রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্বেচ্ছা পাহারা, অপরাধ কমেছে ৯৫ শতাংশ

fec-image

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় তিন স্তরের পাহারা চালু হওয়ায় বইতে শুরু করছে শান্তির বাতাস। কমে এসেছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড। ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গারা নিরাপদে রাত কাটাতে পারছে।

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো। মানুষের তেমন বিচরণ থাকতো না ক্যাম্পের অভ্যন্তরে। যার ফলে বেশ কিছু সময় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একের পর এক খুন, গুম, ধর্ষণ, অপহরণ, মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ, চোরাচালানসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেতে থাকে। তখন ক্যাম্পে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয় নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এপিবিএন’কে।

ক্যাম্পে এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সৃজনশীল চিন্তা মাথায় এনে ক্যাম্পে প্রথম স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গাদের পাহারার ব্যবস্থা চালু করেন ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রবিউল ইসলাম পিপিএম-সেবা। এরপর থেকে পাল্টে যেতে শুরু করে ক্যাম্পের পরিস্থিতি।

পার্বত্য নিউজ’কে তিনি বলেন, ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারীদের অপতৎপরতাকে রুখে দিতে চালু করা হয় শান্তিকামী এফডিএমএন সদস্য দ্বারা স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা।

বিশেষ করে গত ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর ক্যাম্প-১৮ এর ‘জামেয়া দারুল উলুম নাদুয়াতুল ওলামা আল ইসলামীয়া মাদরাসায় রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারীরা ছয়জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড ও নারকীয় ৬ খুনের পর এফডিএমএন সদস্যরা নিরাপত্তা প্রশ্নে দিশেহারা হয়ে পড়েন।

৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেছেন, ‌ভিন্নভাষা ও সংস্কৃতির জনগোষ্ঠীকে প্রতিকূল পরিবেশে কীভাবে দুষ্কৃতিকারী, চাঁদাবাজ, অপহরণকারী, মুক্তিপণ দাবিকারী, নারী নির্যাতনকারীদের নির্যাতন ও নিষ্পেশন থেকে শান্তির বলয়ে নিয়ে আসা যায় তা আমার চেতনাকে বারবার নাড়া দিয়ে গেল। আমার মাথায় এলো “এফডিএমএন সদস্যদের দ্বারা স্বেচ্ছায় পাহারার চিন্তা।”

তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর আমার দায়িত্বাধীন শফিউল্লাহ কাটা ক্যাম্প-১৬ ও জামতলি ক্যাম্প-১৫ এর সকল অফিসার ও মাঝিদের সাথে স্বেচ্ছায় পাহারা নিয়ে সভা করি। অতঃপর দুইটি ক্যাম্পে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালু করি। উক্ত দুইটি পুলিশ ক্যাম্পের ১৪৭টি উপদলে পাঁচজন করে মোট ৭৩৫ জন স্বেচ্ছায় পাহারা দিতে থাকে। ১৫ দিন পর এই স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার ফলাফল মূল্যায়ন করে দেখা গেল দুষ্কৃতিকারীদের অপরাধ সংঘটন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।

তার দাবি, আমাদের সহজ বক্তব্য ছিল- তোমরা ৫ জন আজকে পাহারা দিচ্ছ, এতে ক্যাম্পের প্রায় ৫০০ জন মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারছে। আগামীকাল অন্য ৫ জন পাহারা দেবে, তোমরা শান্তিতে ঘুমাবে। এভাবে ১৫-২০ দিন পর তোমাদের পাহারা পড়বে।

তার মতে, তারা এটিকে অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন এবং তা বাস্তবায়নে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। শান্তিকামী এফডিএমএন সদস্যরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে পাহারা দিতে থাকল। এর সুফল সম্পর্কে অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) মহোদয়কে অবহিত করি। তিনি সেই বছরের ৮ নভেম্বর থেকে আমার চালু করা স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা অন্য আটটি এফডিএমএন ক্যাম্পে চালু করার জন্য ক্যাম্প কমান্ডারদের নির্দেশ দেন।

এদিকে ৮ এপিবিএন এর আওতাধীন ১১টি এফডিএমএন ক্যাম্পে ৬৪টি ব্লকে ৭৭২টি সাব-ব্লক রয়েছে। এক সাব-ব্লক থেকে অন্য সাব-ব্লকের গড় দূরত্ব ৫০-৬০ মিটার। মোট লোকসংখ্যা ৩ লাখ ৬২ হাজার ২১৮ জন। প্রতিটি সাব-ব্লকে গড়ে বাস করে ৪৬৮.৫৮ জন। প্রতিটি সাব-ব্লকে গড়ে স্বেচ্ছায় পাহারা সক্ষম পুরুষের সংখ্যা ৮০-১০০ জন। প্রতিরাতে একটি সাব-ব্লকে ৫ থেকে ১০ জন করে পাহারা দিচ্ছে। প্রত্যেকটি ক্যাম্পের এক্সিট এন্ট্রি পয়েন্টে পুলিশের সাথে ১৫ থেকে ২০ জন এফডিএমএন সদস্য স্বেচ্ছায় পাহারা দেয়। এই হিসেবে প্রতিরাতে স্বেচ্ছায় পাহারা দিচ্ছে ৩ হাজার ৮শ ৬০ জন। ১৫-২০ দিন পর একজন পাহারাদারের পাহারা পড়ে। অর্থাৎ এক রাত পাহারা দিলে ১৫-২০ দিন শান্তিতে ঘুমানো যায়। প্রতিদিন ক্যাম্পের চিফ মাঝির (এফডিএমএন ক্যাম্পের প্রধান নেতা) মাধ্যমে নির্ধারিত ফরমে পাহারাদারদের তালিকা পুলিশ ক্যাম্পে প্রেরিত হয়।

এ ব্যবস্থায় পুলিশ ৩ স্তরে ক্যাম্পের পাহারার দায়িত্ব মনিটরিং করে। প্রথম স্তর-ক্যাম্পের নির্দিষ্ট ডিউটি পার্টি, দ্বিতীয় স্তর-ক্যাম্পের নিজস্ব তদারকি পার্টি যা পুলিশ পরিদর্শক/এসআই এর নেতৃত্বে তদারকি হয়। তৃতীয় স্তর-এএসপি/এডিশনাল এসপির নেতৃত্বে সকল ক্যাম্পে পাহারা দায়িত্ব তদারকি করা হয়। সার্বিক তদারকি অধিনায়ক মহোদয় করে থাকেন।

৮ এপিবিএন ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয় সেই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। অপারেশনাল কার্যক্রম চালুর পর থেকে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর আগে অর্থাৎ ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ৮.২৫ মাসে বিভিন্ন মামলায় ২০৮ জন দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতার হয়। নির্ধারিত এই সময়ের মধ্যে ২টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৯ রাউন্ড গুলি, ৯৪টি দেশীয় অস্ত্র, ৪ লাখ ১৯ হাজার ৮শ ৮৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ১৮ ভরি স্বর্ণ উদ্ধার হয়।

স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর পর থেকে অর্থাৎ ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৮.২৪ মাসে বিভিন্ন মামলায় ৭৫৪ জন দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতার হয়। ১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৫৩৩ রাউন্ড গুলি, ১৪১টি দেশীয় অস্ত্র, ১৫ লাখ ৩৭ হাজার ১৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট ও ৪৯ ভরি ১৫ আনা ৪ রতি স্বর্ণ উদ্ধার হয় এবং ক্যাম্প ইতিহাসে প্রথম ক্লুলেস মার্ডার ডিটেকশন হয়।

এছাড়া স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর পূর্বের এবং পরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্বেচ্ছায় পাহারা চালুর পর একই সময়ে দুষ্কৃতিকারী গ্রেফতার বেড়েছে ৩.৬৩ গুণ, মাদক উদ্ধার বেড়েছে ৩.৬৬ গুণ, আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে ৬.৫ গুণ, গুলি উদ্ধার ৫৯.২২ গুন ও স্বর্ণ উদ্ধার বেড়েছে সাড়ে ২.৭৪ গুণ। এফডিএমএন সদস্যদের অভিমত যে, স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালুর পরে ক্যাম্প গুলোতে ৯৫% অপরাধ কমে গেছে।

স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থার মাধ্যমে এফডিএমএন সদস্যরা নিজস্ব নিরাপত্তা ও শান্তির প্রশ্নে দায়িত্বশীল হয়েছে এবং তাদের মনমানসিকতায় ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। অপরদিকে জালের মতো বিস্তৃত স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থায় দুষ্কৃতিকারীরা পুলিশি অভিযানে একের পর এক গ্রেফতার হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় জঙ্গীবাদ, বিভিন্ন ষড়যন্ত্র, অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, গোয়েন্দা তথ্য প্রাপ্তি সহ হচ্ছে। ক্যাম্প এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

পুলিশ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্যাম্পে শান্তি, নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় তথ্য আদান প্রদানের ক্ষেত্রে আস্থার সমর্থন তৈরি হয়েছে। বহুমাত্রিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এপিবিএন পুলিশ আরও কৌশলী, উদ্যমী ও দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়েছে। পাশাপাশি হোস্ট কমিউনিটির জন্য একটি নিশ্চিত নিরাপত্তা বলয় ও শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থানের পরিবেশ বিনির্মিত হয়েছে।

এ ধারা অব্যহত থাকলে ক্যাম্প এলাকায় কোন রোহিঙ্গা দুষ্কৃতিকারীর মাথাচাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ৮ এপিবিএন কর্তৃক প্রবর্তিত স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা কক্সবাজারে অবস্থিত অন্য সকল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চালু হয়েছে। এখন ৩৩টি ক্যাম্পের ১ হাজার ৭শ ৭৩টি সাব-ব্লকে ৫ জন করে মোট ৮ হাজার ৮শ ৬৫ জন স্বেচ্ছাপাহারাদার পাহারা দেয়। এ পদ্ধতিটি শুধুমাত্র রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় নয় সারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল যেমন- চরাঞ্চল, হাওড় অঞ্চল, বনাঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল ও প্রতিটি জেলায় প্রবর্তনের মাধ্যমে চুরি, ডাকাতি, মাদক, ছিনতাইসহ নানাবিধ অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে মাইলফলক হবে বলে মনে করেন এপিবিএন এর এই কর্মকর্তা।

৮ এপিবিএন এর অধিনায়ক মোহাম্মদ সিহাব কায়সার খান পিপিএম-সেবা বলেন, বিভিন্ন ব্লক, সাব ব্লক থেকে রোহিঙ্গা নিয়ে স্বেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা চালু করার আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং ছিল, কিন্তু তা কেটে উঠে দ্রুত সময়ের মধ্যে সফলতার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

অধিনায়ক আরো বলেন, সেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা কারনে ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা কমে এসেছে। প্রতিনিয়ত দুষ্কৃতিকারীরা ধরা পড়ছে। মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ উদ্ধার বেড়েছে বহু গুণ। সব মিলিয়ে ক্যাম্পে শান্তি সুবাতাস বইতে শুরু করেছে।

সেচ্ছায় পাহারা ব্যবস্থা রোহিঙ্গাদের কতটুকু কাজে এসেছে এমন প্রশ্নের জবাবে উখিয়ার জামতলী ১৫ ক্যাম্পের এইচ ব্লকের হেড মাঝি মো. বশির বলেন, পাহারা ব্যবস্থা চালু হওয়ায় চুরি-ডাকাতি, মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ, মানবপাচার, খুনের মতো ঘটনা অনেকাংশে কমে গেছে।

তিনি আরো বলেন, কিছু দুষ্কৃতিকারী পরিকল্পিতভাবে ক্যাম্পে আগুন দিয়ে যে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করতো তা এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

একই ক্যাম্পের জি-ব্লকের হেড মাঝি মো. আয়াছ বলেন, ক্যাম্পে আগে যে পরিমাণ অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘঠিত হতো পাহারা ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর তা এখন কমে এসেছে। জামতলী ১৫ নাম্বার ক্যাম্পে ৫১০ জন পাহারাদার রয়েছে, তাদের কারণে ৫২ হাজার রোহিঙ্গা শান্তিতে ঘুমাতে পারতেছে। এই পাহারা ব্যবস্থা চালু থাকলে ক্যাম্পের অপরাধ শূন্যের কোটায় নেমে আসবে বলে সে দাবি করেন।

উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরবর্তী সময়ে আট লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে এসে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪ রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয়। এর আগেও কয়েক দফা রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করেছিল বাংলাদেশে। বর্তমানে সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। এসব রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: অপরাধ, রোহিঙ্গা ক্যাম্প
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন