parbattanews

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আতঙ্ক ছিল কুখ্যাত জকির ডাকাত : খুশিতে মিষ্টি বিতরণ

টেকনাফের নয়াপাড়া মোচনি-শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডাকাতি, মাদক, মানব পাচার, চাঁদাবাজি, অপহরণ বাণিজ্য ও দোকান দখল এসবই নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। বিশেষ করে পাহাড়ঘেষা রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে সক্রিয় রয়েছে সংঘবদ্ধ রোহিঙ্গা ডাকাত দল। এসব অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো নুর আলম, মো. সলিম ও জকির আহমদ।

এরমধ্যে নুর আলম বিগত ২০১৮ সনে র‌্যাবের সাথে বন্ধুকযুদ্ধে নিহতের পর নিয়ন্ত্রণে আসে মোছনি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মো. সেলিম ডাকাত। তখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো এক চেটিয়া দখল নিয়ে হত্যা-রাহাজানি, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানান অপরাধে ক্ষুদ্র ডাকাত দলের মাঝেও অতিষ্ট হয়ে উঠে রোহিঙ্গা সেলিম ডাকাত।

সর্বশেষ হ্নীলা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের যুবলীগ নেতা ও প্রাইমারি স্কুলের পরিচালনা কমিটির সভাপতি ওমর ফারুককে হত্যা করে দেশ জুড়ে পরিচিত ও আলোচনায় উঠে আসে কুখ্যাত ওই সেলিম ডাকাত। তার এমন বেপরোয়া পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের দিন দিন বদনাম ছড়িয়ে পড়ে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে সাধারণ রোহিঙ্গারা। কিন্তু তার অত্যাচার ও হামলার ভয়ে সহজে মুখ খুলতো না কেউ। এক পর্যায়ে ডাকাতদের মধ্যেও সেলিমকে সহ্য করতে পারেনি। কৌশলে সেলিম ডাকাতকে ২০১৯ সনে হত্যা করে তার স্থান দখল করে নেয় জকির আহমদ ওরফে জকির ডাকাত। অপরাধের রাজ্যের সর্বশেষ নেতৃত্বে ছিল সে।

গত মঙ্গলবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় র‌্যাবের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় নয়াপাড়ার সি-ব্লকের আমিনের ছেলে জাকির আহমদ ওরফে জকির ডাকাত। এসময় তার অপর দুজন সহযোগীও নিহত হয়। তারা হলো, মো. হামিদ ও শালবন রোহিঙ্গা শিবিরের মো. জহির। জকির নিহতের সাথে সাথে দেড়-দুই বছরের মুর্ত্যমান জীবনের সমাপ্তি ঘটে পাহাড়ি রোহিঙ্গা শিবির গুলোতে। তার মৃত্যুে খবরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিষ্টি বিতরণ করে সাধারণ রোহিঙ্গারা।

ইয়াবা ব্যবসা-অপহরণ :
নেতৃত্বে চলে আসার পর জকির ডাকাতের মুল টার্গেট ছিল মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার করে নিয়ে আসা। লাখ লাখ ইয়াবা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করিয়ে তা দেশের বিভিন্ন জেলায় পাচার করতো জকির বাহিনীর লোক। ইয়াবা নিয়ে তার একটি বড় সিন্ডিকেট রয়েছে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনেক সাধারণ রোহিঙ্গারা বলেছেন। মিয়ানমারেও জকিরের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। মুলত ওই সিন্ডিকেট সীমান্ত রক্ষী বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে নাফ নদী পার করে দিতো বস্তা বস্তা ইয়াবার প্যাকেট। এছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তি রয়েছে। ওইসব ধনাঢ্য ব্যক্তিরা কে কোথায় বসবাস করতো তা খুঁজে বের করে তাদের অপহরণ এবং তাদের না ফেলে তার ছোট ছেলেদের অপহরণ করে লাখ লাখ টাকা মুক্তিপন আদায় করাও ছিল জকিরের অন্যতম আয়ের উৎস্য। মুক্তিপন দিতে অপরাগতা কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে খবর দিলে হত্যা করে লাশ গুম করে ফেলতো। এর ভয়ে যাদের অপহরণ করতো তারা কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে মুক্তি পেতো।

এদিকে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফের নয়াপাড়ার সি ব্লকের আমিনের ছেলে জকির (২৮)। জকিরের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে। তাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। বিশেষ করে টেকনাফের নয়াপাড়া মোচনি-শালবন, জাদিমুরা, লেদাসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করতেন জকির ডাকাত।

তবে গত বছর ২ মার্চ টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি পাহাড়ে র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে সাত ডাকাত নিহত হলে এক প্রকার ভয় পেয়ে যায় জকির ডাকাত। নিজেকে আত্মগোপন করে দুয়েক মাস চুপ থাকে। এক পর্যায়ে ক্যাম্প সংলগ্ন পাহাড়ি সক্রিয় ডাকাত বাহিনী জকির কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ফলে নতুন করে সদস্য সংগ্রহ করে দল গোছিয়ে আবার আবির্ভাব ঘটে। দলের প্রায়ই সদস্য উঠতি বয়সের যুবক। গত ডিসেম্বর মাসে নয়াপাড়া এলাকার স্থানীয় আবদু শুক্কুরকে দিন দুপুরে গুলি করে হত্যা করে জকির নিজে। বীপদর্পে ঘুরে বেড়াতো ক্যাম্পে। তার সোর্স ছিল অত্যন্ত চতুর। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য কিংবা ক্যাম্পে নতুন মুখের আগমন ঘটলে মুহর্তে খবর পৌঁছে যেতো জকিরের কাছে। অবশেষে মঙ্গলবার শেষ বিকেলে তার কোন কৌশল কাজে আসেনি। র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে দুই সহযোগীসহ নিহত হন জকির।

খুশি সাধারণ রোহিঙ্গারা :
জকির ডাকাত নিহতের খবরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অনেকে উল্লাসে মেতে উঠে। বিশেষ করে মোছনি নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পেন্ডেল সাজিয়ে উল্লাসে মেতে উঠে সাধারণ রোহিঙ্গারা। অনেকে মিষ্টি বিতরণ করে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছেন। আবার স্বজন হারানো অনেকে শোকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তবে নিহত জকির ডাকাত দলের সদস্যদের ভয়ে অনেকে নিভৃতি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছেন বলে অনেকে জানিয়েছেন।

স্থানীয়রাসহ রোহিঙ্গারা অভিযোগ করে বলেন, জাদিমুরা, নয়াপাড়া, মোছনি ও লেদা ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে রোহিঙ্গা ডাকাতদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। দিনে পাহাড় আর রাতে ক্যাম্প চষে বেড়ায় তারা। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানবপাচার, অপহরণসহ এমন কোনও অপরাধ নেই যা তারা করে না। এসবের সাথে স্থানীয় কতিপয় কয়েক ব্যক্তি সহযোগী রয়েছেন। এসব আস্তানায় অভিযান জরুরী। টেকনাফ মডেল থানার ওসি হাফিজুর রহমান বলেন, ক্যাম্পে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও নজরদারি রাখছে।

এদিকে, কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, জকিরসহ তার সহযোগীদের নামে ধর্ষণ, ডাকাতি, হত্যাসহ একাধিক মামলা রয়েছে। জকিরের বিরুদ্ধে ২০টির বেশি মামলা রয়েছে। মূলত তারা ক্যাম্পে ত্রাস সৃষ্টি করতো।

তিনি বলেন, ‘এই গ্রুপকে ধরতে র‌্যাব-১৫ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার নয়াপাড়া-মোছনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিম পাহাড়ে জকির বাহিনীর আস্তানা ঘিরে ফেলে র‌্যাব। মাইকিং করে তাদের বারবার আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা র‌্যাবকে লক্ষ্যে করে গুলি চালায়। র‌্যাবও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। ঘণ্টাখানেক গোলাগুলির পর ডাকাতরা পিছু হটে পাহাড়ি অঞ্চলে ঢুকে পড়ে। পরে ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে তিন জনের গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। তার মধ্যে ডাকাত দলের প্রধানও ছিল।

র‌্যাব বলছে, ঘটনাস্থল থেকে দুটি পিস্তল, দুটি বন্দুক, ৫টি ওয়ান শুটারগান ও ২৫ রাউন্ড পিস্তলের গুলি উদ্ধার করে।

Exit mobile version