parbattanews

শান্তিচুক্তির অষ্টাদশ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর বেপরোয়া চাঁদাবাজী শুরু হয়েছে

চাঁদাবাজি

সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার :

চাঁদাবাজি- পাহাড়ের মানুষের কাছে খুব পরিচিত একটি নাম। সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা বেস্টনীর মধ্য দিয়েই বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ে চলছে উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অব্যাহত চাঁদাবাজি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল ক্ষেত্রেই নির্ধারিত রয়েছে চাঁদাবাজির হার- যা এড়িয়ে যাবার ক্ষমতা কারো নেই। এর উপর কোন উপলক্ষ সামনে এলেই তাকে ঘিরে মৌসুমী চাঁদাবাজি বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো চেপে বসে। আর এ চাঁদাবাজিতে বরাবরই অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষ।

পাহাড়ের বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের ছত্রছায়ায় এসব চাঁদাবাজদের হাত থেকে রেহাই পায় না তিন পার্বত্য জেলার সরকারী চাকুরীজীবি-ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক কিংবা দিনমজুর।

পাহাড়ের উপজাতীয় স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজিতে যখন পাহাড়ের শান্তিকামী মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে তখন এ চাঁদাবাজিতে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ‘শান্তিচুক্তি’ চাঁদাবাজি। ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শান্তিচুক্তি’র ১৮ বছর পুর্তিকে সামনে রেখে খাগড়াছড়ির পাহাড়ী জনপদে শুরু হয়েছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি।

শান্তিচুক্তি পালনকে সামনে রেখে পার্বত্যাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে জনপ্রতিনিধি ও ব্যবাসায়ী থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায়ের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ চাঁদাবাজির তালিকা থেকে বাদ পড়েননি সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী বা শিক্ষক সমাজও। পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘শান্তিচুক্তি’ উদযাপনে সরকারীভাবে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সরকারী এসব কর্মসুচীকে পাশ কাটিয়ে ইউপিডিএফ-জেএসএসসহ আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় চলছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি।

আগামী ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ১৮ বছর পুর্তি হবে। আর সে লক্ষকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ‘২রা ডিসেম্বর ২০১৫ উদযাপন কমিটি‘র নামে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে। খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে বেপরোয়া চাঁদাবাজি চললেও চাঁদা দাতাদের কেউই মুখ খুলতে রাজি নয়। সকলেই নিরবে চাঁদা দিয়ে নিরাপদ থাকতে চাইছে।

নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে একাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পার্বত্যনিউজকে বলেন, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষকে সামনে রেখেই পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা যে যার মতো করে চাঁদাবাজিতে নামে। পার্বত্য শান্তিচুক্তিকে সামনে রেখে আবারও তারা তৎপরতা শুরু করেছে। তাদের মতে, পাহাড়ে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হলে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বন্ধ করতে হবে।

২ ডিসেম্বর-২০১৫ ‘শান্তিচুক্তি’ উদযাপন কমিটির নামে ব্যক্তি বিশেষে তিন‘শ টাকা থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে প্রমাণ পাওয়া গেছে। নিরাপত্তাবাহিনীর সকল সূত্র এ চাঁদাবাজির বিষয়ে ওয়াকিবহাল রয়েছে। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো আদায় করা এসব চাঁদার অর্থ দিয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশ বিদ্বেষী প্রচারণা ও তাদের অস্ত্র ভান্ডারকে সম্বৃদ্ধ করবে এমনটাই ধারণা পাহাড়ের সচেতন মহলের। তাদের মতে, একটি দিবসের নামে চাঁদাবাজি সরকার ও প্রশাসনের জন্য মারাত্বক হুমকি স্বরূপ। এসব বন্ধে সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে বলেও মনে করছে পাহাড়ের সচেতন মহল।

খাগড়াছড়ির একাধিক জনপ্রতিনিধি নিজের নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পার্বত্যনিউজকে বলেন, সপ্তাহ খানেক আগ থেকেই ‘শান্তিচুক্তি’র চাঁদাবাজির চিঠি ও রিসিট আসতে শুরু করেছে। এক হাজার টাকা থেকে দশ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবী করা হয়েছে এসব চিঠিতে। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তিন‘শ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। তারা বলেন, তারা চিঠি দিয়েই দমে যায়নি, ফোন করে দ্রুত দাবীকৃত চাঁদা পরিশোধের জন্য হুমকি-ধমকি দিয়ে যাচ্ছে। এ চাঁদাবাজির মাধ্যমে পাহাড়ের এ জনপদকে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য বানানোর কাজ চলছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গরু ব্যবসায়ী বলেন, আমরা বিভিন্ন পাড়া থেকে গরু কিনে স্থানীয় মাটিরাঙ্গা ও গুইমারাসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করে সংসার চারাই। প্রতি গরু ব্যবসায়ীকে দুই হাজার টাকা করে শান্তিচুক্তির চাঁদা দিতে হচ্ছে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে গুম-অপহরণেরও হুমকি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে।

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ভাবতেই অবাক লাগে আমরা কোথায় আছি। তারা যেভাবে চাঁদার জন্য প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তাতে আমরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছি। তবে চাঁদাবাজির বিষয়টি কেউই প্রশাসন বা নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে অভিযোগ করতে নারাজ। কেউ কেউ বলেন, অভিযোগ করে কি হবে? প্রশাসন কি আর তাদেরকে পাবে? উল্টো আমাদেরই বিপদের সম্ভাবনা বেশী থাকে। আর তাই কোন অভিযোগ করে কেউ বিপদ ডেকে আনতে রাজি নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাহাড়ী এসব সন্ত্রাসীদের ‘শান্তিচুক্তি’ উদযাপন কমিটির এ চাঁদাবাজি থেকে রেহাই পাচ্ছেনা পাহাড়ের নিরস্ত্র সাধারন উপজাতি থেকে শুরু করে সরকারী-বেসরকারী উপজাতীয় চাকুরীজীবীদেরও। তাদেরকেও নির্ধারিত অঙ্কে চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব সন্ত্রাসীদের। যেসব সাধারণ উপজাতি চাঁদা দিতে পারছেনা তাদের গোয়াল ঘরের গরু কিংবা হাঁস-মুরগী বিক্রি করে আদায় করা হচ্ছে চাঁদার অর্থ। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে তাদেরকে মারধরের শিকার হতে হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উজাতীয় সরকারী চাকুরীজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘না পারি থাকতে আর না পারি মরতে’ অবস্থার মধ্যেই আছি আমরা।

এ বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনী সংশ্লিষ্ট সুত্রগুলোর সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজি রোধে বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে নিাপত্তা চৌকি বসিয়ে তল্লাশী চালানো হচ্ছে। তবে তিনি চাঁদাবাজি বন্ধে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগের কমতি নেই দাবী করে চাঁদাবাজি বন্ধে সকলের সহযোগীতা কামনা করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মো. মজিদ আলী পার্বত্য নিউজকে বলেন, এ ধরণের অভিযোগে আমরা মামলা নিয়ে থাকি। আপনাদের কাছে যারা অভিযোগ করছে তাদের থানায় এসে মামলা করতে বলেন, আমরা মামলা নেবো এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে।

নতুন উদ্যোমে আর নতুন পন্থায় পাহাড়ী সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজি বিষয়ে জানতে চাইলে সহকারী পুলিশ সুপার (রামগড় সার্কেল) মো: হুমায়ুন কবীর পার্বত্যনিউজকে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটে এমন যেকোন কর্মকান্ড প্রতিরোধে পুলিশ সদস্যরা পাহাড়ে আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। জনগনের সহযোগিতা ছাড়া এ ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করা অনেক কষ্টসাধ্য উল্লেখ করে তিনি ভুক্তভোগী সাধারন মানুষের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, যেকোন ধরনের চাদাবাজিকে বরদাস্ত করা হবে না।

খাগড়াছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন স্থানে চাঁদাবাজীর কথা স্বীকার পার্বত্যনিউজ‘কে বলেন, বর্তমানে যেহেতু চাঁদাবাজদের ধরপাকরে ব্যাপক অপারেশন চলছে সে কারণে তারা আগের মতো প্রকাশ্য চাঁদাবাজি করতে পারছেনা। তারা কৌশল পরিবর্তন করে মানুষকে হুমকি দিয়ে চিঠি দিয়ে, ফোন করে বা স্লিপ পাঠিয়ে চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। সুত্রটি চাঁদাবাজি বন্ধে সাধারন মানুষের মধ্যে চাঁদাবাজ বিরোধী সচেতনতা তৈরীর কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রশাসনের একার পক্ষে নয় বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টায় চাঁদাবাজি বন্ধ সম্ভব।

Exit mobile version