parbattanews

‘শহীদ মনির ছাত্রাবাস’ হবে রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজে: অধ্যক্ষ প্রীতি প্রসুন বড়ুয়া

পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম এবং একমাত্র মেডিক্যাল কলেজ রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ। রাঙ্গামাটিতে কলেজটি যাতে প্রতিষ্ঠা হতে না পারে সেজন্য আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস এবং তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা তুমুল আন্দোলন শুরু করে। অন্যদিকে রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ধারাবাহিকভাবে ভিবিন্ন কর্মসূচি পালন অব্যাহত রাখে বাঙালি সংগঠনগুলো। এ অবস্থার মধ্যেই মেডিক্যাল কলেজটির কার্যক্রম শনিবার (২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি) উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন।

ওই দিন রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ উদ্বোধন ঠেকাতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সন্তু লারমা সমর্থিত সংগঠন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’র বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মীর সমাগম ঘটায় রাঙ্গামাটি শহরে। অন্যদিকে মেডিক্যাল কলেজের বিরুদ্ধে সকল ধরনের ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন অনুষ্ঠান সফল করতে মাঠে নামে জেলা ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতকর্মীরা। শহরের কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় পিসিপি’র নেতাকর্মীরা ব্যারিকেড দিয়ে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়, একপর্যায়ে গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। আশেপাশের ভবনগুলোতেও তারা হামলা করে বসে। এসময় ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা সদর হাসপাতালের সামনে অনুষ্ঠানের জন্য নির্ধারিত স্থানে যেতে চাইলে পিসিপি’র নেতাকর্মীরা চাপাতি, রাম-দা, গুলতিসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আসার পর দেখা যায়, পিসিপি’র নেতাকর্মীদের হামলায় ৪ সংবাদকর্মীসহ ১৭ জন আহত হয়। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের কিছু আগে ৯টার দিকে শহরের কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মো. শামসুল আরফিন।

এ ঘটনায় আহত যুবলীগের কর্মী মনির হোসেন পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ জানুয়ারি রাতে মারা যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে জানা যায়, কোর্ট বিল্ডিং এলাকায় মনির হোসেনকে মারধর শুরু করলে সে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতাকর্মীদের হাত থেকে বাঁচার জন্য সেখানকার নির্মাধীন একটি ভবনের দু’তলায় উঠে যায়। সন্ত্রাসীরা তার পিছু নিয়ে সেখান থেকে তাকে নিচে রাখা নির্মাণ সামগ্রীর উপর ফেলে দেয়। এতে তার পুরুষাঙ্গসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে প্রথমে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে নেয়া হয়, পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে ১৭ জানুয়ারি রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। আরো উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের ১৩ অক্টোবর এই মনির হোসেনের বাবাকেও নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছিল পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা।

জানা গেছে, যুবলীগ কর্মী মনির হোসেনের বাড়ি রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলায়। একটি কন্যা সন্তান, স্ত্রী, মা এবং ভাইদের নিয়ে তার পরিবার চলত মনিরের আয় দিয়ে। মনিরের মৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়ে। তার কন্যাটি চিরতরে হারিয়ে ফেলে পিতার স্নেহছায়া। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তখন প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি তার পরিবারের একজনকে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ঘটনার পর পাঁচ বছর পার হলেও শহীদ মনিরের পরিবারেক কাউকে চাকরি দেয়া হয়নি। এমনকি কেউ খোঁজও রাখেনি তার পরিবারের।

জানা গেছে, তৎকালীন জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে শহীদ মনিরের পরিবারের জন্য মাসিক পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিলো, যা এখনো তার পরিবার পেয়ে যাচ্ছে। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কথা দেওয়া শহীদ মনিরের পরিবারের কারো এখনো সরকারি চাকরি হয়নি।

এদিকে স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো, রাঙ্গামাটি মেডিকেল কল্যাজের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে মনির হোসেন শহীদ হয়েছে। তাই তার নামে মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হোক। বর্তমানে রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজটি ষষ্ঠ বছরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু এখনো রাঙ্গামাটিবাসীর দাবি পূরণ হয়নি। রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করেছে প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের ৯০ শিক্ষার্থী; প্রথম ব্যাচের ৪৫ শিক্ষার্থী এখন ইন্টার্নি করছে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে। দ্বিতীয় ব্যাচের ৪৫ শিক্ষার্থীরও এমবিবিএস শেষ পর্যায়ে। যারা রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ থেকে আজ ডাক্তার হয়ে হয়ে বের হচ্ছে তারা তো মনিরের আত্মত্যাগের আন্দোলনের মাধ্যমে ডাক্তার হতে পারছে। কিন্তু এ ডাক্তাররা কি মনিরের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ রাখবে? প্রশ্ন স্থানীয় সচেতন মহলের।

শহীদ মনিরের মা কমলা বেগম পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমরা আমার ছেলের কথা কী করে ভুলবো? তার রেখে যাওয়া একটি কন্যা সন্তান আমার ছেলের স্মৃতি বহন করছে। আমি তো আর আমার ছেলেকে ফিরে পাবো না।

তিনি আরও বলেন, আমার একটাই দুঃখ, আমার ছেলেটা আমার সংসারের আয়ের চাকা ঘুরাতো। এখন সে নেই। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, আমার পরিবারের একজনকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু চাকরি তো দূরের কথা আমাদেরকে কেউ মনেও রাখেনি।

শহীদ মনিরের ছোট ভাই মোস্তাফা কামাল পার্বত্যনিউজকে বলেন, আমি ভাই হারিয়েছি। যে ভাই হারায়, সেই বুঝে ভাই হারানোর যন্ত্রণা কতটুকু। আমার ভাইয়ের হত্যাকারীদের এখনো কোনো বিচার হয়নি।

তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো, আমাদের পরিবারের একজনকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু আমাদের পরিবারের কেউ কোনো চাকরি পায়নি। কেউ আমাদের মনে রাখেনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, ‘আমি রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত আছি।’

শহীদ মনিরকে নিয়ে আন্দোলন করা তৎকালীন ছাত্রনেতা রাঙ্গামাটি জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট মো. মামুন ভূঁইয়া বলেন, আমাদের এক দাবি; যেহেতু রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য মনির হোসেন শহীদ হয়েছে। তাই তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাকে যেন পরবর্তী প্রজন্ম মনে রাখতে পারে সে জন্য তার নামে মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হোক।

রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার আল হক পার্বত্যনিউজকে বলেন, আজ মেডিক্যাল কলেজ ষষ্ঠ বছরে পদার্পণ করেছে। অনেক ডাক্তার পাস করে বের হয়েছে। কিন্তু যার আত্মত্যাগের মাধ্যমে এ মেডিক্যাল কলেজের পথচলা তার স্মরণ না রাখলে আমরা মানুষের পরিচয় বহন করবো কী করে। নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটবে আমাদের। তাই সরকারের কাছে দাবি জানাই, যার আত্মত্যাগের কারণে মেডিক্যাল কলেজ, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হোক।

রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ বাস্তবায়ন কমিটির আহবায়ক ও সাবেক ছাত্রনেতা জাহাঙ্গীর আলম মুন্না পার্বত্যনিউজকে বলেন, দুঃখ আমাদের। আমরা এ মেডিক্যাল কলেজটি প্রতিষ্ঠার জন্য কত কষ্ট করেছি, ঘাম জড়িয়েছি। কিন্তু আমাদের কথা কেউ মনে রাখে না।
সাবেক এ ছাত্রনেতা আরও বলেন, মনির নামের একটি ছেলে সেইদিন মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনে রাজপথে নেমেছিলো এবং সন্ত্রাসীদের আক্রমণে শহীদ হয়। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে স্মরণ করেনি কোনদিন। তাকে শ্রদ্ধা জানায়নি। তাই একটাই দাবি, অবিলম্বে রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজের একটি ছাত্রবাসের নামকরণ করা হোক ‘শহীদ মনির ছাত্রাবাস’।

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশীদ পার্বত্যনিউজকে বলেন, অতীতের জেলা প্রশাসকের মতো আমিও মনিরের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করছি।

তিনি আরও বলেন, দুঃখের বিষয় মনিরের ভাই এসব টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নিজের কাজে লাগায়। তাই আমি মনিরের মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার ব্যাংক একাউন্টে টাকাগুলো ডিপোজিট করে দিয়েছি। যাতে মেয়েটা ভবিষ্যতে এসব টাকা তার পড়ার কাজে লাগাতে পারে।

রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ প্রীতি প্রসুন বড়ুয়া পার্বত্যনিউজকে বলেন, শহীদ মনিরের ব্যাপারে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ অবগত আছে। বর্তমানে কলেজে দু’টি অস্থায়ী ছাত্রাবাস রয়েছে। যদি স্থায়ী ছাত্রাবাস গড়ে তোলা হয়, তাহলে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হবে ‘শহীদ মনির ছাত্রাবাস’।

Exit mobile version