সদূরপ্রসারী চক্রান্তের রোডম্যাপ এঁকেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পভিত্তিক সন্ত্রাসীরা

fec-image

ক্রমেই অনিয়ন্ত্রিত ও অশান্ত হয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ঘটছে নানা অঘটন। বাড়ছে খুনোখুনি, বিরোধ, কলহ। প্রত্যাবাসনবিরোধী চক্রটি সক্রিয় হয়ে ওঠেছে। ক্যাম্পে থেকে বাংলাদেশের বিপক্ষে কথা বলছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ছদ্দবেশে মিয়ানমারের গোয়েন্দারা ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। চালাচ্ছে নানামুখী অপতৎপরতা। রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে তাদের রয়েছে সদূরপ্রসারী চক্রান্তের রোডম্যাপ। এর পেছনে আন্তর্জাতিক কানেকশনে আরও প্রভাবশালী মহলের বিশেষ যোগসূত্রতাও থাকতে পারে।

চক্রটি তাদের মিশন সফল করতে ইতোমধ্যে সীমান্তের কাছাকাছি ১২টি মোবাইল টাওয়ার বসিয়েছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে লক্ষাধিক মিয়ানমারের মোবাইল ফোন সিম (এমপিটি) সরবরাহ করেছে।

ক্যাম্পকে অশান্ত করার মিশন
রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে অস্থিতিশীল ও অশান্ত করার মিশনে নেমেছে একটি চক্র। তাদের সঙ্গে সরাসরি হাত মিয়ানমারের। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কুতুপালং-১ (ইস্ট) লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৮ ব্লকে গুলি করে হত্যা করা হয় মুহিবুল্লাহকে, যিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস নামের একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিনিয়ত ছোটবড় ঘটনার খবর আসে।

অনেক দুস্কৃতিকারীও আটক হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী ধরতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াসী অভিযান চলছে। গণমাধ্যমে খবর না হলেও প্রতিদিনই পুলিশ একাধিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আটক করছে। তবে পুুুলিশের এই অভিযান ব্যর্থ করে নিজেদের বাঁচাতে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা নিয়েছে ভিন্ন কৌশল। তারা ক্যাম্পের মাঝিদের ব্যবহার করে সন্ত্রাসীদের ইনফরমার বা তাদের সাথে চলাচলকারী ছোট সন্ত্রাসী বা প্রতিপক্ষের লোকদের ধরিয়ে দিয়ে নিজেরা গাঁ ঢাকা দিয়ে থাকছে। রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহর রক্তের দাগ না শুকাতেই আবারো ঘটলো খুনের ঘটনা।

শুক্রবার (২২ অক্টোবর) ভোরে উখিয়ার বালুখালী ১৮ নম্বর ক্যাম্পে সংলগ্ন ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় ব্রাশফায়ারে ৬ রোহিঙ্গাকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এতে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১১ জন। ঘটনার পর থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে ১১ লাখ রোহিঙ্গার স্রোত নামার পর গত চার বছরে এরকম আতঙ্কজনক পরিস্থিতি আর কখনো তৈরি হয়নি। হামলার ভয়ে রোহিঙ্গাদের অনেক নেতা ভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন। আতঙ্ক ভর করছে স্থানীয়দের মাঝেও। সন্ত্রাসীদের ভয়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালানো কথা ভাবছে রোহিঙ্গারাও। অন্যদিকে শিবিরে নিরাপত্তা জোরদার করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

গোয়েন্দা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের এ চক্রান্তের প্রথম অ্যাসাইমেন্ট হিসাবে মুহিবুল্লাহকে হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে মিয়ানমার সরকারের হয়ে গোপনে সক্রিয় থাকা রোহিঙ্গাদের ভেতরকার কিছু অপশক্তি। যার প্রথম সারিতে রয়েছে স্বদেশে যাওয়ার ঘোর বিরোধী উগ্রবাদী রোহিঙ্গা সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা)। যাতে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের আর ফেরত নিতে না হয় সেজন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার এ সংগঠনকে মদদদান জোরালো করেছে। এছাড়া শুধু উগ্রপন্থি আরসাই নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চরমপন্থি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে মদদ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে আল ইয়াকিন, ইসলামি মাহাত, সিভিল রাইটস ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্দোলন করা কয়েকটি সংগঠনও। আর এসব চরমপন্থি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার।

এদিকে, ক্যাম্পে ৬ খুনের ঘটনায় ২০০-২৫০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে ২৫ জনের নাম উল্লেখ আছে। শনিবার (২৩ অক্টোবর) রাতে উখিয়া থানায় মামলাটি করেন ঘটনায় নিহত ছাত্র আজিজুল হকের পিতা নুরুল ইসলাম।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম। তিনি জানান, ৬ রোহিঙ্গা হত্যার ঘটনায় ২৫ জনের নাম উল্লেখসহ ২০০-২৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান চলছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষে হতাহতদের ছবি

ঘটনার পর ক্যাম্প-১১ এর আবুল কালামের ছেলে মুজিবুর রহমানকে দেশীয় তৈরি ওয়ান শুটারগান ও ৬ রাউন্ড তাজা গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সাঁড়াশি অভিযানে চালিয়ে এজাহারনামীয় ৫ জনসহ মোট ১০ জনকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন। মুজিবুরের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে অস্ত্র আইনে উখিয়া থানায় মামলা করে।

গ্রেপ্তার বাকি ৯ আসামি হলেন- ক্যাম্প-৮ এর আবু তৈয়বের ছেলে দিলদার মাবুদ ওরফে পারভেজ (৩২), সৈয়দ আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আয়ুব (৩৭), ক্যাম্প ৯ এর নুর বাশারের ছেলে ফেরদৌস আমিন (৪০), মৌলভী জাহিদ হোসেনের ছেলে আব্দুল মজিদ (২৪), ক্যাম্প ১৩ এর আলী আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আমিন (৩৫), আবু সিদ্দিকের ছেলে মোহাম্মদ ইউনুস ওরফে ফয়েজ (২৫), ক্যাম্প ১২ এর ইলিয়াছের ছেলে জাফর আলম (৪৫), ক্যাম্প ১০ এর ওমর মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ জাহিদ (৪০) ও মৃত নাজির আহমদের ছেলে মোহাম্মদ আমিন (৪৮)।

সন্ত্রাসীদের হাতে নিহতরা হলেন- রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১২, ব্লক-জে-৫ এর বাসিন্দা হাফেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষক মো. ইদ্রীস (৩২), ক্যাম্প-৯ ব্লক-১৯ এর মৃত মুফতি হাবিবুল্লাহর ছেলে ইব্রাহিম হোসেন (২৪), ক্যাম্প-১৮, ব্লক-এইচ -৫২ এর নুরুল ইসলামের ছেলে মাদ্রাসার ছাত্র আজিজুল হক (২২), একই ক্যাম্পের স্বেচ্ছাসেবী আবুল হোসেনের ছেলে মো. আমীন (৩২)। ‘এফডিএমএন’ ক্যাম্প-১৮, ব্লক-এফ-২২ এর মোহাম্মদ নবীর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক নুর আলম ওরফে হালিম (৪৫), এফডিএমএন ক্যাম্প-২৪-এর রহিম উল্লাহর ছেলে মাদ্রাসা শিক্ষক হামিদুল্লাহ (৫৫) নিহত হন। হামলাকারীদের সদস্য মুজিবুর নামের একজনকে দেশীয় লোডেড ওয়ান শ্যুটারগান, ছয় রাউন্ড গুলি ও একটি ছুরিসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এদিকে, উখিয়ায় রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার কিলিং স্কোয়াডের সদস্য আজিজুল হক আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
শনিবার (২৩ অক্টোবর) বিকেলে তাকে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। পরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কক্সবাজার-৪ এর বিচারক জেরিন সুলতানার কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আজিজুল।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, কিলিং স্কোয়াডে থাকা আজিজুল হকসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএনের সদস্যরা। সেখান থেকে আজিজুল বিকেলে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তদন্তের প্রয়োজনে বাকিদের রিমান্ডে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

এর আগে শনিবার ভোররাতে আজিজুল হক ছাড়াও কুতুপালং ক্যাম্প-১ এর ডি-৮ ব্লকের আব্দুল মাবুদের ছেলে মোহাম্মদ রশিদ ওরফে মুরশিদ আমিন ও একই ক্যাম্পের বি ব্লকের ফজল হকের ছেলে মোহাম্মদ আনাছ ও নুর ইসলামের ছেলে নুর মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করেন ১৪ এপিবিএনের সদস্যরা। পরে তাদের পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ক্যাম্প পাহারা শেষে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবী ক্যাম্পের ভেতরে অবস্থিত ‘দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়া’ মাদ্রাসায় ঘুমাতেন। শুক্রবার ভোরে ওই মসজিদে অতর্কিত আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে ৬ রোহিঙ্গাকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা।

স্থানীয়দের দেয়া তথ্য মতে, দারুল উলুম নাদওয়াতুল ওলামা আল-ইসলামিয়াহ মাদ্রাসায় ট্রেনিং সেন্টার করতে চেয়েছিল একটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ। একইসঙ্গে ওই গ্রুপটিতে মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যোগ দেওয়ারও চাপ দেয়। এ জন্য প্রতিনিয়ত প্রাণনাশের হুমকিতে আতংকে ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

‘আরসা’র নামধারী মৌলভী আবু বক্কর, মৌলভী নুর হোছন, খালেক, ফজলুল কবির, ইকবালসহ অনেকেই উখিয়ার বালুখালী ২ নম্বর ক্যাম্পটি নিয়ন্ত্রণে নিতে চায়। এর জের ধরেই মাদ্রাসায় হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গারা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর ক্যাম্প জুড়ে বিরাজ করছে অস্থিরতা। কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ রাত হলেই ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতংক দেখা দিয়েছে। রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন না থাকায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। তবে সন্ত্রাসীদের ভয়ে ক্যাম্পের বাসিন্দারা এ বিষয়ে কথা বলতে চান না, দেন না কোনও অভিযোগ।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার ২৩ দিনের মাথায় সশস্ত্র ও মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের হামলায় শুক্রবার এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলো।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে নতুন ও পুরনো মিলে কক্সবাজারের ৩৪টি রোহিঙ্গা শিবির এবং নোয়াখালীর ভাসানচরে বসবাস করছেন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা।

১৪ নম্বর আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) অধিনায়ক মো. নাঈমুল হক জানান, নিহত ছয় জনের হত্যাকারীদের ধরতে পুলিশি অভিযান অব্যাহত আছে। ক্যাম্পগুলোতে রাতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন