parbattanews

রয়টার্সের অনুসন্ধান: ইন দিনের ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয় যেভাবে

পার্বত্যনিউজ ডেস্ক:

রয়টার্স লিখেছে, এই অনুসন্ধানে প্রথমবারের মতো বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা রোহিঙ্গাদের বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে, মুসলমানদের হত্যা করে লাশ পুঁতে ফেলার কথা স্বীকার করেছে।

কেবল উগ্রপন্থি বৌদ্ধরাই নন, বরং ইন দিনে ১০ রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞে দেশটির সেনা ও আধাসামরিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও যে জড়িত ছিলেন, তার প্রমাণ মিলেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ভাষ্যেও।

বয়োজ্যেষ্ঠ এক বৌদ্ধ গ্রামবাসী রয়টার্সকে তিনটি আলোকচিত্র দিয়েছেন, যাতে ১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সৈন্যদের হাতে ধরা পড়া থেকে শুরু করে পরদিন সকাল ১০টায় তাদের হত্যা পর্যন্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ‍মুহূর্ত ফুটে উঠেছে।

এ তদন্তের সূত্র ধরেই মিয়ানমারের পুলিশ বার্তা সংস্থাটির দুই প্রতিবেদক ওয়া লোন এবং কিয়াও সোয়ে ও’কে রাখাইন সংশ্লিষ্ট গোপন নথি হাতানোর অভিযোগে গত ১২ ডিসেম্বর গ্রেপ্তার করে।

এর মাসখানেক পর ১০ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর বিবৃতিতে ইন দিনে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার খবর নিশ্চিত করা হয়।

যদিও সেনাবাহিনীর ভাষ্যের সঙ্গে রয়টার্সের তদন্তে উঠে আসা তথ্য এবং রাখাইনের প্রত্যক্ষদর্শী মুসলিম ও বৌদ্ধদের কথায় গরমিল পাওয়া গেছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলছে, যে ১০ রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে তারা ‘২০০ সন্ত্রাসীর’ অংশ, যারা নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছিল।
অন্যদিকে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা বলছেন, ইন দিনে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর বিদ্রোহীদের আক্রমণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

উল্টো সেনারাই কাছাকাছি একটি সমুদ্রসৈকতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে ১০জনকে তুলে নিয়ে হত্যা করে বলে দাবি প্রত্যক্ষদর্শীদের।

পরিস্থিতির শুরু গত বছরের ২৫ অগাস্টে, যেদিন রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা উত্তর রাখাইনের ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও সেনা ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। নিরাপত্তার ভয়ে তখনই ইন দিনের কয়েকশ বৌদ্ধ গ্রামবাসী কাছাকাছি একটি মঠে আশ্রয় নেয়।

২৭ অগাস্ট মিয়ানমারের তেত্রিশ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের প্রায় ৮০ সেনা গ্রামটির দখল নেয়।

ওই ডিভিশনের প্রধান বৌদ্ধ গ্রামবাসীদের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশ নেওয়ার আহ্বান করেন বলে ইন দিনের পাঁচ বৌদ্ধ পরে রয়টার্সকে জানান।

সেনাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কজন স্বেচ্ছাসেবী হন, যাদের মধ্যে বৌদ্ধ ‘নিরাপত্তা দলের’ সদস্যরাও ছিলেন। পরের কয়েকদিন ওই স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা ইন দিনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বেশিরভাগ বাড়িই পুড়িয়ে দেন বলে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা জানান।

এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই সময়ে তিনি তার কমান্ডারের কাছ থেকে ‘যাও এবং পরিষ্কার কর’ এমন মৌখিক নির্দেশ পান; রোহিঙ্গাদের পুড়িয়ে দিতেই কর্মকর্তা এ নির্দেশ দিয়েছিলেন বলেও মনে করেন তিনি।

দ্বিতীয় আরেক পুলিশ কর্মকর্তা ইন দিনের উত্তরের গ্রামগুলোতে এ ধরণের বেশ কয়েকটি অভিযানে অংশ নেওয়ার কথা জানান। সে সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বেসামরিকদের মতো শার্ট ও শর্টস পরে গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন বলেও ওই কর্মকর্তা এবং ইন দিনের বৌদ্ধ প্রশাসক মং থেইন চায়ে নিশ্চিত করেছেন।

রোহিঙ্গারা ইন দিন থেকে পালিযে গেলে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা তাদের মুরগি ও ছাগল লুট করে নেয়। সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র যেমন মোটরসাইকেল ও গরু লুট করে সেগুলো এইটথ সিকিউরিটি পুলিশ ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার নিজের কাছে রাখেন এবং পরে বিক্রি করে দেন বলে জানান গ্রাম প্রশাসক ও পুলিশ কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ওই ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার থান্ট জিন ও’কে ফোন করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। পুলিশের মুখপাত্র কর্নেল মায়ো থু সোয়ে জানান, পুলিশ লুটের অভিযোগ তদন্ত করবে।

· রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে আগুন দিতে সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক পুলিশ ইন দিন ও কাছের আরও দুটি গ্রামের বৌদ্ধদের সংগঠিত করে বলে বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা নিশ্চিত করেছেন।

· আধাসামরিক পুলিশের তিন কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক রাজধানী সিটুই-র গোয়েন্দা বিভাগের এক পুলিশ কর্মকর্তা ইন দিনের রোহিঙ্গা পল্লী ‘নিশ্চিহ্ন’ করার আদেশ সেনাবাহিনীর ওপর মহল থেকে নিচের দিকে এসেছিল বলে জানিয়েছেন।

· ইন দিনের বৌদ্ধ প্রশাসক ও আধাসামরিক এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, আধাসামরিক পুলিশের কিছু সদস্য রোহিঙ্গাদের গরু ও মোটর সাইকেল লুট করে পরে সেগুলো বিক্রি করেন।

সেপ্টেম্বরের ১ তারিখের মধ্যে কয়েকশ রোহিঙ্গা নিকটবর্তী সমুদ্রসৈকতে আশ্রয় নেয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, যাদের মধ্যে পরে হত্যাকাণ্ডের শিকার ১০ জনও ছিলেন।

হত্যার শিকার এ রোহিঙ্গাদের পাঁচজন ছিলেন জেলে ও মাছবিক্রেতা। বাকিদের মধ্যে দুজন দোকানি, দুজন ছাত্র এবং একজন ধর্ম শিক্ষক।

রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইসলাম ধর্ম শিক্ষক আবদুল মালিক আশ্রয়স্থলের জন্য খাবার ও বাঁশ যোগাড়ে নিজের পল্লীতে গিয়েছিলেন। যখন তিনি সেখান থেকে সমুদ্রসৈকতে ফিরে আসছেন, তখনই অন্তত সাত সেনা ও সশস্ত্র বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা তাকে ধাওয়া করে।

এরপর সমুদ্রসৈকতে এসে এখান থেকে ১০ রোহিঙ্গাকে তুলে নিয়ে চলে যায়।

রয়টার্সের হাতে আসা এক আলোকচিত্রে ওইদিন সন্ধ্যায় গ্রামের পথে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা ওই ১০ রোহিঙ্গাকে দেখা যায়। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে তাদের কবরস্থানে কাছাকাছি একটি সবজি ক্ষেতের নিয়ে যাওয়া হয় বলে গ্রামবাসীরা জানান, সেখানে ফের তাদের ছবি তোলা হয়।

নিরাপত্তা রক্ষীরা ওই ১০ জনকে ইন দিনের নিখোঁজ বৌদ্ধ কৃষক মাউং নি-র ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করেন বলে রাখাইনের এক বৃদ্ধ জানান। পরে রাখাইনের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও রাখাইন গ্রামবাসীরা রয়টার্সকে বলেন, মাউং নি-র নিখোঁজের সঙ্গে এ ১০ জনের কারো কোনোরকম সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে বলে তারা জানেন না।

এরপর আটক ১০ জনকে সেনারা হত্যার জন্য নিয়ে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শী তিন বৌদ্ধ গ্রামবাসী জানান।

গোরখোদকদের একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক সোয়ে চায়ে বলেন, ধরা পড়া ব্যক্তিদের ওপর প্রথম আঘাত হানতে সেনাদলের প্রধান মাউং নি-র সন্তানদের আমন্ত্রণ জানান।
তার জ্যেষ্ঠ সন্তান ধর্ম শিক্ষক আবদুল মালিকের মাথা আলাদা করে ফেলে বলেও জানান সোয়ে। দ্বিতীয় সন্তান আরেকজনের ঘাড়ে কোপ মারেন।

রাখাইনের বয়স্ক এক নাগরিক রয়টার্সের প্রতিবেদককে হত্যাকাণ্ডের পরের একটি ছবি সরবরাহ করেন। কেন তিনি তথ্য সরবরাহের জন্য রয়টার্সকে বেছে নিলেন? উত্তরে বলেন, “এ ঘটনার বিষয়ে আমি স্বচ্ছ থাকতে চাই। ভবিষ্যতে কখনোই এরকম কিছু ঘটুক, তা চাই না আমি।”

ইন দিনে গণহত্যা নিয়ে রয়টার্সের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসা এসব তথ্য প্রমাণ বিষয়ে সরকারি মুখপাত্র জ হাতেয় বলেন, “মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আমরা অস্বীকার করছি না। কোনো অভিযোগই আমরা ফেলে দিচ্ছি না। যদি নির্যাতনের ‘শক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য প্রাথমিক প্রমাণ’ থাকে, তাহলে অবশ্যই সরকার এর তদন্ত করবে। যদি প্রমাণের সত্যতা পাওয়া যায় এবং সেখানে সহিংসতার প্রমাণ মেলে, এখনকার আইন অনুযায়ী আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।”

ইন দিনের রোহিঙ্গা পল্লী ‘নিশ্চিহ্নে, আধাসামরিক পুলিশ কর্মকর্তারা ওপর থেকে নির্দেশ পেয়েছেন এমন অভিযোগের জবাবে হাতেয় বলেন, “আমরা যাচাই করে দেখবো। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মিয়ানমারের পুলিশ বাহিনীকে জিজ্ঞেস করবো।”

আধাসামরিক পুলিশ কর্মকর্তাদের রোহিঙ্গাদের সম্পদ লুটের বিষয়টি নিয়ে পুলিশ তদন্ত করবে বলেও জানান তিনি।

বৌদ্ধ গ্রামবাসীরা রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে জানার পর দারুণ অবাক এই সরকারি কর্মকর্তা বলেন, “আমরা স্বীকার করছি যে সেখানে বিভিন্ন ধরণের অনেক অভিযোগ আছে, কিন্তু কে করেছে সেটা আমাদের যাচাই করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা বেশ জটিল।”

হাতেয়-র মুখে রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযান সমর্থনের সুরও শোনা যায়।

“কে প্রথম সন্ত্রাসী হামলা হামলা চালিয়েছে তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে। এ ধরণের হামলা ইউরোপের দেশগুলোতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে, লন্ডনে, নিউ ইয়র্কে, ওয়াশিংটনে হলে তখন গণমাধ্যম কি বলতো?,” বলেন তিনি।

 

সূত্র: bdnews24

Exit mobile version