রোহিঙ্গাদের রক্তের দাগ ঢাকতে বিনিয়োগের চুনকাম

ডেস্ক রিপোর্ট:

ঐতিহাসিক মন্দির। বালুময় সৈকত। মাছ ধরার সুযোগ আর বিস্তীর্ণ কৃষি জমি। গত সপ্তাহে সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সামনে সঙ্ঘাত-পীড়িত রাখাইন রাজ্যকে এভাবেই তুলে ধরলো সরকার। থান্দুয়ে শহরে আয়োজিত রাখাইন স্টেট ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ারে উপস্থিত জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদেরকে এভাবেই প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করে সরকার। থান্দুয়েকে বলা হয় রাখাইন রাজ্যের অনাবিষ্কৃত বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় অঞ্চল।

সম্ভাব্য এই বিনিয়োগকারীরা যেটা মোটেই শোনেনি, সেটা হলো এখানকার জাতিগত সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের কথা। অথবা ২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইন জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বর্বর নিধনযজ্ঞে নিহত হাজার হাজার মানুষ এবং বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া ৭২০,০০০ মানুষের কথাও শোনেনি তারা।

এই বাদ দেয়াটা কোন ভুলবশত হয়নি। মিয়ানমারের ডিরেক্টরেট অব ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড কোম্পানি অ্যাডমিনিস্ট্রেশানের ডিরেক্টর জেনারেল অং নাইং ও’র মতে, রাখাইনে সরকারের ব্যর্থতার বিষয়গুলো উল্লেখের প্রয়োজন নেই, কারণ ‘বিনিয়োগের বিষয়টি রাজনৈতিক কোন বিষয় নয়’।

নিজেদের স্বার্থে সরকার যে প্রচারণাটা চালাচ্ছে, সেটা যেমন অশুভ, তেমন অসৎও বটে। এবং এখান থেকেই রাখাইন স্টেট ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ারের ব্যাপারে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝা যায়। সেটা হলো সেখানে সঙ্ঘটিত ভয়ঙ্কর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো ব্যবসার চাদরে ঢাকা দেয়া।

মিয়ানমার সরকারের চিন্তা হলো তারা যদি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস গণহত্যা এবং বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পের মানবিক সঙ্কটের ব্যাপারে একটা লম্বা সময় বধির সেজে থাকতে পারে, এবং রাখাইনের তেল ও গ্যাস, কৃষি, এবং মৎস শিকারের খাতগুলোতে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, তাহলে অপরাধের দায় দায়িত্ব থেকে বেরিয়ে আসা যাবে।

বাস্তবেও সেটাই দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমার একদিকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য রাখাইনে লাল গালিচা বিছিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে যে সব আন্তর্জাতিক সংগঠন রাখাইনে সঙ্ঘটিত হত্যাযজ্ঞের তদন্ত করতে চায়, তাদেরকে সে এলাকায় ঢুকতেই দেয়া হচ্ছে না। আরও দেখার বিষয় হলো, সরকার মিয়ানমারের জন্য নিযুক্ত জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি ইয়াঙ্ঘি লি-কেও নিষিদ্ধ করেছে, মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির অবস্থা যাচাইয়ের জন্য যাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

২০১৭ সালে, সরকার লি-এর নেতৃত্বাধীন তথ্য-অনুসন্ধানী মিশনের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই বছরের ডিসেম্বরে সরকার জানায় তারা লি-কে মিয়ানমারে বা রাখাইন রাজ্যে প্রবেশের অনুমতি দেবে না।

রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে এবং বাংলাদেশে এখন তারা যে দুঃসহ পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, সেই সত্যটা ঢাকার জন্যেই রাখাইন স্টেট ইনভেস্টমেন্ট ফেয়ারের আয়োজন করেছে মিয়ানমার সরকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এই হত্যাযজ্ঞের বিচার নিশ্চিত করার যে দাবি জানানো হচ্ছে, সেটা ঢাকার জন্যই বাণিজ্য সম্ভাবনার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।

বিভিন্ন দেশের সরকার এবং বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরও মিয়ানমার সরকারের এই সত্য ঢাকার অপচেষ্টাকে বাতিল করে দেয়া উচিত এবং এটা স্পষ্ট করে বলা উচিত যে স্বাভাবিক কূটনীতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক নির্ভর করবে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং রাখাইনে দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার উপর, সেটা চাপা দেয়ার মাধ্যমে নয়।

সূত্র: সাউথ এশিয়ান মনিটর

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন