তথ্য গোপন ও অর্থের বিনিময়ে বান্দরবান ও কক্সবাজারে অর্ধলক্ষাধিক রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির পথে
নুরুল আলম সাঈদ, নাইক্ষ্যংছড়ি:
পার্বত্য বান্দরবান জেলার চার উপজেলা ও কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত আট উপজেলায় চলমান ভোটার হালনাগাদে রোহিঙ্গারা কৌশলে তথ্য গোপন করে অর্থের বিনিময়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্তির অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে ।
জানা যায়, রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) অর্থায়নে ও রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় চলমান ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রম -২০১৪ মায়ানমার সীমান্তের রোহিঙ্গা অধ্যূষিত বাংলাদেশের বান্দরবান পার্বত্য জেলার বান্দরবান সদর, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলীকদম, লামা উপজেলা ও পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা অধ্যুষিত টেকনাফ, উখিয়া, রামু, চকরিয়া, কক্সবাজার সদর, কুতবদিয়া, পেকুয়া ও মহেশখালী উপজেলায় রোহিঙ্গারা দলে দলে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভোটার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভূক্তি করছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় ।
রোহিঙ্গা নাগরিকদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির জন্য সীমান্তের বিচ্ছন্নতাবাদী সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) নেতারা তোড় জোড় চালাচ্ছে বিগত দুই মাস ধরে । এর অংশ হিসেবে তাদের প্রবীণ নেতাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক ও বসে । বর্তমানে এসব উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার রোহিঙ্গা নাগরিকদের নগদ অর্থ এবং প্রতিটি মসজিদ, মাদ্রাসায় ইফতার ও ঈদ সামগ্রী বিতরণ করছে প্রতিনিয়ত । রোহিঙ্গারা ভোটার তালিকায় নিজ নাম অর্ন্তভূক্তিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায় । ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভূক্তির জন্য অর্থের যোগান দিচ্ছে আরএসও নামের সংগঠনটি । বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ’র টাকার বিনিময়ে ভোটার হয়েছেন হাবিবা বেগম পিতা- আবুল কালাম স্বামী আব্দূল হান্নান ,মাহাবুবা বেগম স্বামী-জাহাঙ্গীর আলম,সেতারা বেগম পিতা-শফি উল্লাহ আর্দশ গ্রাম,জসিম উদ্দিন পিতা- ছৈয়দ আলম প্রকাশ কালু ,মরিয়ম বেগম স্বামী-আব্দু রাজ্জাক তার নাম ভোটার তালিকায় মৃত দেখানো হয়েছে বর্তমানে জীবিত আছেন । এছাড়া স্বামী ও মা-বাবা ভোটার হয়নি ।
অবৈধ পন্থায় সরকার দলীয় নেতাদের হস্তক্ষেপে ভোটার গননাকারী শিক্ষক সাইফুল ইসলাম এসব রোহিঙ্গাদেরকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তি করেছেন । জানা যায়, ২নং ওয়ার্ডের গননাকরী সাইফুল ইসলামও রোহিঙ্গা নাগরিক । এছাড়া মমতাজ বেগম স্বামী-শামসুল আলম, নুরুল হাকিম পিতা-নুর মোহাম্মদ বিছামারা, মো. ছাদেক পিতা-মো. ইউনুছ, ছৈয়দ হোসেন পিতা-ঠান্ডা মিয়া, মনোয়ারা বেগম স্বামী-আলমগীর, জান্নাতুল ফেরদৌস স্বামী নুরুল আলম, জসিম উদ্দিন পিতা নুর মোহাম্মদ এসব ব্যক্তির পিতা-মাতা ,স্বামী,চাচা, ফুফু পূর্বে ভোটার তালিকায় নাম না থাকলেও সরকার দলীয় গুটি কয়েক নেতা-কর্মী, গণনাকারী , সুপারভাইজার ও নাইক্ষ্যংছড়ি নির্বাচন অফিসার মাইনুল হককে মোটা অংকের টাকা দিয়ে নিজের নাম ভোটার তালিকায় অর্ন্তভূক্তি করেছেন বলে বান্দরবান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বরাবরে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হামিদা চৌধুরী টাকা নিয়ে ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গা নাগরিক অর্ন্তভূক্তি না করতে এবং প্রকৃত বাংলাদেশীদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির জন্য নির্বাচন অফিসারকে আহবান জানালে তিনি এই বক্তব্যকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে, একটি ষড়যন্ত্রকারী মহল ও রোহিঙ্গা আরএসও নেতাদের ইন্ধনে বিভিন্ন মাধ্যমে তাকে অপদস্ত করা হয়েছে বলে বক্তব্য প্রদান করে আসছে ।
এ বিষয়ে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন বলেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সব মানুষের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নষ্ট করার জন্য একটি কু-চক্রী মহলের হয়ে তিনি এই অপচেষ্টা চালাচ্ছে । তার সাথে আমার কোন কথা কাঁটাকাঁটি হয়নি ।
এ বিষয়ে উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হামিদা চৌধুরী বলেন, আমি জনপ্রতিনিধি , আমার কাছে কোন মানুষ আসলে আমি সুপারিশ করি, এটি আমার দোষ । নির্বাচন অফিসারের সাথে আমার কোন তর্কাতর্কি হয়নি ।
জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের প্রথম ও দ্বিতীয় দফা ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহকারীদের সংগৃহীত সর্বশেষ রেকর্ড পত্রাদি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গঠিত বিশেষ কমিটির যাচাই-বাছাই ও ছবি তোলার কার্যক্রম চলছে । এদিকে নির্বাচন কমিশনের নানা শর্তের বেড়াজালে আটকা পড়ে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলার ভোটার হওয়ার উপযোগী প্রায় ২০ হাজার জনসাধারণ তথ্য ফরম সংকটের কারণে ভোটার হতে পারেনি।
অথচ নির্বাচন কমিশনের বিশেষ কড়াকড়িতে হাজার হাজার অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা কৌশল পাল্টিয়ে বান্দরবান, কক্সবাজারসহ বিশেষায়িত ১৪ উপজেলাকে এড়িয়ে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোটার হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্বাচন কমিশনের তফসীল অনুযায়ী বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় ১৫ জুন থেকে ২৪ জুন পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে ভোটার হাল নাগাদ তথ্য সংগ্রহের কাজ চলে। এ সময় মোট ভোটারের শতকরা ৫ শতাংশ হারে তথ্য ফরম তথ্য সংগ্রহকারীদের নিকট সরবরাহ দেওয়ায় এখানে ফরম সংকট থাকা সত্বেও নির্বাচন অফিস থেকে চাহিদা অনুপাতে ফরম সরবরাহ না দেওয়ায় প্রায ২০ হাজার ভোটার উপযোগী লোক ভোটার হতে পারেনি। উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের পাতাবাড়ী গ্রামের দুবাই প্রবাসী নুরুল আমিন কাগজ পত্র সব কিছু জোগাড় করে তথ্য সংগ্রহকারীর নিকট জমা দিতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ফরম সংকটের কারণে ভোটার হতে পারছে না বলে জানান।
রত্নপালং ইউনিয়নের ডিগ্রী দ্বিতীয় বর্ষের অধ্যয়নরত ছাত্র মোহাম্মদ আবু ফয়সালসহ অনেক ছাত্র অভিযোগ করে বলেন, দেশের অন্যান্য এলাকার চেয়ে উখিয়ায় ভোটার হওয়া খুবই জটিল ব্যাপার। নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের শাকিলা রায়হান বলেন, আমার বয়স হওয়ার পর অদৃশ্য কারণে ভোটার হতে পারিনি । নাইক্ষ্যংছড়ির নির্বাচন অফিসার মাইনুল হক বলেন, অনেক রোহিঙ্গা এদের মাঝে প্রকৃত বাংলাদেশী নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাড়িয়েছে । তবুও এলাকার জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের সহায়তায় কোন ভাবে শেষ করেছি । শেষ পর্যন্ত ভোটার হালনাগাদ বিষয়ে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি ।
উখিয়া অতিরিক্ত উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম মিয়া বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে সব আবেদনকারী নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুপাতে প্রয়োজনীয কাগজপত্র সহ আবেদন করতে সক্ষম হয়েছে সে ধরনের ৫ হাজার ৩শ ৪৩টি ফরম তথ্য সংগ্রহকারীরা পূরণ করে জমা দিয়েছেন। এ সময় তথ্য সংগ্রহকারীরা ২৭৫জন মৃত ভোটার ও প্রায় ৪শ জন স্থানান্তরকরণের আবেদন ফরম জমা দিয়েছেন।
কক্সবাজারের ৮ উপজেলা, পার্বত্য বান্দরবানের ৪ উপজেলা ও পাবর্ত্য রাঙ্গামাটির ২ উপজেলাসহ ১৪উপজেলাকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাসহ বিদেশী নাগরিক ভোটার তালিকায় অর্ন্তভুক্তির আশংকায় বিশেষায়িত ঘোষনা করা হয়। উল্লেখিত ১৪ উপজেলায় ভোটার হতে আগ্রহী উপযুক্ত লোকজনদের বাবা, মা, চাচা, ভাই, ফুফুর জাতীয় পরিচয় পত্র, জমির খতিয়ান, জন্ম নিবন্ধন, জাতীয়তা সনদ, বিদ্যুৎবিলসহ ১৩ প্রকারের তথ্য প্রমাণাদি তথ্য সংগ্রহকারীদের নিকট প্রদান পূর্বক ফরম পূরণের নির্দেশনা রয়েছে। এসব তথ্য সংশ্লিষ্ট কাগজ পত্র যেসব আবেদনকারী জমা দিতে সক্ষম হয়েছে শুধু মাত্র তারাই ভোটার হতে পারবে বলে নির্বাচন অফিস থেকে জানা গেছে।
রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরীসহ অনেক সচেতন লোকজন বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের কঠোরতা ও নানা শর্তাবলী বিদেশী নাগরিকদের বাংলাদেশের ভোটার তালিকায় অর্ন্তভূক্তিতে অনেকটা যুগোপযোগী। কিন্তু কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ, সদর, পেকুয়া, রামু, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, পাবর্ত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলী কদম, সদর ও রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ও রাজস্থলী উপজেলাকে রোহিঙ্গা প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে এসব উপজেলায় বিশেষ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
এসবের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রাম সিটিকর্পোরেশন ও জেলার বিভিন্ন উপজেলাকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা ভোটার হতে নিরাপদ ও সহজ ভেবে বিভিন্ন বাসা বাড়ীতে আশ্রয় নিয়ে কৌশলে ভোটার হয়ে যাচ্ছে। কারণ উল্লেখিত ১৪ উপজেলার বাইরে বাকী উপজেলাগুলোতে ভোটার আগ্রহী ও উপযোগী যে কেউ সহজে ভোটার হতে সক্ষম বিধায় ভূয়াঁ জাতীয়তা সনদ, জন্ম নিবন্ধনসহ সংশ্লিষ্ট কাগজ পত্রের ফটোকপি জমাপূর্বক ভোটার হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তারা এসব উপজেলায় নিবন্ধিত ভোটার ফরম ও তৃতীয় ধাপে তথ্য সংগ্রহের সময় বিশেষ নজরদারীর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী জানিয়েছেন।