আন্দামান সাগরে ভাসমান

রোহিঙ্গাদের যে কারণে বাংলাদেশেই ফেরত পাঠাতে চায় ভারত

fec-image

আন্দামান সাগরে ভাসমান একটি নৌকা থেকে ৮১ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে উদ্ধার করার পর ভারত সরকার এখন তাদের আবার বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চাইছে।

ভারত বলছে, যেহেতু এই রোহিঙ্গারা কক্সবাজার থেকে সমুদ্রে ভেসেছিলেন এবং তাদের অধিকাংশের কাছেই বাংলাদেশে ইউএনএইচসিআরের জারি করা শরণার্থী কার্ড আছে, তাই তাদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে সেদেশের সরকারের সঙ্গে কথাবার্তা বলা হচ্ছে।

তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ভারতের এই প্রচেষ্টার সমালোচনা করে বলছে, শুধু উদ্ধার করেই ভারতের দায়িত্ব শেষ হতে পারে না, আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা অনুযায়ী এই রোহিঙ্গাদের আপাতত আশ্রয় ও সুরক্ষার ব্যবস্থাও ভারতকেই করতে হবে।

গত ১১ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের একটি বেশ বড় দল, ৬৪জন নারী ও ২৬জন পুরুষকে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ভেসেছিল এই নৌকাটি।

পরবর্তী কয়েকদিনে অনাহারে ও দুর্যোগে নৌকার আটজন আরোহী মারা যান, নিখোঁজ হন আরও একজন।

গত সপ্তাহে অবশেষে আন্দামান সাগরের কাছে ভারতীয় কোস্টগার্ডের দুটি জাহাজ গিয়ে বাদবাকি ৮১ জন রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে, তাদের কাছে খাবারদাবার, রসদ, ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়া হয়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব দিনতিনেক আগে বিবিসির এক প্রশ্নের জবাবে এই উদ্ধার অভিযানের খবর জানান।

সেই সঙ্গেই তিনি বলেন, “নৌকার আরোহীদের মধ্যে অন্তত ৪৭ জনের কাছে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বা ইউএনএইচসিআরের জারি করা পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে।”

“ওই পরিচয়পত্রে বলা হয়েছে তারা মিয়ানমারের আশ্রয়চ্যুত নাগরিক এবং ইউএনএইচসিআরে নথিভুক্ত।”

“তাদের কীভাবে এখন নিরাপদে ফেরত পাঠানো যায়, সে বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছি,” বলেন তিনি।

ফলে ভারত যে এই ৮১ জন রোহিঙ্গাকে তাদের মাটিতে আশ্রয় দিতে চাইছে না সেটা স্পষ্ট।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক কর্মকর্তা মীনাক্ষী গাঙ্গুলি কিন্তু বলছেন, এরা মিয়ানমারের নাগরিক হলেও আপাতত ভারতেরই দায়িত্ব তাদের সুরক্ষা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা।

মিস গাঙ্গুলি বলেন, “রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে প্রধান দায়িত্ব অবশ্যই মিয়ানমারের। তবে তার পরের দায়িত্ব হল বাকি সেই সব দেশের যেখানে তারা শরণার্থী হয়ে আসছে কিংবা যাদের জুরিসডিকশনে প্রবেশ করছে।”

“এক্ষেত্রে ভারতের জলসীমার মধ্যে এই নৌকাটিকে যে উপকূলরক্ষীরা উদ্ধার করেছে এবং তাদের রসদপত্র সব দিয়েছে, সেটা খুবই ভাল কথা।”

“কিন্তু এর পরের দায়িত্ব হল জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআরকে অ্যাকসেস দেওয়া, যাতে তারা এই রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে যাচাই করতে পারে ঠিক কী ঘটেছে, কিংবা কোনটা সত্যি বা সত্যি নয়!”

“এখন ভারত এদেরকে আবার বাংলাদেশেই ফেরত পাঠাতে চায় – কিন্তু বাংলাদেশ তো বলছে এমনিতেই আমরা লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছি, এর মধ্যে যারা চলে গেছে তাদেরকে কেন আবার নতুন করে নেব?”

“সুতরাং এই পরিস্থিতিতে ভারতেরই প্রাথমিক দায়িত্ব হল আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা মেনে এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া, প্রোটেকশন দেওয়া”, বলছিলেন মীনাক্ষী গাঙ্গুলি।

দিল্লি ভিত্তিক ‘রোহিঙ্গা হিউম্যান রাইটস অর্গানাইজেশনে’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আলি জোহর আবার যুক্তি দিচ্ছেন, পাঠাতে হলে এদের মিয়ানমারেই পাঠানো উচিত – কিন্তু সেটা যতদিন না সম্ভব হচ্ছে ততদিন ভারত কিন্তু তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারে না।

আলি জোহর বিবিসিকে বলছিলেন, “এরা তো কেউ বাংলাদেশি নন। এরা সবাই হলেন প্রকৃতপক্ষে মিয়ানমারের নাগরিক এবং রোহিঙ্গা।”

“ফলে ভারতের উচিত মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে সেখানে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেওয়া।”

“তবে ইন্টারন্যাশনাল বার্ডেইন শেয়ারিং-এর শর্তও কিন্তু বলে মিয়ানমারে যতদিন না এদের পাঠানো সম্ভব হচ্ছে ততদিন এদের আশ্রয় দেওয়ার দায়িত্ব ভারতের ওপরই বর্তায়।”

“আর ভারত কিন্তু জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বা ইউএনএইচসিআরের নির্বাহী কমিটিতে আছে সেই ১৯৯৫ সাল থেকে।”

“যদিও তারা ‘৫১ সালের শরণার্থী সনদে সই করেনি, তারপরও নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও তাদের কিছু দায়বদ্ধতা থেকে যায়।”

“একটা জিনিস বুঝতে হবে, এই অসহায় মানুষগুলো বাংলাদেশে থাকার চেয়েও সমুদ্রে ভেসে পড়াকে বেশি নিরাপদ মনে করেছে। সেই জন্যই কিন্তু তারা এতো বড় ঝুঁকিটা নিতে প্রস্তুত হয়েছে।”

“সেই বিষয়টা বিবেচনা করে, মানবিক দিক থেকে জিনিসটা দেখে আমি বলব ভারতের উচিত এই মানুষগুলোকে আশ্রয় দেওয়া”, বলছিলেন আলি জোহর।

এই বিতর্কের মধ্যে কিন্তু ওই ৮১জন রোহিঙ্গা এই মুহুর্তে কোথায়, কীভাবে আছেন তা একেবারেই স্পষ্ট নয়।

আলি জোহর ও তার সংগঠন শেষবারের মতো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন ঠিক সাতদিন আগে, গত সোমবার (২২শে ফেব্রুয়ারি)।

কিন্তু এখন তাদের ওই নৌকাতেই রেখে রসদপত্র জোগানো হচ্ছে না কি ভারতীয় কোস্টগার্ড তাদের নিকটবর্তী উপকূল বা ডাঙায় নিয়ে এসেছে, সে ব্যাপারে দিল্লি একেবারেই মুখ খুলছে না।

সূত্র: বিবিসি

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন