parbattanews

রাজাকারের তালিকা দেখে ক্ষুদ্ধ ও হতাশ পার্বত্য চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা

ঘোষিত তালিকায় স্থান পেয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই কুখ্যাত রাজাকারের নাম- ত্রিদিব রায় ও অং শৈ প্রু চৌধুরী

৪৯তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত রাজাকারের তালিকা অনুসন্ধান করে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬ জন রাজাকারের নাম খুঁজে পাওয়া গেছে (আরো থাকতে পারে)।

এরমধ্যে কুখ্যাত রাজাকার ও তৎকালীন চাকমা সার্কেল চিফ ত্রিদিব রায়ের নাম এসেছে বেশ কয়েকবার। প্রত্যেকবারই তার নাম দেশের কুখ্যাত রাজাকারদের সাথে তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৫তম বোমাং সার্কেল চিফ অং শৈ প্র্রু চৌধুরীর নাম রয়েছে শীর্ষস্থানীয় রাজাকারদের তালিকায়।

বান্দরবান থেকে আরো দুইজনের নাম রয়েছে এ তালিকায়। একজন হলেন, নাজির আহাম্মেদ, অন্যজন অনু মা মাজিনি(Anu Ma Majini)।

খাগড়াছড়ি থেকে একজনের নাম রয়েছে এ তালিকায়। তিনি হলেন, এ. মান্নান।

রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি থেকে একজনের নাম এসেছে। তিনি হলেন, ইপিসিএএফ শৈলেশ্বর চাকমা। তবে এবারে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা ভিত্তিক রাজাকারের তালিকা প্রকাশিত হয়নি।

জানা গেছে, বোমাং রাজা অং শৈ প্র চৌধুরী ১৯১৪ সালের পহেলা আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি বোমাং রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন। ২০১২ সালের ৮ আগস্ট তিনি ৯৮ বছর বয়সে নিজ বাড়ি বান্দরবানের মধ্যমপাড়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘ ১৪ বছর বোমাং রাজার দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি পাকিস্তান সরকারের খাদ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

অপরদিকে, রাজা ত্রিদিব রায় ১৯৩৩ সালের ১৪ মে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালের ২ মে তিনি রাজা হিসাবে অভিষিক্ত হন। পাকিস্তানের ইসলামাবাদ শহরে ২০১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ৭৯ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।দীর্ঘ ১৮ বছর চাকমা রাজার দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বর্তমান চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ত্রিদিব রায়ের সন্তান।

চাকমা রাজা হিসেবে ত্রিদিব রায় তার প্রভাবাধীন হেডম্যান-কারবারীদের ব্যবহার করে চাকমা যুবকদের দলে দলে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করেন। তাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দিয়ে লেলিয়ে দেন মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতাকামী জনতার বিরুদ্ধে। এসময় ত্রিদিব রায় এবং তার রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী একাধিক গণহত্যা পরিচালনা করে। এতে নির্মমভাবে শহীদ হন অনেক মুক্তিযোদ্ধা।

কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে ত্রিদিব রায় ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। বাংলাদেশ এবং বাঙালি বিদ্বেষী মনোভাব ও কার্যক্রমের পুরস্কার স্বরূপ ‘পাকিস্তানের জাতীয় বীর’ খেতাব পান এবং আজীবন মন্ত্রিত্ব ভোগ করে তিনি সেখানেই মারা গেছেন।

রাজা ত্রিদিব রায় সম্পর্কিত বিভিন্ন দলিল ও গবেষণা পত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের নভেম্বরে ত্রিদিব রায় পাকিস্তানী সৈন্যদের সহায়তায় মায়ানমার হয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার পর পাকিস্তান সরকার তাকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষ দূত হিসেবে ওই বছরই ব্যাংকক প্রেরণ করে।

শুধু মুক্তিযুদ্ধ নয়, স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন ত্রিদিব রায়। জাতিসংঘের ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত জেনারেল এসেম্বলীতে বাংলাদেশের সদস্য পদ প্রদানের প্রসঙ্গ আসলে পাকিস্তান সরকার-এর বিরোধিতা করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং করার জন্য ত্রিদিব রায়কে প্রধান করে এক প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন। বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী ত্রিদিব রায়ের লবিংয়ের কারণে চীন ভেটো প্রয়োগ করে, ফলে সেবার বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

পাকিস্তানের পক্ষে তার এই সফলতায় মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তার মন্ত্রিসভা জাতিসংঘ ফেরত ত্রিদিব রায়কে ‘জাতীয় বীর’ খেতাব দিয়ে লাল গালিচা সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি শুধু ১৯৭২ সালের জাতিসংঘের মিশনে বাংলাদেশ বিরোধী ভূমিকা পালন করেই ত্রিদিব রায় ক্ষান্ত হননি।

বরং তিনি ধারাবাহিকভাবে পাকিস্তানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে, প্রবন্ধ লিখে, বই লিখে বাংলাদেশ বিরোধী অপপ্রচারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। যার পুরস্কার স্বরূপ ত্রিদিব রায় পাকিস্তানে আজীবন মন্ত্রিত্বের পদমর্যদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন।

তাকে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ফেডারেল মন্ত্রী, ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত পর্যটন ও সংখ্যালঘু বিষয়ক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, ১৯৮১ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ আমেরিকার ৫টি দেশের রাষ্ট্রদূত করে আর্জেন্টিনায় প্রেরণ, ১৯৯৫ সালের মে মাস থেকে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় ‘এ্যাম্বাসেডর এ্যাট লার্জ’ হিসেবে নিয়োগ, ২ এপ্রিল ২০০৩ থেকে পাকিস্তানের দপ্তর বিহীন ফেডারেল মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাঙামাটি জেলার কমান্ডার রবার্ট রোনাল্ড পিন্টু আক্ষেপের সাথে পার্বত্যনিউজকে বলেন, রাঙামাটির তৎকালীন ডিসি সৌরেন্দ্র নাথ চক্রবর্তীকে আমরা রাঙামাটি জেলা থেকে একটি রাজাকারের তালিকা দিয়েছিলাম। কিন্তু সে তালিকা অনুযায়ী রাজাকারের নাম প্রকাশ পায়নি। আর রাজাকার রাজা ত্রিদিব রায়কে দেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যালে মরোণোত্তর বিচার দাবি করছি।

এ কমান্ডারর আরো বলেন, রাঙামাটির অনেক জায়গায় এখনো এই যুদ্ধাপরাধীর নামে স্থাপনা রয়েছে। সেসব স্থাপনাগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে সরিয়ে নিতে প্রশাসনের কাছে তিনি জোর দাবি জানান। আর যেসব রাজাকারের নাম প্রকাশ পায়নি সেগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রকাশ করার দাবি জানান সরকারের কাছে।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা রণবিক্রম কিশোর ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে বলেন, এই তালিকা আমাদের হতাশ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অজস্র রাজাকার ছিলো। রাজাকারদের দৌরাত্মে আমাদের যুদ্ধ পরিচালনা করতেই কষ্ট হতো।

ঘোষিত তালিকায় কুখ্যাত দুই রাজাকারের নাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ত্রিদিব রায় তো শুধু রাজাকার নয়, রাজাকারদের সংগঠক ছিলো আর অং শৈ প্রু চৌধুরী যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সরকারের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এসব রাজাকারদের ঘৃণা করা উচিত বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।

বান্দরবান জেলা সদরের বাসিন্দা ও সদর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল ওহাব পার্বত্যনিউজকে বলেন, বান্দরবান জেলায় তৎকালীন গেজেটে ২৫ জন তালিকাভুক্ত রাজাকার রয়েছে। প্রথম ধাপে প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের রাজাকারের তালিকায় তাদের মধ্যে শুধু রাজা অং শৈ প্রু চৌধুরীর নাম প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদের নামও ধাপে ধাপে প্রকাশিত হবে।

জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে রাজাকারের তালিকার কপি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে। তালিকায় বান্দরবানের উচ্চপদস্থ দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অনেকের আত্মীয়-স্বজনের নামও রয়েছে। আমরা চাই, দেশবাসীর স্বার্থে সব রাজাকারের নাম ঘোষণা করা হোক। অন্যথায় শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা শান্তি পাবে না।

Exit mobile version