“জান্তার জন্য আর অর্থ ব্যয় না করে সেই অর্থ প্রদান করা উচিত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের।’”

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাপানের সমালোচনা জাতিসংঘের

fec-image

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতেই ২০১৭ সালে এই গণহত্যা চালানো হয়েছিল।

মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া এবং সামরিক সরকারকে যাবতীয় সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকতে জাপানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত টমাস অ্যান্ড্রুজ।

শুক্রবার(২৮ এপ্রিল) এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে আগ্রাসনের জেরে জাপন রাশিয়ার ওপর যেমন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তেমনি মিয়ানমারের ওপরও (জাপানের) নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত। পাশপাশি জান্তার জন্য আর অর্থ ব্যয় না করে সেই অর্থ প্রদান করা উচিত বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের।’

জাপান ও মিয়ানমারের মধ্যকার একটি সামরিক চুক্তি অনুসারে প্রতি বছর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কিছু বাছাইকৃত সেনাকে প্রশিক্ষণ দেয় জাপান। প্রশিক্ষণের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করে জাপান নিজেই। শুক্রবারের বিবৃতিতে এই চুক্তিরও সমালোচনা করেছেন রিচার্ড অ্যান্ড্রুজ।

বিবৃতিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘তারা জাপানের সহায়তায় সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছে এবং শিখছে কী করে দক্ষ সৈনিক ও কমান্ডার হওয়া যায়; তারপর এই প্রশিক্ষিত সেনারা সেই সেনাবাহিনীতে ফিরবে, যারা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধপরাধে দায়ী। যতদিন জাপান এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ না করবে, ততদিন তারা বর্বর সামরিক শাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকবে।’

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সঙ্গে জাপানের মিত্রতা দীর্ঘদিনের। ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত জাপান ছিল মিয়ানমারের প্রধান আর্থিক সহায়তা প্রদানকারী ও বিনিয়োগকারী দেশ। অভ্যুত্থানের পর সেই সহায়তার প্রবাহ সংকুচিত হলেও একেবারে বন্ধ হয়নি।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ স্টেশন ও সেনা ছাউনিতে বোমা হামলা করার অভিযোগ ওঠে সশস্ত্র রোহিঙ্গাগোষ্ঠী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) বিরুদ্ধে। সেই হামলার জের ধরে বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তবর্তী রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হামলা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের সামনে টিকতে না পেরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশসহ আশপাশের বিভিন্ন দেশে পালাতে শুরু করে। বাংলাদেশ সরকারের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠী তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করতেই ২০১৭ সালে এই গণহত্যা চালানো হয়েছিল।

এদিকে, সেনাবাহিনী যখন রোহিঙ্গাদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাচ্ছিল— সে সময় মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসীন ছিল গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক এনএলডি সরকার; কিন্তু সুচি বা তার নেতৃত্বাধীন সরকারের কোনো প্রতিনিধি সেনাবাহিনীকে এই অভিযান বন্ধের আহ্বান জানিয়ে একটি কথাও বলেননি।

সুচি ও তার সরকারের অসহযোগিতার কারণে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারটি ঝুলে যায়। প্রায় ৫ বছর এই অবস্থা চলার পর ২০২১ সালে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লেইংয়ের নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গণতন্ত্রপন্থী এনএলডি সরকারকে হটিয়ে জাতীয় ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। বন্দি করা হয় সুচি ও তার দল এনএলডির শীর্ষ ও মধ্যমসারিরর প্রায় সব নেতাকে। সম্প্রতি সুচির রাজনৈতিক দল এনলডিকে বিলুপ্ত বলেও ঘোষণা করেছে জান্তা।

মিয়ানমারে জান্তা শাসন শুরু হওয়ার পর থেকে আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে দেশটিতে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়া বা প্রত্যাবাসন।

তবে জাতিসংঘের এই বিশেষ দূত এমন এক সময়ে এসব কথা বললেন যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর মাত্র শেষ করেছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সঙ্গে বৈঠকেও রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। বুধবার ওই বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ও জাপান তাদের সম্পর্ককে কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত করেছে। বাংলাদেশ মিয়ানমার থেকে আসা প্রায় এক মিলিয়ন বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছে এবং আমরা তার প্রচেষ্টাকে সমর্থনদান অব্যাহত রাখবো।’

জাতিসংঘের হিসেবে বাংলাদেশে এখন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে। তাদের জন্য চলতি বছরে প্রয়োজন ২৮৫.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার; কিন্তু এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে চাহিদার মাত্র ১৮ শতাংশ অর্থ। করোনা মহমারির সময় থেকেই চাহিদা অনুযায়ী অর্থ মিলছে না। যে অর্থ দিচ্ছে জাতিসংঘ তা প্রকৃত চাহিদার বড় জোর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ।

রোহিঙ্গাদের অর্থ সহায়তা প্রদান ও তদারক বিষয়ক বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন ডোনারদের চোখ এখন ইউরোপের শরণার্থীদের দিকে।

সূত্র: ঢাকা পোস্ট

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন