রাজনৈতিক ধর্মান্তরকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের কি উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার আছে

fec-image

একটি নির্দিষ্ট ধর্ম বেছে নেওয়া বা অনুসরণ করা মানবাধিকারের অংশ। যাইহোক, কোনো পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মানুষকে কোনো বিশেষ ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য বাধ্য করা, ফাঁদে ফেলা  বা গোপন আন্দোলন সম্পূর্ণ অনৈতিক বা বেআইনি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ব্রিটিশ রাজের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, উপমহাদেশে তাদের দিন ফুরিয়ে আসছে। এছাড়া, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি উপমহাদেশের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনকে বিলম্বিত করতে যথেষ্ট ছিল না।

যাইহোক, ব্রিটিশরা ভারত মহাসাগরের পাশাপাশি এই উপমহাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। তারা উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বে একটি ‘ক্রাউন কলোনি‘ তৈরি করার পরিকল্পনা করেছিল, যেখানে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে উপমহাদেশের স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশদের প্রভাব থাকবে। উত্তর-পূর্বের পিছিয়ে পড়া ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতির মানুষের তুলনায় হিন্দু ও ইসলামের মত প্রধান ধর্ম থেকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তর করা কঠিন। এ কথা মাথায় রেখেই ২০ শতকের গোড়ার দিকে একটি বড় মিশনারির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল।

আজ ভারতের নাগাল্যান্ডের জনসংখ্যার ৮৮%, মিজোরামের ৮৭%, মেঘালয়ের ৭৫% এবং মণিপুরের ৪২% খ্রিস্টান। একইভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্তবর্তী মায়ানমারের চিন রাজ্যে এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ৮৬% খ্রিস্টান জনসংখ্যা। পার্বত্য চট্টগ্রামে (ভারতের মিজোরাম এবং মায়ানমারের চিন রাজ্যের সীমান্তবর্তী) খ্রিস্টান মিশনারি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর খুব সক্রিয় হয়ে ওঠে, আজ সেখানে ১০ হাজারেরও বেশি পরিবার খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কিছু ছোট উপজাতির প্রায় সবাই খ্রিস্টানে ধর্মান্তরিত হয়েছে।

শুধু মিশনারিই নয়, কিছু আন্তর্জাতিক এনজিও (আইএনজিও) এবং আইএনজিও দ্বারা সমর্থিত জাতীয় এনজিও ও এই উদ্যোগের  সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত। গবেষণায় দেখা যাবে, যদিও বাঙালি মুসলিম জনসংখ্যা পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০%, কিন্তু এনজিও এবং আইএনজিও-এর বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়ের তহবিলে যা আসে তা শতকরা হারে খুবই সামান্য।

এমন ধর্মপ্রচারের মধ্যে, আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এই বিষয়ে আলোচনা করতে বা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে শুনি না বরং প্রায়শই শোনা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলামিকরণ চলছে। কয়েক বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন (বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা) বাঙালিদের (যারা বেশিরভাগই মুসলমান) স্থানান্তরিত করার জন্য একটি ফর্মুলা নিয়ে এসেছিল। ইউএনডিপি পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকটি প্যাকেজের প্রস্তাবও দিয়েছে। তাতে এটিও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রয়োজনে গুচ্ছগ্রামে বাঙালিদের রেশন দেওয়া বন্ধ করা উচিত। এখন পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রিস্টানধর্ম সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ধর্ম।

আমি এখানে দুটি উদাহরণ উদ্ধৃত করতে চাই; ১৯ শতকের শেষের দিকে এবং ২০ শতকের প্রথম দিকে খ্রিস্টান মিশনারিরা সুদানের দক্ষিণ অংশে প্রবেশ করে। ২০১১ সালে এটি বেশিরভাগ সম্পদসহ একটি খ্রিস্টান দেশে পরিণত হয়। একটি স্বাধীন খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হওয়ার জন্য পূর্ব তিমুরের প্রায় ৭০ বছর লেগেছে।

এখন প্রশ্ন হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম কি একই পরিকল্পনার অংশ, নাকি এটি কাকতালীয় বা উন্নয়নের সুফল? আমি কোন সতর্ক সংকেত দিচ্ছি না, কিন্তু বিশ্বের এই অংশে বিরাজমান ঘোলা জল সম্পর্কে তাদের নিজস্ব উপলব্ধি বিকাশের জন্য পাঠকদের উল্লেখিত বিষয়গুলো ভেবে দেখার অনুরোধ করব। এটি করার জন্য দু‘টি বই সুপারিশ করছি, সুবীরভৌমিক-এর ‘দ্য ট্রাবলড পেরিফেরি’ এবং রবার্ট ডি. কাপলানের ‘মনসুন‘’।

বিশ্বের এই অংশে মানচিত্র পুণরায় আঁকা ঠেকাতে বাংলাদেশকে অবশ্যই ভারতকে পাশে নিতে হবে। কারণ সুদান এবং ইন্দোনেশিয়াকে চ্যালেঞ্জ করা সহজ ছিল, কিন্তু ভারতকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভবত অসম্ভব। আমার মতে, এ ধরণের ভূ-কৌশলগত ধর্মান্তরকরণ ভবিষ্যতে চিন্তার কারণ হয়ে ওঠার আগেই বাংলাদেশের উচিত একে রাজনৈতিক ধর্মান্তরকরণ হিসেবে বিবেচনা করা। সুতরাং সমস্যাটি মোকাবেলায় বাংলাদেশের উচিত বিষয়টি আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় মায়ানমার (তাদের সাথে নানান সমস্যা থাকা সত্ত্বেও) এবং ভারতকে পাশে রাখা।

♦ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ড. মো. মাহফুজুর রহমান: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। সাবেক প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন