parbattanews

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় ক্যাম্পে বাড়ছে অপরাধ: আতঙ্কিত স্থানীয়রা

গত ৫ বছর পূর্বে এক কাপড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে আজ কোটিপতি। ইয়াবা, মাদক, অস্ত্র, স্বর্ণ চোরাচালান তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। এসব ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গড়ে উঠেছে একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ। এই সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো ক্যাম্পে প্রতিনিয়ত নানা ধরনের অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। এতে ক্যাম্পে তৈরী হচ্ছে অস্থিরতা।

বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় রোহিঙ্গারা দিন দিন বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ায় লাম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হয় রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) চেয়ারম্যান মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে মাসে ২২ অক্টোবর ১৮ নম্বর ক্যাম্পে দুর্বৃত্তরা একটি মাদ্রাসায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে গুলি করে হত্যা করে শিক্ষকসহ ৬ জন মাদ্রাসা ছাত্রকে। এই ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গাদের মাঝে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, এটি কাটতে না কাটতে গত ১ আগস্ট বিকেলে মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নুরুল আমিন (২৬) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক খুন হয়। সে ক্যাম্প-৪ এক্সটেনশনের ‘আইচ ব্লকের আবু শামার ছেলে। এরপর ১০ আগস্ট উখিয়ার থাইংখালী ১৫ নম্বর শিবিরের সি-৯ ব্লকের হেড মাঝি আবু তালেব (৪০) এবং সি/৯ সাব ব্লকের মাঝি সৈয়দ হোসেন (৩৫)কে হত্যা করে।

এর আগে গত ২২ জুন আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং তার আগে ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১০ জুন কুতুপালংয়ের ৪ নম্বর ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ সমিন (৩০) এবং ৯ জুন রোহিঙ্গা নেতা আজিম উদ্দিনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানাউল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬) নামে এক স্বেচ্ছাসেবক। এর এক সপ্তাহের ব্যবধানে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কথিত আরসার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হাসিমের সহযোগী মো. শাহকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পে একেরপর এক হত্যাকাণ্ডের কারণে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের মাঝেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।

আব্দুল আমিন (৪৫) নামের ১৮ নাম্বার ক্যাম্পের আশ্রিত এক রোহিঙ্গা বলেন, ‌‘কিছু কিছু রোহিঙ্গা টাকার লোভে পড়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড সংঘটিত করছে। এতে পুরো রোহিঙ্গার দুর্নাম হচ্ছে। আমরা যারা সাধারণ রোহিঙ্গা রয়েছি, আমাদের দাবি এসব দুষ্কৃতিকারী রোহিঙ্গাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।’

বালুখালী ১১নাম্বার ক্যাম্পের পাশে বসবাসরত স্থানীয় আবু তাহের বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যদি এভাবে এখানে আরও কয়েক বছর থাকে তাহলে স্থানীয়দের জীবন হুমকির মুখে পড়বে। কারণ কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়ার মাদক ও চোরাকারবারিরা অনেকেই মাদক, ইয়াবা ও মানব পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধে রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে।’

সে আরও বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের হাতে যেভাবে কাঁচা টাকা আসছে এতে তারা ক্যাম্পের বাইরে বাংলাদেশিদের সহযোগিতা নিয়ে জমিজমা কিনে ঘরবাড়ি করছে। দিনে দিনে তারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অনেকে বাংলাদেশি নাগরিক পরিচয় দেওয়ার জন্য টাকার বিনিময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বানাচ্ছে। যা আমাদের দেশের জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে দাড়িয়েছে।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জহিরুল ইসলাম প্রকাশ সোনা আলী বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের কারণে আমরা নিরাপত্তার হুমকিতে রয়েছি। তাদের কারণে এখানে কোনো স্বাভাবিক জীবন নেই। পদে পদে আমরা চেকিংয়ে পড়ছি। আর তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে মাদক কারবারিরা। তারা ইয়াবা ও মাদক পাচার করে। আগামীতে আমাদের সন্তানদের নিয়ে টেনশনে আছি।’

স্থানীয়দের দাবি, রোহিঙ্গাদের দ্রুত তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হয় তাদের এখান থেকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে হবে। না হলে পুরো কক্সবাজার নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, দিন যত যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ততই বাড়ছে। এর মধ্যে ক্যাম্পে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) অন্তত সাত-আটটি গ্রুপ সক্রিয়। এতে মিয়ানমারের ইন্ধনও রয়েছে। মিয়ানমার থেকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহযোগিতাও করা হচ্ছে একটি সূত্রে জানিয়েছেন।

উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘২০১৭ থেকে ২৫ আগস্টের পর হতে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত উখিয়া থানায় ৭৬টি হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। এ ঘটনায় ১৭৪ জন সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এছাড়াও ডাকাতির প্রস্তুতি মামলায় গত পাঁচ বছরে ৫৫টি মামলা হয়েছে উখিয়া থানায়, আসামি গ্রেফতার করা হয়েছে ৪৭৬ জন। পুলিশের আন্তরিকতা ও দায়িত্বশীলতার কারণে তা সক্ষম হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, রোহিঙ্গারা খুনোখুনি, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এবং ধর্ষণসহ অন্ততপক্ষে ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তবে বর্তমানে ক্যাম্পের সার্বিক পরিস্থিতি অতিতের তুলনায় অনেক ভালো রয়েছে।’

ক্যাম্পে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. কামরান হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য রাতে বেলায় ভলান্টিয়ার দিয়ে স্বেচ্ছায় পাহারার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এরপরেও কিছু কিছু দুষ্কৃতিকারী ক্যাম্পে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি এসব অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার জন্য। ’

এ বিষয়ে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসুদ্দোজা নিকট জানার জন্য একাধিক ফোন করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, গত ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার সামরিক জান্তার নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হয়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল চার লাখ। গত কয়েক বছরে এ সংখ্যা বেড়ে দাড়িয়েছে ১২ লাখের মতো।

 

Exit mobile version