parbattanews

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে ভূ-রাজনীতি

 

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের উল্টো দিকে ঘোরার পেছনে পুরোটাই কাজ করছে ভূ-রাজনীতি। গত বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) নয়া দিল্লি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বাংলাভাষী মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অং সাং সু চি’র কঠোর সামরিক নীতিকে দ্ব্যর্থহীন সমর্থন দান থেকে সরে আসে। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার অব্যাহতভাবে যে দমন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে তা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিপণ্ন করে তুলবে বলে প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা যে অভিমত প্রকাশ করেছেন তার সঙ্গে জোরালো ঐক্যমত প্রকাশ করেছে ভারত। রোহিঙ্গা সংকট পুরো অঞ্চলের ওপরও গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে বাংলাদেশ মনে করে।

সম্প্রতি মিয়ানমার সফরে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সর্বান্তকরণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের নীতিকে সমর্থন দিয়ে আসেন। দুই দেশের নেতা এই ইস্যুটিকে একটি ‘ইসলামী সন্ত্রাসী চক্রান্ত’ এবং ভারত ও মিয়ানমার দু’দেশের নিরাপত্তার ওপর এর প্রভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু দিল্লি এখন বলছে যে, এই ইস্যুতে সু চি যেন অধিকতর ‘সংযমশীল’ ও ‘পরিপক্ক’ পন্থা অবলম্বন করেন সে জন্য তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে বলেন যে, শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে ভারত “দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক” পর্যায় থেকে মিয়ানমারকে চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশী কর্মকর্তারা জানান, ভারত বলেছে যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা বন্ধ করতে হবে এবং বাস্তচ্যুত চার লাখ মানুষকে ফিরিয়ে নিতে হবে।

ত্রাণ পাঠিয়েছে ভারত

এর আগে দিনের বেলা, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শৃংলা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছে ৫৩ টন ত্রাণ সামগ্রি হস্তান্তর করেন। বাংলাদেশে ভারতের ব্যাপারে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা টের পেয়ে গত বুধবার শৃংলা নয়াদিল্লি ছুটে যান এবং ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক ত্রাণ সাহায্য নিয়ে আসেন। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরে ত্রাণের এই চালান পৌঁছে এবং ভারতের হাই কমিশনার নিজে কক্সবাজার গিয়ে বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন।

এর আগে গত শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি মিয়ানমার সম্পর্কে সাউথ ব্লকের দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন। ফলে ওই দিনই ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া বিবৃতিতে বলা হয় রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে “সংযম ও পরিপক্ক আচরণ করতে হবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক নাগরিকদের কল্যাণের ব্যাপারে মনযোগী হতে হবে।”

ভারতের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র রবিশ কুমার বলেন, “(রাখাইন) রাজ্যে দ্রুত সহিংসতা বন্ধ করে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এর পরপরই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার শৃংলাকে জরুরিভিত্তিতে সাউথ ব্লকের পররাষ্ট্র দফতরে ডেকে পাঠানো হয় ব্রিফিংয়ের জন্য। নর্থ ব্লকের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিরাপত্তা-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এনেও ব্রিফ করা হয়। অথচ এর আগে উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিরেন জিজিজু বলেছিলেন, ভারতে বসবাসরত ৪০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীরা হলো অবৈধ অভিবাসী এদেকে বহিস্কার করা হবে।

অবস্থান পরিবর্তনের কারণ

ভারতের এই আকস্মিক অবস্থান বদলের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক চাপকে দায়ি করা গেলেও এর পেছনে রয়েছে আরো গভীর কারণ।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চীন সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় ভারত বিচ্ছিন্নতা অনুভব করছিলো। অন্যদিকে, ভারতের কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও সু চির সমালোচনা করে। এদিকে, রোহিঙ্গাদের দেশ থেকে বহিস্কারের ব্যাপারে ভারত সরকারের পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের প্রধান প্রিন্স জেইদ।

পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, প্রতিটি ক্ষেত্রে চীনকে অনুকরণ করার প্রবণতা পরিহার করা ছাড়া ভারতের সামনে আর কোন পথ থাকেনি। ফলে দেশটি ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব নিকেশ করে নিজস্ব স্বার্থের ভিত্তিতে একটি আলাদা অবস্থান নিতে বাধ্য হয়।

মিয়ানমার সেনা অভিযান বন্ধ করে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিলে বাংলাদেশের ওপর গুরুতর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে বলে ঢাকার পক্ষ থেকে যে কথা বলা হয় দিল্লি যদি তা আমলে নিতে ব্যর্থ হয়, ভারতের জন্যও তার ফল হবে বহুমুখি এবং চরম ক্ষতিকর। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি ভেঙ্গে পড়ে তাহলে দেশটির সাধারণ জনগণ এর জন্য ভারতকে দায়ি করবে। আর তার প্রভাব পড়বে ভারত-বান্ধব হাসিনা সরকারের ওপর। আগামী বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রবল পুলিশি অ্যাকশনের কারণে দমে থাকা ইসলামী জঙ্গিরা তখন জনগণের সমর্থন পাবে, আর তা হবে হাসিনা সরকারের জন্য ক্ষতিকর। তখন পরিস্থিতি ভারতের প্রতি ততটা বন্ধুভাবাপন্ন নয় এমন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র অনুকূলে চলে যাবে।

হাসিনা নিজেও জনগণের সমর্থন আদায়ের জন্য ইসলামি জঙ্গিদের ব্যাপারে সহজ হতে পারেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ভারতীয় জিহাদিদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। এ পর্যন্ত ভারতের জন্য বেশ সহায়ক ‘ঢাকা-দিল্লি নিরাপত্তা সহযোগিতা’ একটি অতীতের বিষয়ে পরিণত হতে পারে।

আর সর্বশেষ হলো, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। এই ঢল ভারতে ছড়িয়ে পড়তে পারে (ইতোমধ্যে অনেক ছড়িয়েছে)। এতে মোদি-বিরোধী মমতা ব্যানার্জির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হবে।

সংক্ষেপে, দূরবর্তী মিয়ানমারের সমস্যাটি ভারত সরকার ও ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)’র জন্য একটি অভ্যন্তরিণ মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

মিয়ানমারে অর্থনৈতিক স্বার্থ

তাছাড়া, সিত্তুইয়ের গভীর সমুদ্র বন্দর ও ভারতের মিজোরামকে থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত করার সড়কের মতো ভারতে উচ্চাভিলাসি অর্থনৈতিক প্রকল্পগুলো মিয়ানমারের রাখাইনে অথবা এই রাজ্যের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তুই। এই রাজ্যেই রোহিঙ্গাদের বাস।

মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান চীনা প্রভাব ঠেকাতে এসব প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এই অঞ্চলে যদি উত্তেজনা বিরাজ করে আর ক্রমাগত সহিংসতা চলতে থাকে তাহলে ওইসব প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা তৈরি হবে।

সূত্র: southasian monitor.com

Exit mobile version