parbattanews

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে বাঙালি জীবন

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

পালংখালী ইউনিয়নের মধুছড়া লম্বাসিয়া এলাকার বাসিন্দা নূর উদ্দিন। পরিবারের সঙ্গে গত বিশ বছর ধরে লম্বাসিয়া এলাকাতেই থাকছেন স্থানীয় এই যুবক। দীর্ঘ দুই দশক সেখানে নির্বিঘ্নেই কাটিয়েছে তার পরিবার। সম্প্রতি সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় জীবন-যাপন নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এই যুবক ও তার পরিবারের সদস্যরা। আগে বাড়ির আশপাশের জায়গায় শাক-সবজির চাষ করে দৈনন্দিন তরকারির চাহিদা পূরণ করতো অস্বচ্ছ্ল পরিবারটি। সেখানে এখন বাজারের সবজির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে তাদের।তাও আবার কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ দামে।

নূর উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিশ বছর আগে উখিয়া পৌরসভা এলাকা থেকে এসে আমরা এখানে বাড়ি করেছি। এরপর থেকেই এখানে থাকছি। এতদিন আমরা নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারতাম। কিন্তু এখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় ওইভাবে চলাফেরার সুযোগ নেই। অতিরিক্ত রোহিঙ্গার চাপে এখন বাসা থেকে বের হতে পারছি না। হাজার হাজার রোহিঙ্গার মাঝে এখন নিজ দেশে আমরা যেন অন্য দেশের বাসিন্দা।’

২৯ অক্টোবর নূর উদ্দিনের ঘরেই তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। চারপাশে মাটির দেয়ালের ওপর টিনের চালার ওই ঘরে যখন তার সঙ্গে কথা হয় তখন ঘড়িতে বিকেল সাড়ে ৩টা।

স্থানীয় এই যুবক বলেন,‘আমরা দিনে এনে দিন খাই।বাবা দিনমজুর হিসেবে কাজ করেন, আমি কাঠমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করি। সবসময় কাজ থাকে না। যখন কাজ থাকে না তখন না খেয়েই থাকতে হয়। আগে বাড়ির আশপাশের জায়গায় শাক-সবজি চাষ করে তরকারির চাহিদা পূরণ করতে পারতাম, কিন্তু এখন সেসব জায়গায় রোহিঙ্গারা ঘর তোলায় সেই সুযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।’

তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘গত দুই মাস ধরে এখানে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতিনিয়ত ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা না খেয়ে থাকলেও আমাদের দেখার কেউ নেই।এক সঙ্গে থাকলেও তারা ত্রাণ নিয়ে হেসে হেসে বাসায় ঢুকে, আর আমাদের চেয়ে থাকতে হয়।’

একই এলাকার আরেক স্থানীয় বাসিন্দা আবুল হোসেন। একই ধরনের সমস্যার কথা তিনিও বলেছেন।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিয়ানমারে নির্যাতিত এইসব মানুষদের আশ্রয় দেওয়ায় আমার কোনও আক্ষেপ নেই। আমি তাদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি আমরা যারা আগে থেকে এই এলাকায় বসবাস করছি, আমাদের বিষয়টিও সরকারের দেখা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (রোহিঙ্গাদের) আশ্রয় দিতে গিয়ে আমরা চাষাবাদের জমি হারিয়েছি। কষ্ট করে জীবন-যাপন করছি। কিন্তু আমাদের কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। অথচ গত দুই মাস ধরে প্রতিদিন তাদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের অনেকে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি ত্রাণ পাচ্ছেন। প্রয়োজন না থাকায় অনেকে তা বিক্রিও করে দিচ্ছেন।

সরকারি হিসেবে এখানে তো সব খাস জায়গা, তাহলে আপনারা কিভাবে এখানে বাড়ি করেছেন জানতে চাইলে আবুল হোসেন বলেন, ‘এটা আমাদের নিজেদের জায়গা। আমরা জায়গা কিনে এখানে ঘর বানিয়েছি। এখানে আমাদের মতো আরও  প্রায় ২০০ স্থানীয় পরিবার বসবাস করছে। তারাও জায়গা কিনে ঘর-বাড়ি করেছেন।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, কুতুপালং ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্র-৩ -এ যাওয়ার পথে মাঝামাঝি জায়গায় একটি কাঁচা সড়ক হাতের ডান দিকে চলে গেছে। ওই সড়ক ধরে হাঁটার সময় দু’পাশে নতুন আসা রোহিঙ্গাদের গড়ে তোলা পলিথিনে মোড়ানো অসংখ্য বাঁশের ঘর চোখে পড়ে। এসব ঘরের মাঝে কিছু দূর পর পর দেখা যায়, বেশ কয়েকটি টিনের ঘর। এসব ঘরেই দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয়রা বসবাস করে আসছেন। ওই সড়ক ধরে হাঁটার সময় এই প্রতিবেদক এ ধরনের অন্তত ১০টি টিনের ঘর দেখেছেন ও বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলেছেন।

কুতুপালং ক্যাম্পের ওই এলাকায় স্থানীয়দের বসবাসের বিষয়টি স্বীকার করেছেন স্থানীয় পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘স্থানীয় কিছু অসহায় পরিবার দীর্ঘদিন যাবত মধুছড়া লম্বাসিয়া এলাকায় সরকারি খাস জমিতে ঘর তুলে থাকছেন। সম্প্রতি ওই এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় তারা অস্বস্তিতে পড়েছেন। তাদের অনেকের ঘরের সামনে পেছনে সবদিকে রোহিঙ্গারা ঝুপড়ি ঘর তুলে বসতি গড়ে তুলেছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে একইসঙ্গে থাকলেও স্থানীয় এই অসহায় পরিবারগুলো কোনও ত্রাণই পাচ্ছে না।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নিকারুজ্জামান বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের সরকারি খাস জমিতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। তাই সেখানে স্থানীয়রা থাকার কথা না। কারও ঘর-বাড়ি থাকলে সেটা তারা জবরদখল করে আছেন। ওই রকম কেউ আছে, এটা আমাদের চোখে পড়েনি। আমি ওই দিকে গিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমাদের স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে, এটা সত্য। তাই আমরা যেসব এনজিও এখানে কাজ করছে তাদের বলেছি কর্মী নিয়োগে তারা যেন স্থানীয়দের অগ্রাধিকার দেয়। চিকিৎসাসহ ত্রাণ তৎপরতায় ক্যাম্প সংলগ্ন অসহায় পরিবারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে আমরা এনজিওগুলোকে বলেছি। স্থানীয়রা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। তাদের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Exit mobile version