parbattanews

লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা হাসপাতাল: কাজীর গরু কেতাবে পাঁচ, গোয়ালে শূন্য

মোবারক হোসেন, লক্ষ্মীছড়ি:

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা এই ৫টি নাগরিক মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। কিন্তু আধুনিক বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির কাছা-কাছি থেকেও মানুষের জন্য এই চিকিৎসা সেবা হাতের নাগালে পাওয়া যেন এখনো অনেকটাই কঠিন। গরীব ও অসহায় মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা সেবা পাওয়া কল্পনা বিলাস। বিশাল উপজেলা, ৩১ শয্যার হাসপাতাল, ১২লাখ টাকা মূল্যের আধুনিক যন্ত্রপাতিসহ এক্সরে মেশিন, ৫জন মেডিকেল অফিসার ছাড়াও রয়েছেন ২জন উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার। সংখ্যায় কম হলেও আছেন নার্স ও অন্যান্য কর্মচারী। প্রয়োজনীয় ওষধ সরবরাহ করছে সরকার। যদিও অনেক সময় ঔষধ না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে রোগীদের।

তবে চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি। ৩১শয্যা ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন নেই। খবর নিয়ে জানা যায়, ১জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাসহ আরো ৪জন মেডিকেল অফিসার কর্মরত আছেন। এছাড়াও আরো ১জনকে প্রায় ৭ বছর ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেপুটিশনে রাখা হয়েছে। সূত্রে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান ২০১২সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যোগদানের পর থেকেই নিয়মিত উপস্থিত থাকেন না। মেডিকেল অফিসার ডা. মাঈন উদ্দিন ২০০৬ সালের ২৭ জুলাই যোগদান করেই দ্বিতীয় বারের জন্য আর আসেন নি, তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেপুটিশনে আছেন বলে জানা গেছে।

এর পর ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ডা. ফয়েজুর রহমান, ২০১৩ সালের ১২মার্চ ডা. তৈয়বুর রহমান, একই বছরে ১৩জুন সুমন কল্যাণ চৌধুরী ও ২০জুন ডা. জান্নাতুল ফেরদাউসকে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা হাসপাতালে পোষ্টিং দেয়া হয়। দিনের পর দিন লক্ষ্মীছড়িতে না এসে রোগীদের ফাঁকি দিয়ে প্রায় উল্লেখিত ডাক্তাররা চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়ম ভর্হিভুতভাবে চিকিৎসা দিচ্ছেন। ফলে হাসপাতালে গেলে ১জন ডাক্তারের দেখাও মিলবে না। তবে সিভিল সার্জন পরিদর্শেণে আসার দিন অনেককেই দেখা যাবে। কিন্তু বাস্তবে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা চলে যাবার পর যেই সেই।
লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা হাসপাতালের পরিবেশ ও চিত্রই বলে দেয় মানুষের মৌলিক অধিকার চিকিৎসা সেবা কতটুকু পাচ্ছে রোগীরা। ৫ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলা হাসপাতলে গেলে উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার মো: দেলোয়ার হোসেন একাই রোগী দেখছেন। আর কোন ডাক্তারের দেখা গেল না। ভর্তি বিভাগে পুরুষ কোন রোগী নেই, ৩জন মহিলা রোগী আছেন। রোগীদের ওয়ার্ডে ঢুকতেই র্দুগন্ধ বেড়িয়ে এল। নার্স লাভলী দে ওয়ার্ডে আছেন তাকে জিগ্যোস করলাম এ কী অবস্থা উত্তরে বললেন, আপনি প্রথম আসলেন তো তাই গন্ধ পাচ্ছেন। এ কথায় বুঝে নিলাম এখানে যারা আছেন তারা দুর্গন্ধের সাথে অভ্যস্থ্য হয়ে পরেছেন।

জানা গেল পানি ওঠানোর পাম্প মেশিন নষ্ট। তাই পুরো হাসাপাতলে পানির ব্যবস্থা নেই দীর্ঘ দিন ধরে। মেরামতরে উদ্যোগও নেয়া হচ্ছে না। বিভিন্ন অফিস কক্ষ ও  ডাক্তার কক্ষগুলো ঘুরে দেখা গেল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমানের রুম খোলা থাকলেও তিনি নেই। আবাসিক মেডিকেল অফিসারের রুম তালা বন্ধ। প্রধান সহকারি, পরিসংখ্যানবিদ ছাড়াও আরো ক’টি কক্ষে তালাবদ্ধ দেখা যায়। ফলে জুরুরী কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না। সাংবাদিক দেখে অফিস সহকারি অনিকা চাকমা অনেকটা কৌশল করেই বললেন, কোন ডাক্তার ছুটিতে, কেউ বাহিরে, কেউ আবার আসতেছে ইত্যাদি ইত্যাদি জবাব দিলেন।

হাসপাতালে আজ ডাক্তার নেই কেন ? বা ক’জন ডাক্তার আছে এ কথা জিগ্যেস করতেই তিনি সরাসরি জবাব না দিয়ে বাহিরে একটি ডিউটি চার্ট দেখালেন। সে চার্টে দেখা গেল ডা. মো: তৈয়ব শনিবার সকাল ৮ থেকে সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত, ডা. মো: ফয়েজুর রহমান সোমবার সকাল ৮ থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮ পর্যন্ত, ডা. সুমন কল্যাণ চৌধুরী মঙ্গলবার সকাল ৮ থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮ পর্যন্ত, ডা. জান্নাতুল ফেরদাউস কনসালটেড (গাইনী) বৃহস্পতিবার সকাল ৮ থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত অত্র অফিসে উপস্থিত থেকে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার পাশাপাশি নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান কর্তৃক ২০১৩ সালের ২৬ জুন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশটির কপি প্রদান করা হয় সিভিল সার্জন খাগড়াছড়ি, চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার লক্ষ্মীছড়িকে অনুলিপি দেয়া হয়। কিন্তু এটি শুধু কাগজেই রয়ে গেছে। 

ডা. জান্নাতুল ফেরদাউস কনসালটেড (গাইনী) আনুমানিক দুপুর ১২টা ২০ মিনিট চট্টগ্রাম থেকে এসছেন। চার্ট অনুযায়ী তার বৃহস্পতিবার সকাল ৮ থেকে শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত হাসপাতালে উপস্থিত থেকে দায়িত্ব পারল করার কথা। তিনি ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে রোগী ও হাসপাতালের সমস্যার চেয়ে তিনি জানালেন তার নিজের সমস্যার কথা। হাসপাতালে পানি সমস্যা, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না, এখানে একটি ভাল স্কুল নেই, নেই থাকার পরিবেশ। একজন ডাক্তার এসে কিভাবে এখানে রাত্রি যাপন করবে বলুন। প্রায় ৩৫ মিনিটের আলোচনায় এ এলাকার রোগীদের সেবার মান উন্নয়নে ভাল কোন পরামর্শ পাওয়া গেল না ডা. জান্নাতের কাছ থেকে। তবে কয়েক দিনের মধ্যে ডাক্তারদের সাথে আলোচনা করে প্রতিদিন অন্তত একজন থাকা যায় কিনা চিন্তা করছি।

৭ সেপ্টেম্বর শনিবার বেলা ১১টার দিকে হাসপাতলে গিয়ে দেখা গেল সেই একই চিত্র। একমাত্র উপ-সহকারি কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ডা. দেলোয়ার হোসেন ছাড়া আর কোন ডাক্তার নেই। অফিসের অন্যান্য কর্মচারীর উপস্থিতিও কিছুটা কম মনে হলো। ডাক্তার দেলোয়ার হোসেন জানালেন অবশ্য ভিন্ন কথা। ময়ূরখীল স্বাস্থ্য কেন্দ্রে মূলত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া কথা। ৪ সেপ্টেম্বর বুধবার তিনি রিলিজ হয়েছেন উক্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। সকালে তিনি ময়ূরখীল স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা দিয়ে আবার উপজেলা হাসপাতালে রোগী দেখার জন্য এসেছেন। এত বড় বিশাল হাসপাতালের কার্যক্রম একজন ডাক্তার দিয়ে কী চিকিৎসা সেবা চালানো সম্বব। প্রশ্ন হলো বাকি ডাক্তাররা কোথায়? সরকার ঘরে ঘরে স্বাস্থ্য সেবা পৌছে দিতে আধুনিক চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নে দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক্তার উপস্থিতি নিশ্চিতসহ প্রয়োজনীয় ওষধ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ করলেও কর্তৃপক্ষের নানা অজুহাত আর অবহেলায় তা বাস্তবে রুপ নিচ্ছে না।

রোগীদের চিকিৎসা সেবা না দিয়ে ডাক্তাররা যেমন কর্মস্থলে দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকেন পাশাপাশি নানা অজুহাতে রোগীদের সেবায় আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না করে গড়িমশি করার অভিযোগও রয়েছে। প্রায় ১২লাখ টাকা মূল্যের অত্যাধুনিক এ´-রে মেশিনটি চালু করতে পারে নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। আভ্যান্তরীণ নানা জটিলতা ও ডাক্তারদের লাগাতা অনুপস্থিতির কারণে উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এখানকার পাহাড়ি-বাঙ্গালি খেটে খাওয়া সাধারণ রোগী। চিকিৎসা সেবার মান উন্নয়নে জরুরী ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবে এমনটাই আশা করছে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ।

Exit mobile version