parbattanews

রোহিঙ্গাদের ৩ শ’ বাড়ি জ্বালিয়ে দিলো মিয়ানমার সেনারা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

 
আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেই মিয়ানমারের সেনারা আরাকানে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের পাশাপাশি তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয়া অব্যাহত রেখেছে। গত শনিবার একই দিনেই মংডু এলাকায় রোহিঙ্গাদের ৩ শ’ বাড়িঘর, দোকানপাট, ধর্মীয় স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে দিয়েছে সেনারা। এ সময় মংডুর ৩ নম্বর ওয়ার্ডের দু’টি গ্রাম সুন্দরী পাড়া ও মরিয়ংয়ে বসতবাড়ির সাথে দু’টি মসজিদও পুড়ে যায়। এ দিকে গতকাল ও আগের দিন শনিবার দুপুরে আরাকান থেকে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে সাঁতরে নাফ নদী পার হয়ে এসেছেন আটজন রোহিঙ্গা। তারা আরাকানের বুচিডং এলাকার বাসিন্দা।
 
সূত্র জানিয়েছে, শনিবার দুপুরে মরিয়ং গ্রামে অর্ধশতাধিক সৈন্য গিয়ে রোহিঙ্গাদের ধাওয়া করে। পরে পেট্রল ঢেলে জ্বালিয়ে দেয় দেড় শতাধিক বসতবাড়ি। এ সময় একটি মসজিদও পুড়ে যায়। দূর থেকে গোপনে রোহিঙ্গাদের ধারণ করা একটি ভিডিওচিত্রে গ্রামগুলো জ্বলতে দেখা গেছে। এ সময় ধোঁয়া চার দিকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। সুন্দরী পাড়ায় রাতে অগ্নিসংযোগ করে সেনা সদস্যরা। ওই গ্রামের শতাধিক বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে। গ্রামগুলোর রোহিঙ্গারা পালিয়ে পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কে নো প্রাণহানির খবর পাওয়া যায়নি।
 
রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সে দেশের সেনাবাহিনী ও মগদের অত্যাচার নির্যাতন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সেনা ও মগদের কড়া পাহারায় রোহিঙ্গারা বাড়িঘর থেকে বের হতে ও বাজারে যেতে পারছেন না। ফলে তীব্র খাদ্য সঙ্কটে পড়েছেন তারা। অনন্যোপায় হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে নাফের পাড়ে এসে অসহায় জীবন যাপন করতে হচ্ছে তাদের। বাংলাদেশে আসতে কোনো বাহন না পাওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাঁতার কেটে নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে আসছেন অনেক রোহিঙ্গা যুবক। তারা জানিয়েছেন, নাফনদীর পাড়ে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা দুই মাস ধরে তাঁবু টাঙ্গিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছেন।
 
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের হারিয়াখালী সৈকত পয়েন্ট দিয়ে প্রতিদিনই শত শত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করছেন। রাতে নৌকায় সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন তারা। অনুপ্রবেশ রোধে বিজিবি ও কোস্টগার্ড নাফনদীতে পাহারা জোরদার করলেও অনুপ্রবেশ থামছেনা। বিজিবি অনুপ্রবেশকারীদের আটক করে সাবরাং সেনা ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিচ্ছে। সেখানে তাদের নাম নিবন্ধন করে উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখন যারা অনুপ্রবেশ করছেন তারা জানিয়েছে, রাখাইনে রোহিঙ্গারা তীব্র খাদ্য সঙ্কট ভুগছেন। অনেকে পাহাড়ে জঙ্গলে ধান ক্ষেতে লুকিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে কোনো রকম বেঁচে আছেন।
 
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাঁতরে নদী পাড়ি দেয়ার কারণ জানতে চাইলে সাঁতরে আসা রোহিঙ্গা যুবকেরা বলেন, সেনা ও মগদের নানা নির্যাতন আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এতদিন যারা আসেননি তাদের ওপরও নির্যাতন চলছে। উপরন্তু কাগজপত্র এবং ডকুমেন্টগুলো কেড়ে নিচ্ছে। বাংলাদেশে এসে মা-বাবা ভাইবোন এবং আত্মীয়স্বজনদের আনার কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কিনা সে চেষ্টা করতেই ঝুঁকি নিয়ে চলে এসেছি। যারা সেনা নির্যাতনের মুখে রয়ে গেছে তাদের বাঙালি হিসেবে অভিবাসী কার্ড ‘এনভিসি’ নিতে জোর খাটাচ্ছে সেনা প্রশাসন। পরে সেসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক-টুইটারে এবং রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
 
সম্প্র্রতি মিয়ানমারের গণমাধ্যম ‘মিজিমা’ দু’টি ছবি প্রচার করে, যাতে এনভিসি হাতে ধরে ছবি তুলেছে রোহিঙ্গারা। হাতে এনভিসি থাকলেও রোহিঙ্গাদের অবয়ব বলে দিচ্ছে তারা স্বেচ্ছায় এনভিসি নেননি। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে, কাজ করছেন এমন অবস্থা থেকে ধরে এনে এনভিসি নিতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের। এনভিসি নিতে অস্বীকার করলে তাদের মারধর করা হচ্ছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে ছবি তুলে এনভিসি ধরিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন। এভাবে এনভিসি দেয়ার অর্থ রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা।
 
অন্য দিকে বুচিডং এলাকার ইয়াংশং ইউনিয়নের পেরুল্লা এলাকায় রাখানদেন হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন দুই রোহিঙ্গা। গত শুক্রবার রাতে এ হামলা। সূত্র জানিয়েছে, সিন্দিপ্রাং গ্রামের চার রোহিঙ্গা কৃষক পেরুল্লা এলাকায় পাহাড়ি খামারবাড়িতে মহিষের পাল পাহারা দিতে যান। রাতে দুইজন জেগে এবং ২জন ঘুমিয়ে পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছিলেন। রাত ১২টার দিকে একদল রাখাইন মহিষ লুট করতে তাদের ওপর হামলা করে। এ সময় জেগে থাকা দুই রোহিঙ্গা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ঘুমন্ত দুইজনকে বেধড়ক পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর আহত করে লুটেরা রাখাইনরা। পরে তাদের অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে মহিষ নিয়ে চলে যায়। রাতেই গ্রাম থেকে লোকজন গিয়ে গুরুতর আহত দুইজনকে উদ্ধার করে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
 
 
মিয়ানমারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না : পররাষ্ট্র সচিব
 
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
 
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমারের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন, আমরা মিয়ানমারের কাছ থেকে এর চেয়ে ভালো প্রতিক্রিয়া আশা করেছিলাম। আমরা যেভাবে আলোচনা শুরু করেছিলাম, এ মুহূর্তে তা সন্তোষজনক বলা যাচ্ছে না।
 
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ইউএন উইমেন আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এটি নিয়ে কাজ চলছে। ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।
 
চলতি মাসে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি’র দফতরের ইউনিয়নমন্ত্রী টিন্ট সোয়ে ঢাকা সফরকালে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের সিদ্বান্ত হয়। পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান নেপিডো সফরে গিয়ে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এই গ্রুপ গঠনের তাগাদা দেন।
 
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনের শর্টকাট কোনো পথ নেই উল্লেখ করে শহীদুল হক বলেন, আমাদের দেশের কোনো মানুষ বিদেশে আটকা পড়লে তার নাগরিকত্ব আমরাও যাচাই-বাছাইয়ের কথা বলি। আন্তর্জাতিক নিয়মগুলো সেভাবেই তৈরি করা আছে। তাই সবাইকে (রোহিঙ্গা) একসাথে ধরে পাঠিয়ে দেয়ার অবকাশ নেই।
 
রোহিঙ্গা সমস্যাটি দীর্ঘায়িত হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দীর্ঘায়িত শব্দটি আপেকি। আগে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঘটনা ঘটার অনেকদিন পরে শুরু হতো। এবার দেড় মাসের মধ্যে আলোচনা শুরু করতে পেরেছি। এটি ভালো লণ। এটি কতটুকু গতিশীলতা পাবে তা দেখার বিষয়। কিন্তু গতি আরো বাড়ানোর জন্য যে বহুপাকি চাপ রাখার কথা সেটি আমরা বজায় রেখেছি।
 
আন্তর্জাতিক চাপ বন্ধ হলে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাপ বন্ধ হলে কী হবে সে বিষয়ে জল্পনা-কল্পনা করাটা ঠিক হবে না। আর বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও দেখছি না। এই অবস্থায় যে ধরনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন তা সরকারের প থেকে নেয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যেতে হবে। তাই মিয়ানমারের সাথে আলোচনা করার কোনো বিকল্প নেই।
 
জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের সম্ভাব্য রেজুলেশন সম্পর্কে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, আগে দেখা যাক নিরাপত্তা পরিষদে কে কী অবস্থান নেয়। তারপর এ বিষয়ে কথা বলা যাবে। সব দেশ মিলে একটি শক্ত পদক্ষেপ নেবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
 
নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন-১৩২৫ এর ওপর ইউএন উইমেন আয়োজিত আলোচনা সম্পর্কে তিনি বলেন, এর অধীনে আমরা নারীদের মতায়ন বিষয়েজাতীয় কর্মপরিকল্পনা তৈরি করছি। এটা মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। 
 
এর আগে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক গোলটেবিল বৈঠকে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, মিয়ানমারের কোনো আশ্বাসে বাংলাদেশ আর আস্থা রাখতে পারছে না, আলোচনায় লাভ হচ্ছে না এসব কথা জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়কে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তাদের জানিয়েছি, কফি আনান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নে গড়িমসি করছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের সাথে দ্বিপীয় আলোচনায় কী ফল আসবে তা নিশ্চিত নই। তাদের সাথে আলোচনার ফলাফলে আমরা আস্থা রাখি না। এরপরও আমরা বসে নেই। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্র্রদায়ের সহযোগিতা চাই।
 
রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি দ্বিপীয় আলোচনার দ্বারও বাংলাদেশ উন্মুক্ত রেখেছে উল্লেখ করে শহীদুল হক বলেন, ছলচাতুরীর আশঙ্কা থাকলেও মিয়ানমারের আহ্বানে বাংলাদেশ দ্বিপীয় আলোচনায় গেছে। যদিও অনেকে বলেন, আমরা যেন মিয়ানমারের দ্বিপীয় আলোচনার ফাঁদে পা না দেই। আমি বলতে চাই, আমরা জেনে-বুঝেই মিয়ানমারের সাথে আলোচনায় গেছি। আমরা জানি এটা থেকে তারা সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে।
 
সেজন্য যখনই আমরা দ্বিপীয় আলোচনায় গেছি, তখনই এ সংক্রান্ত অন্যান্য দিক আমলে রেখেছি। পাশাপাশি যা যা করণীয় করা হচ্ছে। যার ফলে নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলও সরব আছে।
 
 
 
সূত্র: নয়া দিগন্ত

 

Exit mobile version