parbattanews

রোহিঙ্গা জন্মবিরতিকরণের চলমান উদ্যোগ ব্যর্থ, বিকল্প ভাবছে বাংলাদেশ

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পক্ষ থেকে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে জন্মবিরতিকরণ বড়ি ও কনডম সরবরাহ এবং ৩ মাস মেয়াদি ইনজেকশনের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা সফলতার মুখ দেখেনি। প্রভাবশালী ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি তাদের এক বিশেষ প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ‘অশিক্ষিত’ ও ‘পশ্চাৎপদ’ আখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, অন্ধ বিশ্বাসের কারণে তারা পরিবার পরিকল্পনাকে পাপ হিসেবে দেখে থাকে। এই বাস্তবতায় জন্মনিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিকল্প চিন্তা করছে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ। এএফপিকে তারা জানিয়েছে, সরকারের কাছে তারা স্টেরলাইজেশন (স্থায়ী/অস্থায়ী বন্ধ্যাকরণ) প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্মবিরতিকরণ উৎসাহিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তবে এই কাজটি খুব সহজ হবে না বলে জানিয়েছে তারা।

রাখাইনের সাম্প্রতিক সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ছাড়িয়েছে। আগে আসা আরও ৩ লাখের বেশি শরণার্থীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তারা। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার আশ্রয় শিবিরগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সরকারের। ২৩ অক্টোবর পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর সূত্র বাসসকে জানায়, রোহিঙ্গাদের জন্মনিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসতে সরকার তিনটি পদ্ধতিতে এগোচ্ছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, কনডম আর তিন মাস মেয়াদি ইনজেকশন।

কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ডা. পিন্টু ভট্টাচার্য বিকেলে বাসসকে জানান, ১০ হাজার রোহিঙ্গা নারীকে জন্মনিরোধক ইনজেকশন, দুই হাজার ৫০০ নারীকে জন্মনিরোধক ট্যাবলেট ও ৬০০ পুরুষকে কনডম সরবরাহ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা জন্মনিয়ন্ত্রণ বিষয়ে পুরোপুরি অজ্ঞ ছিলেন। এ বিষয়ে তাদের চরম অনাগ্রহ আমি দেখেছি। আমাদের কর্মীরা তাদের সঙ্গে কথা বলে, বুঝিয়ে মনোভাব পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছেন। ইতোমধ্যে ১৩ হাজারের মতো পুরুষ-নারীকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আওতায় আনা হয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যে এ সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে।’

তবে কয়েকদিনের মাথায় আজ (শনিবার) পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য এএফপিকে জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতনতা নেই বললেই চলে। মিয়ানমারে তারা শিক্ষাবঞ্চিত হওয়ায় এ বিষয়ে পুরো পশ্চাতে পড়ে আছে পুরো রোহিঙ্গা সম্প্রদায়। অনেক পরিবার আছে, যেখানে ১৯টি পর্যন্ত সন্তান আছে। অনেক রোহিঙ্গা পুরুষের রয়েছে একাধিক স্ত্রী।

পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের জন্মবিরতিকরণে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও এখন পর্যন্ত তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাত্র ৫৪৯ প্যাকেট কনডম বিতরণে সক্ষম হয়েছেন।

এএফপি’র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পরিবার পরিকল্পনা তো দূরের কথা, রোহিঙ্গারা বরং পরিবারের সদস্য বাড়াতে উৎসাহী। ওই ফরাসি বার্তা সংস্থাকে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ বলেছেন, পরিবারের সদস্য বেশি হলে তারা আশ্রয় শিবিরে সংঘবদ্ধভাবে ও সুস্থভাবে টিকে থাকতে পারবেন। কারণ, সেখানে খাদ্য ও পানি সংগ্রহ নিত্যদিনের সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। পরিবারের সদস্য বেশি হলে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহের কাজটি সহজ হবে।

অনেকে আবার মনে করেন, জন্মবিরতিকরণ ব্যবস্থা ধর্মবিরুদ্ধ। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরে পরিবার পরিকল্পনাকর্মী ফারহানা সুলতানা এএফপিকে জানান, যেসব নারীর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন তাদের বেশির ভাগই বলেছেন জন্মনিয়ন্ত্রণ হলো একটি পাপ। ‘ রাখাইনে থাকা অবস্থায় রোহিঙ্গারা পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক ক্লিনিকে যাননি। তাদের ভয়, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ তাদেরকে এমন ওষুধ দিতে পারে, যাতে তাদের না হয় তাদের সন্তানদের ক্ষতি হবে’, জানান সুলতানা। তবু রোহিঙ্গা নারীদের কাছে জন্মনিয়ন্ত্রণের সুবিধা বোঝানোর চেষ্টা করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা।

সবুরা নামে এক রোহিঙ্গা নারীর সাত সন্তান। তিনি বলেছেন, তার স্বামী বিশ্বাস করেন, তাদের বিশাল একটি পরিবার থাকবে। সবুরার ভাষায়, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু তিনি এ ব্যবস্থা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তাকে দুটি কনডম দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা ব্যবহার করেননি। আমার স্বামী বলেছেন, আমাদের অনেক বেশি সন্তান প্রয়োজন। আমাদের জমিজমা ও সম্পদ আছে (রাখাইনে)। সন্তানদের খাবার দেওয়া নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কিছু নেই।’

কেউ কেউ আবার গর্ভাবস্থাকে ইতিবাচক মনে করেন নিপীড়ন থেকে বাঁচতে। বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে কাজ করা মানবাধিকারকর্মীরা এএফপিকে জানিয়েছেন, গর্ভাবস্থায় তাদের ওপর সামরিক নিপীড়নের সুযোগ কম থাকে। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর সূত্রকে উদ্ধৃত করে এএফপি জানিয়েছে, বাংলাদেশে গর্ভাবস্থায় থাকা রোহিঙ্গার সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এরইমধ্যে সন্তান জন্ম দিয়েছেন ৬শ’ জন।

জন্মবিরতিকরণে উৎসাহ দেওয়া ব্যর্থ হওয়ার কারণে বিকল্প উদ্যোগের কথা ভাবছে কক্সবাজার জেলার পরিবার পরিকল্পনা দফতর। সরকারের কাছে আহ্বান জানিয়েছে সেখানে স্টেরলাইজেশন প্রক্রিয়া (স্থায়ী/অস্থায়ী বন্ধ্যাকরণের বিকল্প এক পদ্ধতি) চালু করার। পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য এএফপিকে বলেছেন, নারীদের জন্য টিউবেকটমি এবং পুরুষদের জন্য ভ্যাসেকটমি পদ্ধতি প্রয়োগের মাধ্যমে জন্মনিয়ন্ত্রণের সুপারিশ করেছেন তারা।

এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণভাবে ভ্যাসেকটমি ও টিউবেকটমি পদ্ধতি (স্টেরলাইজেশনের দুই প্রক্রিয়া) সফলতার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ভ্যাসেকটমি পদ্ধতিতে পুরুষের শুক্রানু নারীর ডিম্বানুতে প্রবেশের পথ বন্ধ করা হয়। ফলে ডিম্বাণু শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হলে এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি। আর টিউবেকটমি হলো জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী এক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে অপারেশনের সাহায্যে নারীর ডিম্ববাহী নালীর কিছু অংশ বেঁধে কেটে ফেলে দিয়ে বা নালীপথ ক্লিপ/রিং দিয়ে আটকিয়ে দেওয়া হয়।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে একজন পুরুষের একাধিক বিয়ের নজির রয়েছে। ভট্টাচার্য মনে করেন, স্টেরিলাইজেশনই জন্মনিয়ন্ত্রণের সব থেকে ভালো পদ্ধতি। ‘যদি একজন পুরুষকে স্টেরিলাইজড করা হয়, সে ৪/৫বার বিয়ে করেও আর সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হবে না।’ তবে রোহিঙ্গাদের এতে উদ্বুদ্ধ করার কাজটি খুব সহজ হবে না বলে জানিয়েছেন তিনি। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের জন্মবিরতিকরণে কাজ করছেন, এমন সবাই এএফপিকে একই মত দিয়েছেন।

 

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

Exit mobile version