parbattanews

রোহিঙ্গাদের কাজের সুযোগ করে দিতে বাংলাদেশকে পশ্চিমাদের চাপ

একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবিক সংকট বাংলাদেশের রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা গোষ্ঠী বহু দিন ধরে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন ও সহিংসতার মুখোমুখি হয়ে আসছে, যার ফলে তারা বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে এক মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় চেয়েছে, যা দেশের সম্পদ এবং অবকাঠামোর ওপর একটি বিশাল চাপ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের জন্য বোঝা এসকল রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়ে সংকট নিরসন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে চাপ বাড়ানোর পরিবর্তে তাদের নিপীড়নে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান করে দিতে বাংলাদেশের ওপর উল্টো চাপ বাড়াচ্ছে ।

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরের মতো আবারও রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও বহুগুণ বাড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোকে তাগিদ দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিকল্প কিছু নেই। যারা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে বলছে, তাদের প্রত্যাবাসনে মনোযোগী করাটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের বেসামরিক, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল উজরা জেয়া জাতিসংঘের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এসময় উজরা জেয়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবিকা নিশ্চিত করতে তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর জোর দেন। যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো শুরু করার আগে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

এর বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা উচিত, অন্যথায় এই অঞ্চল নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। কারণ রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে; যার মধ্যে রয়েছে হত্যা, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান এবং মাদক ব্যবসা।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনের ফাঁকে এদিনই বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সদর দফতরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ‘তারা কি আমাদের ভুলে গেছে?’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক ইভেন্ট আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী সেখানেও বলেন, একদিকে রোহিঙ্গাদের জন্য আর্থিক সহায়তা কমছে, অন্যদিকে তাদের প্রত্যাবাসনে ধীরগতিতে বাংলাদেশ উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানান তিনি।

রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে চারটি প্রস্তাব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে উদ্ভূত এই (রোহিঙ্গা) সমস্যার স্থায়ী সমাধান নিশ্চিত করতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরও বহুগুণ বাড়াতে হবে, সব বিকল্পের মধ্যে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনই সবচেয়ে কার্যকর।’

যদিও পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বারবারই দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিয়ে আসছে। এমনকি নাগরিকত্ব দেওয়ারও চাপ দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে বলে জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গত ১৬ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার পরিবর্তে বাংলাদেশের ওপর দায় চাপাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো চায় বাংলাদেশ যেন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাতে বলছে তারা।’

এরআগে, ১৩ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন কংগ্রেসম্যান এড কেইস ও রিচার্ড ম্যাককর্মিকও এমন বার্তা দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যানরা এমন পরামর্শ দেন যখন বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে বারবার আহ্বান জানাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামেও বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরব ভূমিকা রাখছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের কাজকর্ম দিয়ে তাদের নিজেদের মতো করে নেওয়ার (অ্যাবজর্ব) পরামর্শ দেন মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যান। সেসময় কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে বৈঠক শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে রোহিঙ্গা নিয়ে কথা হয়েছে। তারা (কংগ্রেসম্যান) বলেছে, এই জনগোষ্ঠীর কাজকর্ম তো কিছুই নেই। আপনারা তাদের কাজকর্ম দেন, তাদের অ্যাবজর্ব করে নেন।’

‘কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলন’-এর সভাপতি আয়াছুর রহমান বলেন, ‘তারা নির্যাতিত হয়ে এখানে এসেছেন এটা ঠিক। কিন্তু তাদের সামনে রেখে এদের ভেতর থেকেই এখানে বহু অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী, চোরাকারবারি ও মাদক ব্যবসায়ী সৃষ্টি হয়েছে। অনেক সময় তাদের ধরাও কঠিন। তাদের মধ্যে কারা এসব করছে। আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা তখন আরও জোরেশোরে চালাবে। স্থানীয় বাংলাদেশিদের তারা উৎখাত করে দেবে। এখনইতো তারা হুমকি দিচ্ছে নানাভাবে। সংখ্যায় তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর চেয়েও দ্বিগুণ। তাদের কাজের সুযোগ করে দেওয়া হবে আত্মঘাতী।’

দেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পশ্চিমা দেশগুলোর এই আহ্বান নিরাপত্তার জন্য হুমকি কিনা প্রশ্নে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আব্দুর রশীদ বলেন, ‘বরাবরই তারা (পশ্চিমারা) বলতে চায় রোহিঙ্গাদের যেন বাংলাদেশ অ্যাবজর্ব করে নেয়। এই পরিকল্পনা সামনে এলে প্রত্যাবাসনের প্রশ্ন হারিয়ে যাবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শুরু থেকেই বলছেন তাদের বাস্তুভিটায় নিরাপদে প্রত্যাবাসন করতে হবে। বাংলাদেশের ভাবনা এ দেশের মানুষ ভাববে, এটা মনে রাখতে হবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রত্যাবাসন চান। বাংলাদেশের মানুষের তাতে সম্মতি আছে। বাংলাদেশ মানবতার স্বার্থে জায়গা দিয়েছে মানেই তাদের বাংলাদেশের নাগরিক করে নিতে হবে, সেই সুযোগ নেই। আমাদের কর্মসংস্থানের যে অবস্থা, এখানে নিজেদের জনগণেরই কাজের ব্যবস্থা করতে সরকার হিমশিম খায়।’

আবার রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থান করলেই সমাধান হবে বলেও মনে করেন না এই বিশ্লেষক। তিনি বলেন, ‘তাদের এদেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারার বিষয় আছে। এখন তাদের জনসংখ্যা স্থানীয়দের থেকে বেশি। সেটা নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। সেখানে পশ্চিমা বিশ্বের এই প্রেসক্রিপশন আমাদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না।’

Exit mobile version