parbattanews

রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক মানব পাচারের নেপথ্যে

উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক মানব পাচারে নেপথ্যে জড়িত রয়েছে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কটি দেশে এবং দেশের বাইরে বিস্তৃত। তাদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে ক্যাম্প ভিত্তিক দালাল চক্র। যাদের অন্যতম হচ্ছে রোহিঙ্গা মাঝি। এছাড়াও স্থানীয় কতিপয় জনপ্রতিনিধি, ক্যাম্প প্রশসানের গুটি কয়েক কর্তা-ব্যক্তি এর সাথে জড়িত। সব মিলিয়ে একজন ভিকটিমকে ঘর থেকে বের করে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ৫/৬টি সিন্ডিকেটের হাত বদল হয়ে থাকেন। বুধবার উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

রোহিঙ্গারা জানিয়েছন, মালয়েশিয়ায় আগে থেকে যাদের নিকট আত্মীয়-স্বজন রয়েছে, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে ক্যাম্প থেকে লোকজন সংগ্রহ করে। অধিকাংশ যুবতি নারীদের বিবাহের প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকে চক্রটি, আবার যুবকদের উচ্চ বেতনের চাকরির দেওয়ার আশ্বাসে এই ফাঁদে ফেলে সর্বস্ব শেষ করে তারা।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার হওয়ায় উখিয়া বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মো. জুবাইর (৩০) জানান, তাদেরকে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে আসেন টেকনাফে। বাহারছড়া নোয়াখালী পাহাড়ার সৈয়দ আলমও নুরুল আলম। তাদের একটি জুমপাড়া পাহাড়ে রাখেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি একটি ট্রলারে ১৩৮ জনকে তুলে দেয়। মঙ্গলবার ভোরে পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে ট্রলারটি ডুবে যায়।

উদ্ধার হওয়া কুতুপালং ৭নং ক্যাম্পের নজুমা বেগম (১৭) জানান, তার পিতা মারা গেছে মিয়ানমারে। সে খালুর বাসায় আশ্রয় নিয়ে বড় হয়েছে। সে জানায়, মোঃ রফিক নামের এক মালয়েশিয়া প্রবাসি ছেলের সাথে মোবাইলে সম্পর্ক হয় গত ২ বছর ধরে। সেই থেকে প্রতিনিয়ত ফোনে কথা হত। তার কথার উপর ভিত্তি করে, তাকে বিয়ে করার জন্য ক্যাম্প থেকে বের হয়ে নৌকা করে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। কোস্টগার্ড কর্তৃক উদ্ধার হয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বস্ব ক্যাম্প ইনচার্জ (সিআইসি)’র জিম্মায় পরিবারের কাছে ফেরত আসেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কুতুপালং ২ নাম্বার ক্যাম্পের এক মাঝি পার্বত্যনিউজকে জানান, তার ব্লক থেকে গত সপ্তাহে আমেনা বেগম (১৯) নামের এক যুবতি মেয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি দিয়েছে। সে মালয়েশিয়া পৌঁছে তাকে ফোন করেছে বলে জানিয়েছেন। তবে গত (১২ ফেব্রুয়ারি) উদ্ধার মালয়েশিয়াগামীর মধ্যে তার ব্লকের কেউ নেই বলে জানায় এই রোহিঙ্গা মাঝি। সে আরো জানায়, প্রতিনিয়ত ক্যাম্প থেকে যুবক-যুবতিরা বিভিন্ন স্থানে চলে যাচ্ছে। কিছুকিছু লোকজন আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার হাতে আটক হলেও বেশির ভাগ নিরাপদে পৌঁছে যাচ্ছে গন্তব্যে।

সাধারণ রোহিঙ্গাদের অভিমত:

কুতুপালং, লম্বাশিয়া ক্যাম্পে কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, অতি লোভে পড়ে রোহিঙ্গারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে থাকেন। যেহেতু রোহিঙ্গা অশিক্ষিত, হতদরিদ্র এবং হুজুকি। কেউ কিছু বললে তা সহজে গ্রহণ করে নেয়। যার ফলে বারবার প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে রোহিঙ্গারা। এছাড়া মিয়ানমারে ফেরা দীর্ঘায়িত হওয়ায় রোহিঙ্গারা দেশে-বিদেশ আশ্রয় নিতে চেষ্টা করছে।

মানবপাচারপাচারে যারা জড়িত:

মানবপাচার চক্রের মধ্যে দেশে এবং দেশের বাইরে বিশাল একটি চক্র জড়িত। তৎমধ্যে ক্যাম্পে সাধারণ রোহিঙ্গা, রোহিঙ্গা মাঝি, ক্যাম্প প্রশাসনের কতিপয় লোকজন এবং স্থানীয় গুটি কয়েক জনপ্রতিনিধি। তাদের আন্ডারগ্রাউন্ডে দেখভাল করে কতিপয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা।

যেভাবে ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা যুবক-যুবতির সংগ্রহ করা হয়:

রোহিঙ্গা ক্যাম্প ভিত্তিক রয়েছে মানবপাচার সিন্ডিকেটের বেশ কিছু দালাল চক্র। তাদের সাথে সখ্যতা রয়েছে রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা)’র সাথে। এসব মাঝি’র নিকট ব্লক ভিত্তিক তালিকা রয়েছে। তালিকায় প্রতিটি পরিবারের সদস্য/সদস্যদের নাম, ঠিকানা, মোবাইল নাম্বারসহ যাবতীয় তথ্য ভান্ডার সংরক্ষিত আছে। সেখান থেকে দালালচক্র তথ্য সংগ্রহ করে মাঝি’র মাধ্যমে কৌশলে বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে মালয়েশিয়া নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করে থাকে। পরবর্তী সুযোগ বুঝে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে আসেন দালালেরা।

মানবপাচারের টার্গেট:

মানবপাচারকারী বেশির ভাগ টার্গেট করে থাকে রোহিঙ্গা যুবতিদের। কারণ রোহিঙ্গা যুবতিদের পাচার করতে পারলে দালালেরা বহুগুণ লাভবান হয়ে থাকে। যেমন-বিদেশে রোহিঙ্গা যুবতিদের চাহিদা থাকায় উচ্চ দামে নাকি ক্রয় করে থাকেন হোটেল-মোটেলে। আর অনেকে বিবাহ করার জন্য পছন্দের পাত্রী হিসেবে নিয়ে থাকেন দালালদের নিকট থেকে।

সর্বশেষ মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) রাত ৯টার দিকে টেকনাফের বাহারছড়া এলাকা দিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়া প্রস্তুতিকালে ১৭জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।

অভিযানে নেতৃত্বদানকারী বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী বলেন, ‘দালাল চক্র একদল রোহিঙ্গাকে সমুদ্রপথে ট্রলারযোগে মালয়েশিয়া পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন খবরে উপকূলবর্তী ওই এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৩ জন পুরুষ ও চার জন নারী। তাদের যাচাই-বাছাই চলছে।

এর আগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় ১৩৮ জন যাত্রী নিয়ে একটি ট্রলার সেন্টমার্টিনের দক্ষিণে পাথরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনার এ পর্যন্ত ২১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার দিন জীবিত উদ্ধার করা হয় ৭৩ জনকে। এ ঘটনায় ১৯ জন দালালকে অভিযুক্ত করে থানায় মামলা করে কোস্টগার্ড। এরপর দিন (১২ ফেব্রুয়ারি) মালয়েশিয়ার যাওয়ার প্রস্তুতিকালে টেকনাফ থেকে আরও ১০জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুলিশ।

কক্সবাজার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) ইকবাল হোসাইন জানান, মানবপাচারসহ যেকোন ধরনের অপরাধমূক কর্মকাণ্ড বন্ধে পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে। পাশাপাশি মানবপাচার প্রতিরোধে ক্যাম্প ভিত্তিক এনজিও, আইএনজি মাধ্যমে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, নাটক, ব্যানার-পোস্টার লাগিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির করা হচ্ছে। এরপরেও মালয়েশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে কিছু দালালচক্র রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প  থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে এ ধরনের কিছু দালালদের চিহ্নিত করেছি। আর কিছু দালালকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরণ করেছি।

তিনি বলেন, শুধু ক্যাম্পে নয়, পুরো জেলায় মানবপাচার প্রতিরোধে পুলিশি অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

Exit mobile version