parbattanews

সন্তানদের শিক্ষিত করতে আরাফার জীবন যুদ্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক, বান্দরবান:

আঠার বছর বয়সে বিয়ে হয় আরাফা বেগমের। কক্সবাজার জেলার টেকনাফে উপকুলীয় এলাকায় ছিল পিতৃভূমি। সাগরে বসতভিটা বিলীন হওয়ায় এক আত্মীয়ের সাথে মা, বাবা, ভাই বোনসহ চলে আসে বান্দরবানে। সবকিছু হারিয়ে জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার তারাছা ইউনিয়নের দানেস পাড়ায় একজনের বাগান পাহারার চুক্তিতে একটি বাসায় অবস্থান নেয় তার পিতা আব্দু সালাম। বর্গা চাষা হিসেবে শুরু করে ধান ও সবজির চাষ।

এরই মধ্য আরাফার বয়স প্রায় আঠার ছুই ছুই তখন বিয়ে দেয় এক দিন মজুর মো. রফিকের সাথে। সুখের সংসারে ভাঙ্গা ঘর আলোকিত করে বিয়ের এক বছরের মাথায় একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। তার নাম জাহাঙ্গীর আলম। এরপর ওইখান থেকে চলে আসে ফানছির ঘোনা (বর্তমান রূপ নগর) এলাকায়। মহরম আলী নামে এক বাগান মালিকের বাগানে আশ্রয় নেয় পিতা মাতার সাথে আরাফা। সেখানে সুখ তাকে বেশি দিন সইলনা। ক্যান্সার রোগে আক্রন্ত হন মো. রফিক। দিন মজুরের চিকিৎসার কতইবা টাকা থাকে।

এক প্রকার বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় রফিকের। আকাশ ভেঙ্গে পড়ে আরাফার। যে দিকে তাকায় শুধু অন্ধকার আর ঘোলা দেখে। পিতা গরিব কৃষক, ভাই দিন মজুর অভাবের সংসার। পাঁচ মাস বয়সী শিশুকে কি ভাবে খাওয়াবে, কি ভাবে শিক্ষিত করে মানুষ করবে শুধু এ চিন্তা তার। সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে নেমে পড়ে শ্রমিকের কাজে। মানুষের বাগান, কৃষি জমি ও মাটি কাটার কাজ দিয়ে শুরু করে জীবন সংগ্রাম। শ্রমিকের কাজ করে সংসার শুরু করলেও নানান জনের নানা কথা। কারণ তখন তার বয়স মাত্র বিশ-এ। ভরা যৌবন দেখে নানান জনে নানা কটুক্তি করে এবং কু-প্রস্তাব দেয়।

এরই মধ্য ছেলের বয়স প্রায় আড়ায় বছর। কটু দৃষ্টি ও লালসা থেকে মুক্তি পেতে এবং পরিবারের মতে একটু সুখ শান্তির আশায় আবার বিয়ে করে জগত আলী নামে এক ব্যক্তিকে। বিয়ের পর শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন। জগত আলী সারা দিন বাইরে বাইরে গল্প গুজব করে সময় কাটায় আর আরাফা আগের মত শ্রমিকের কাজ করে সংসার চালাতে হয়। এ নিয়ে ঝগড়া ঝাটি ও অশান্তির সংসার চলতে থাকে। মাঝে মধ্য জগত আলী আবার আলীকদমের প্রথম স্ত্রীর কাছে চলে যেত। একবার গেলে মাস দুয়েক পরে ফিরত। এ নিয়ে কিছু বললে শুরু হত নির্যাতন।

বিয়ের পর থেকে আরাফার সন্তানকে কখনো একটু পিতৃ স্নেহ দেয়নি জগত আলী। এরমধ্য এক বছরের মাথায় আরেকটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় আরাফা বেগম। তার নাম মো. আলী। এরই মধ্য বিভিন্ন জন থেকে বর্গা নিয়ে ধান চাষ করে তারা। বিভিন্ন জনের কাছে শ্রমিক কাজ করে চাষের খরচ যোগাত আরাফা। কিন্তু সোনালী ধান ঘরে তোলা শেষ হতে না হতে জগত আলী ধান বিক্রি করে চলে যেত প্রথম স্ত্রীর কাছে। জগত আলী তার সন্তান আলীকে আদর করলেও আরাফার  প্রথম সন্তান জাহাঙ্গীরকে কখনো আদর করত না।

এভাবে তাদের সংসার চলে প্রায় ৫ বছর। এরইমধ্য অনেক বার পারিবারিক কহল মিঠাতে স্থানীয় গন্যমান্য নিয়ে বৈঠক হয়। বৈঠকের কিছুদিন ঠিক থাকলেও আবার শুরু হয় আরাফার উপর নির্যাতন। আবার চলে যায় আলীকদমে। ফিরে মাস তিনেক পর পর। আবার অশান্তির সংসার জীবন বিষ হয়ে উঠে আরাফার। সিন্ধান্ত নেয় স্বামীকে ছেড়ে দেয়ার। যে সিদ্ধান্ত সে কাজ। বিচ্ছেদ হয় তাদের মধ্য।

আবার নতুন করে শুরু করে জীবন সংসার। তিনি চিন্তা করলেন নিজের বলে এক ইঞ্চি জমিও নেই। কিন্তু তার আছে দুটি পুত্র সন্তান। স্বামীর কাছ থেকে সুখ না পেলেও বৃদ্ধ কালে দু সন্তানের কাছে সুখ পাবে বলে তার আশা। দু-সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে আরাফা। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে নিজে বর্গা জমি নিয়ে প্রায় দেড়কানি জমির চাষ শুরু করে। চলে শ্রমিকের কাজ। গত বর্ষার বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয় তার। যা ধান পেয়ে প্রায় সবটুকু বর্গা চাষের ধান দিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্য আবার তার স্বামী জগত আলীর করা ঋণও শোধ করতে হচ্ছে তাকে। আবার হতাশা এসেছে তার জীবনে। হতাশা তাকে দমাতে পারেনি। আবার শুরু করে বরো ধানের চাষ। ধান চাষের পাশাপশি কিছু কিছু সবজির চাষও করে আরাফা। তার প্রথম সন্তান ২য় শ্রেণিতে আর দ্বিতীয় সন্তান ক্লাস ওয়ানে পড়ে।

সে জানায়, জীবনে সুখ শান্তি কিছু পাইনি। সাগরে ভিটার জায়গা টুকু কেড়ে নিয়েছে। প্রথম স্বামী অল্প দিনে মারা গেছে। ২য় স্বামী যতদিন ছিল নির্যাতন করেছে এবং শেষ বেলায় তার করা ঋণও আমার থেকে শোধ করতে হচ্ছে। এখন শুধু আমার চিন্তা দু’ছেলেকে কিভাবে লেখা পড়া শিখিয়ে শিক্ষিত করব।

Exit mobile version