parbattanews

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কঠিন করে তুলছে মিয়ানমার

সীমিত পরিসরে হলেও এ বছরই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করতে চায় বাংলাদেশ। কিন্তু জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির আগে প্রত্যাবাসন শুরু করার ভাবনাকে সমর্থন করে না। তাদের প্রত্যাশা, আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, সম্মানজনক ও টেকসই।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চুক্তি করেছে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিবেশ মিয়ানমার সৃষ্টি করছে না। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী পরিচালিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রাখাইনসহ বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ চলছে। অনেক স্থান সেনাবিরোধী বা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে। এমন প্রেক্ষাপটে আজ ২৪ আগস্ট মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা-ঢলের পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা নিয়ে বড় ধরনের আর্থ-সামাজিক চাপে আছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত রবিবার ঢাকায় মিয়ানমারের নাগরিকবিষয়ক টাস্কফোর্সের বৈঠকশেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা আশা করছি, এ বছরের শেষ নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু হবে। তারা (রোহিঙ্গারা) আমাদের জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে। ’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে কূটনৈতিক পর্যায়েও। আবার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে এখনই প্রত্যাবাসন সমর্থন করছে না তার ইঙ্গিতও মিলেছে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেতের সদ্যঃসমাপ্ত ঢাকা সফরে। গত ১৭ আগস্ট ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘এই মানুষগুলো চরম সহিংসতা ও পদ্ধতিগত বৈষম্যের শিকার হয়ে পাঁচ বছর আগে পালিয়ে এসেছে। এটি সাম্প্রতিক ইতিহাসে মানব সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় স্থানান্তর। শিবিরগুলোতে নারী, তরুণ-তরুণী, ধর্মীয় নেতা ও অন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার সময় আমি যেটুকু শুনেছি, তাতে তাদের মনের যে আশা প্রতিভাত হয়েছে তা হলো তারা মিয়ানমারে তাদের গ্রামে ও বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে। তবে পরিস্থিতি অনুকূল হলেই তা সম্ভব হবে। ’

বিশ্বব্যাপী সংকট বিশ্লেষণকারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) বলছে, অদূর ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। আইসিজির মিয়ানমার ও বাংলাদেশ বিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক থমাস কিন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০১৭ সালে মিয়ানমারের যে জেনারেলদের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন চালানো হয়েছে, সেই জেনারেলরাই এখন মিয়ানমারের রাষ্ট্রক্ষমতায়। তাঁরা ক্ষমতায় থাকাকালে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করবে না। ’

থমাস কিন বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য এখন একক নিয়ন্ত্রণে নেই। কোথায়ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আবার কোথাও আরাকান আর্মি বা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশির ভাগ রোহিঙ্গার জন্যই কঠিন।

রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ তৈরি করতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ প্রকাশ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। ভারত, চীন, জাপানসহ এশিয়ার দেশগুলোরও সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ। চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে কয়েক দফা ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হলে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে তা বন্ধ আছে। মিয়ানমারে সংঘটিত গুরুতর অপরাধের তথ্য উপাত্ত, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং বিচারিক কাঠামোকে তা সরবরাহে কাজ করছে জাতিসংঘ গঠিত কাঠামো ‘ইনডিপেনডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম)’। ওই কাঠামোর প্রধান নিকোলাস কৌমজিয়ান বলেছেন, ‘রোহিঙ্গারা নিরাপদে ও সম্মানজনকভাবে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ জানাচ্ছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ করা ব্যক্তিদের ও তাদের ওপর নৃশংসতার বিচার না হলে ওই লক্ষ্য পূরণ (মিয়ানমারে ফেরা) খুব কঠিন হবে। ’

আগামী মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে উত্থাপনের জন্য আইআইএমএম যে প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাতে বলা হয়েছে, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর বেসামরিক জনগণের ওপর ব্যাপক ও ধারাবাহিকভাবে হামলার অসংখ্য ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সম্ভাব্য অপরাধের ধরনও বিস্তৃত হচ্ছে।

বাড়ছে সংকট, বাড়ছে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির চাপ:
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার বৃদ্ধির জন্য সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে। বিশেষ করে, পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, জীবিকা ও চলাফেরার সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তুলছে। আবার এ দেশে রোহিঙ্গা শিবিরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখাও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের একাংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের উচ্চ জন্মহার মোকাবেলায় জন্ম নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম গ্রহণ করতে সরকার জাতিসংঘকে অনুরোধ জানিয়েছে।

মিয়ানমারের অস্বীকার, বিদেশে বিচারিক প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি:
রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত গুরুতর অপরাধের বিষয়টি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কার্যত অস্বীকার করলেও আন্তর্জাতিক জবাবদিহির উদ্যোগে অগ্রগতি আছে। তবে এই প্রক্রিয়া বেশ সময়সাপেক্ষ। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর জেনোসাইড চালানোর মামলা গ্রহণ করেছে এবং মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করে দিয়েছে। মামলার বাদী গাম্বিয়া আইসিজেতে রাষ্ট্র হিসেবে মিয়ানমারের জবাবদিহি নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) কৌঁসুলির দপ্তর রোহিঙ্গা নিপীড়নের হোতা ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে। বিচারপ্রক্রিয়া চলছে আর্জেন্টিনার ফেডারেল আদালতেও।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গাদের সংগঠন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের (ব্রুক) সভাপতি তুন খিন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের কাছে তাঁরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে ফেরা কঠিন। তিনি বলেন, এ দেশে রোহিঙ্গাদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবেলায় চাহিদার তুলনায় জোগান কম:
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ বছর রোহিঙ্গাসংকটে সাড়াদান পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ৮৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রয়োজন। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ৪২ কোটি ৬২ লাখ মার্কিন ডলার জোগান দিয়েছে। এটি প্রত্যাশিত তহবিলের মাত্র ৪৯ শতাংশ।

ইউএনএইচসিআরের মুখপাত্র শাবিয়া মানতো বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা যাতে আর বাস্তুচ্যুত না হয়, সে জন্য বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এ জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক সংলাপ এবং কূটনৈতিক সম্পৃক্ততা আরো জোরদার করতে হবে।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মহাসচিব কাজী শফিকুল আজম বলেন, এটি এরই মধ্যে একটি জটিল এবং দীর্ঘায়িত বাস্তুচ্যুতি সংকটে পরিণত হয়েছে। এ জন্য রোহিঙ্গা শিবির ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্তমানে চলমান কার্যক্রম সমন্বয় করে একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

সূত্র: কালের কন্ঠ
Exit mobile version