠান, তথ্য অধিকার দিবস, বাণিজ্য মেলা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে যেতে আরম্ভ করলাম। সেখানে গিয়ে বিভিন্ন মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করার পাশাপাশি তাঁদের রক্তদান করতে উৎসাহিত করতে লাগলাম। যাঁদের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছি, তাঁদের নাম-ঠিকানার একটি তালিকাও তৈরি করতে লাগলাম, যাতে প্রয়োজনীয় কোনো গ্রুপের রক্তের দরকার হলে আমরা খবর দিতে পারি।

এ বছর আমি আমার মেডিকেল ডিপ্লোমা শেষ করেছি। রাঙামাটিতে কাজ করছি একটি বেসরকারি সংস্থায়। কিন্তু এর পাশাপাশি উন্মেষের কার্যক্রমও আরও জোরদার করার চেষ্টা করে চলেছি। আনন্দের ব্যাপার হলো, সবার মিলিত চেষ্টায় রাঙামাটিতে উন্মেষ নির্ভরতার একটি প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাঙামাটির প্রায় সব চিকিৎসক ও চিকিৎসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে উন্মেষ একনামে পরিচিত। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ধনী-গরিব নির্বিশেষে যেকোনো রোগীর তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে এগিয়ে আসে উন্মেষের সদস্যরা।

শুধু পার্বত্য চট্টগ্রাম নয়, দেশের বিভিন্ন স্থান, বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকেও রক্তের জন্য উন্মেষের সদস্যদের কাছে অনুরোধ আসে। দেশের বিভিন্ন জেলায় আমাদের সংগঠনের সদস্য আছেন। আমাদের প্রত্যেক সদস্যের কাছে সবার রক্তের গ্রুপ ও মুঠোফোন নম্বর আছে। কেউ কারও রক্তের প্রয়োজনের কথা জানলেই তালিকা দেখে অন্য বন্ধুদের খবর দিয়ে দেন। জরুরি প্রয়োজনে সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট ফেসবুকে কোথায় কোন রোগীর কোন গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন, তা জানানো হয়।

এ পর্যন্ত আমরা ২ হাজার ৭২০ জন মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছি। বিভিন্ন বয়সী রোগীকে বিনা মূল্যে রক্ত দেওয়া হয়েছে দুই হাজার ব্যাগের বেশি। এ পর্যন্ত আমরা ২ হাজার ৭২০ জন মানুষের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছি। আমাদের এখানে আগে লোকজন রক্ত দিতে ভয় পেত। এখন প্রয়োজন দেখা দিলে কে কার আগে রক্ত দেবে তার জন্য আমাদের সদস্যদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। উন্মেষের সদস্যরা সর্বস্তরের মানুষের কাছ থেকে অপরিসীম ভালোবাসা পেয়েছেন। এ অঞ্চলের সবার কাছে তাঁরা পরিচিতি পেয়েছেন ‘রক্তযোদ্ধা’ হিসেবে।

এখন কখনো কখনো রক্তপ্রার্থীর সংখ্যা এমন বেড়ে যায় যে উন্মেষের সাত-আটজন সদস্যকে একসঙ্গে রক্ত দিতে হয়। দূর থেকে আসা রোগীদের কাছ থেকে আমার গাড়িভাড়া বা খাওয়ার টাকাও নিই না। উন্মেষের ফান্ড থেকেই সেসব খরচ মেটাই। এখানে বলে রাখা ভালো, উন্মেষ কিন্তু সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সদস্যদের চাঁদার টাকাতেই সব কার্যক্রম চলে। ফলে সাধ আর সাধ্য সব সময় মেলে না। মাঝেমধ্যেই আমাদের অর্থসংকটে পড়তে হয়।

এখন প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো তরুণ ছাত্র আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। বাড়ছে আমাদের কাজেরও পরিধি। আমাদের সদস্যরা এখন মানুষকে রক্ত দিতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আরও বহু কিছু করেন। মাদকের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার কাজেও তাঁরা যুক্ত হয়েছেন।

আমি প্রথম আলো রাঙামাটি বন্ধুসভার সদস্যও। আমার বন্ধুসভার সদস্য হওয়ার পেছনে কাহিনিটি বলে লেখা শেষ করব। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বরকল উপজেলার সদর ইউনিয়নের দেওয়ানচর গ্রামের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী সুমনা চাকমা অগ্নিদগ্ধ হয়। তার শরীরের প্রায় ৪০ ভাগ পুড়ে যায়। রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তির পর চিকিৎসকেরা সুমনাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু গরিব মা-বাবার পক্ষে তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। তাই প্রায় এক সপ্তাহ ধরে শুধু সাধারণ চিকিৎসা দিয়ে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে রাখা হয়।

একপর্যায়ে চিকিৎসকেরা জানান, তার শরীরে পচন ধরেছে। আমরা হাসপাতালে গিয়ে সুমনাকে দেখি। কিন্তু আমরা তো অসহায়। কে আমাদের টাকা দেবে? কিছু বন্ধুর সূত্রে আমরা জানতে পাই, প্রথম আলোর বন্ধুসভা রাঙামাটিতে সবার কাছে পরিচিত। অসহায় মানুষদের তারা নানাভাবে সাহায্য করে। বন্ধুসভার কয়েকজন সদস্য আমার বন্ধু। তাঁদের বলার চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে সুমনাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। তারপর বন্ধুসভা ও উন্মেষের সদস্যরা যৌথভাবে সুমনার জন্য অর্থ সংগ্রহ ও চিকিৎসাসেবা শুরু করি। পরে আরও নানা মানুষের সহযোগিতায় তিন মাসের চিকিৎসায় সুমনা সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। এই ঘটনার পর আমি নিজে প্রথম আলো বন্ধুসভার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হই। এই সূত্রে আরও বহু রোগীকে নানাভাবে আমরা সহযোগিতা করার সুযোগ পেয়েছি।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র নিশান চাকমা ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। তাঁর উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রথম আলো বন্ধুসভা ও উন্মেষ বর্তমানে যৌথভাবে অর্থ সংগ্রহ করছে। আমাদের উদ্যোগ দেখে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও নিশান চাকমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসছে। মানবিক সেবার মানসিকতা যদি তরুণ ও যুবকদের মধ্যে আরও ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে আরও বেশি বেশি ভালো কাজের উদাহরণ সৃষ্টি হবে।

তারপরও আমরা মনে করি, এখনো আমাদের বহু কাজ করার আছে। তবে এ বিশ্বাসও আমাদের আছে, সবাই মিলে চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আমরা আমাদের কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব।

দীপেন চাকমা: স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাতা সংগঠন ‘উন্মেষ’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাঙামাটি

সূত্র: প্রথমআলো।

Exit mobile version