রোহিঙ্গা নিধনে রাজি না হওয়ায় হিন্দুদের হত্যা করছে মিয়ানমার সৈন্যরা

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে এ পর্যন্ত আট শতাধিক হিন্দু আরকান ছেড়ে বাংলাদেশের উখিয়ায় অবস্থান নিয়েছেন। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মতো তারাও নৃশংসতার স্বীকার হয়ে বাংলাদেশে আসছেন বলে জানালেও কিছু সূত্রে ভিন্ন তথ্য মিলেছে। সূত্র মতে, সৈন্যরা হিন্দু যুবকদের রাখাইন যুবকদের সাথে তাল মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নির্যাতন ও জবাইয়ে অংশ নিতে বাধ্য করছে। আর কেউ তাতে রাজি না হলেই তাকে হত্যা করছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্যমতে, রাখাইন রাজ্যেও মংডু জেলার গ্রাম ফকিরা বাজার, রিকটা, চিয়ংছড়িসহ কয়েকটি এলাকায় অন্তত ৮৬ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই যুবক। আরো অনেকে ইতিমধ্যে হত্যার স্বীকার হতে পারে। আর এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে আটশতাধিক হিন্দু। যাদের একটি অংশ কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের লোকনাথ মন্দির ও সংলগ্ন একটি ফার্মের খালি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। আরো শতাধিক হিন্দু পরিবার সীমান্তের ওপারে কাছাকাছি এলাকায় আটকে আছে।

হিন্দুদের কেন নির্যাতন : এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবর মতে, রাখাইনের এবারের নৃশংসতার পুরোটাই মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর। তাহলে কেন হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। অনুপ্রবেশকারী কয়েকজন রোহিঙ্গা ও হিন্দুর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সেখানকার ‘টাটমাডো’  (সৈন্য) নিজেরা রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের পাশাপাশি রাখাইন যুবকদেরও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন করাচ্ছে। আর এই হিন্দু যুবকদেরও একাজে যুক্ত করতে চাইছে। সৈন্যরা তাদের অস্ত্রও সরবরাহ করছে, জবাই করতে বলছে, রোহিঙ্গাদের ঘরে আগুন দিতে বলছে। গুটিকয়েক হিন্দু প্রাণভয়ে এতে রাজি হলেও বেশিরভাগই তা করতে অসম্মতি জানাচ্ছেন। আর যারা মানেন নি তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, নারী ও স্ত্রীদের নির্যাতন করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে চলে যাওয়ার শর্তে অনেককে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

হংকংভিত্তিক কমিউনিটি সাইট মুসলিম কাউন্সিলর অফ হংকং তাদের ওয়েবসাইটে দাবি করেছে, এরকম অনেক হিন্দু যুবককে সেনাবাহিনী তাদের সাথে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযানে যোগ দিতে জোর দিচ্ছে। কেউ রাজি না হলে তাকে রোহিঙ্গাদের পরিণতি বরণ করতে হচ্ছে। তাদেরও রোহিঙ্গাদের মতো গুলি করে হত্যা করছে, ঘরে আগুন দিচ্ছে, কয়েকজন নারীকেও ধরে নিয়ে গেছে।

ফকিরা বাজার এলাকা থেকে আসা স্বপ্না রানী নামের একজন অনুপ্রবেশকারী ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, তার স্বামীকে সেনাবাহিনী ডেকে নিয়েছিলো। কিন্তু কি কারণে ডেকেছে তিনি তা জানেন না। দুইদিন ধরে স্বামী ফিরেননি। তৃতীয় দিন অর্থ্যাত্ ৪ সেপ্টেম্বর সৈন্যরা তাদের পাশের একটি রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন দেয়। পরে তাদের বাড়ির দিকে আসতে দেখে ভয়ে বাড়ির পেছনে চলে যান। খানিক পরেই সৈন্যরা তাদের ঘরে আগুন দেয়। পরে গ্রামের অন্য রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাথে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। এর আগেও ২৭ ও ২৮ আগস্ট বেশকিছু হিন্দু বাড়িতে আগুন দেয়ার খবর শুনেছেন বলে জানান তিনি।

স্বপ্নার মতো এরকম বেশকিছু নারী কুতুপালংয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের একজন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা অনিকা ধর এসেছেন রাথিডং এলাকা থেকে। তিনি জানান, তার পরিবারের আট সদস্যের সকলকে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। পরে গ্রামের অন্যদের সাথে এপারে এসে পৌঁছান। এপারে আসতে রোহিঙ্গারা তাকে সাহায্য করেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি রানা দাশগুপ্ত হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের সাথে কথা বলে জানিয়েছেন, একজন হিন্দু নারী অল্প কিছুদিন আগে তার বাবা মাকে হারায়। এরমধ্যেই তার স্বামীকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়। কারণ, সে মুসলিমদের জবাই করতে চায়নি।

রোহিঙ্গা এক্টিভিস্ট রো ন্যা সান লুইনও বলছেন, এই কারণেই বেশকিছু হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তিনি নিহতের প্রকৃত সংখ্যা ৮৬ জন হবে কিনা তা নিশ্চিত নন বলে জানান।

চমেকে আরো চার রোহিঙ্গা : মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত আরও চার রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সোমাবর দিবাগত রাতে তাদের ওই হাসপাতালে নেয়া হয়। চমেক পুলিশ ফাঁড়িতে দায়িত্বরত এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার জানিয়েছেন, মংডুর সোহাগপাড়ার নুর হোসেনের ছেলে মোঃ তাহের, শফিরনের ছেলে ইমাম ফরিদ, আবদুল জামানের ছেলে শওকত উল্লাহ ও নবী হোসেনের ছেলে আবদুল করিমের শরীরে গুলি লেগেছে। তাদের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। এর আগে সোমবার রাত ১০টার দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত সাংগানা পীরখালি এলাকার আবদুল শফির মেয়ে মরিয়মকেও চমেকে ভর্তি করা হয়।

১৬২ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন : গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৬২ জন রোহিঙ্গার বায়োমেট্রিক নিবন্ধন শেষ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এর মধ্যে গতকাল ১৫০ জনের নিবন্ধন করা হয়, আগের দিন ১২ জনের। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য সেলের সদস্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট একেএম লুত্ফুর রহমান ইত্তেফাককে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের কারণে আজ নিবন্ধন কাজ বন্ধ ছিল। এছাড়াও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে দ্রুততার সাথে নিবন্ধন করা যাচ্ছে না। কেবল একটি বুথেই সন্ধ্যার দিকে অল্প সময় নিবন্ধন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়িয়ে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কাজ জোরদার হবে বলে জানান তিনি।

বন্ধ হয়নি নৃশংসতা : সারা বিশ্বের অব্যাহত চাপের মধ্যেও মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাদের নৃশংসতা বন্ধ করেনি। তারা এখনো গ্রামের পর গ্রামে আগুন দিচ্ছে। রোহিঙ্গাশূন্য এলাকাগুলোতেও তারা বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। গতকাল দুপুরে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ থেকে নাফ নদীর অপর পার্শ্বের মংডুর মেরুন্ডপাড়া গ্রামের দুটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এপার থেকে তা স্পষ্ট দেখা যায়। শাহ পরীর দ্বীপের স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত সোমবার আছর আজানের একটু আগেও কয়েকটি বাড়ি থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উড়তে দেখা যায়। আর ভীতসন্ত্রস্ত অনেক রোহিঙ্গা এখনো জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে ঢুকছেন। গতকাল সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শাহ পরীর দ্বীপ হয়ে অন্তত ৮ হাজার রোহিঙ্গাকে টেকনাফে অনুপ্রবেশ করতে দেখা গেছে।

 

(সূত্র: আজহার মাহমুদ, ইত্তেফাক)

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন