parbattanews

সাজেকে মৌজাভূমি হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত এক পাংখোয়া কন্যার আবেদন

আমার নাম বেথেলহেম পারী পাংখোয়া, পিতা মৃত. রোয়াল থাত পাংখোয়া, হেডম্যান, ১৭১নং বেটলিং মৌজা, সাজেক, বাঘাইছড়ি উপজেলা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।

আমরা ২ ভাই, ২ বোন। আমার ভাইয়েরা লেখাপড়া না জানার কারণে বাবার মৃত্যুতে বেটলিং মৌজার হেডম্যান শূন্য পদে পরিবারের সকলের সম্মতিতে আমি নিজে হেডম্যান হওয়ার জন্য রাঙ্গামাটি চাকমা সার্কেল চিফ মহোদয়ের কাছে ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১ দরখাস্ত করি। পরে ১৬ আগস্ট ২০২১ রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসকের কাছেও দরখাস্ত জমা দেই এবং একই দিন (১৬ আগস্ট ২০২১) আঞ্চলিক পরিষদের কাছেও আমার দরখাস্ত জমা দেই।

কিন্তু অতি মর্মান্তিক ও দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, আমার বাবার মৃত্যুতে বেটলিং মৌজা হেডম্যানের শূন্য পদে পরবর্তী হেডম্যান হওয়ার জন্য বাবু ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরা, পিতা: বাবু দ্বির্জ্জমনি ত্রিপুরার নাম সুপারিশ করে চাকমা সার্কেল চিফ এবং আঞ্চলিক পরিষদ থেকে রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

অথচ, এই ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরা আমার বাবা রোয়াল থাত পাংখোয়ার ছেলেও না, বংশধরও না, অন্য কোনো সূত্রে আত্মীয়ও না। তিনি অন্য জাতের এবং অন্য মৌজা মাশালংয়ের বাসিন্দা, যা আমাদের বেটলিং মৌজা থেকে অন্তত ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাছাড়া আমরা তাকে আমার বাবার শূন্য পদে দরখাস্ত করার অনুমতিও দেই নাই। তিনি আমাদেরকে না জানিয়েই আমার বাবার শূন্য পদে হেডম্যান হওয়ার জন্য দরখাস্ত করেছেন।

ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরার দরখাস্ত আমলে নিয়ে চাকমা সার্কেল চিফ এবং আঞ্চলিক পরিষদ তাকে হেডম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক বরাবরে সুপারিশপত্র দিয়েছেন। অথচ, আমি আমার বাবার উত্তরাধিকার হিসেবে হেডম্যান পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করার পর চাকমা সার্কেল চিফ এবং আঞ্চলিক পরিষদ বিষয়টি আমাকে কোনো প্রকার নোটিশ না দিয়েই ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরার নাম সুপারিশ করেছেন। আমাকে না জানিয়ে বা আমার মতামত না নিয়ে তারা এটা কীভাবে করেছেন আমি সে ব্যাপারেও কিছু জানি না।

পরবর্তীতে জেলা প্রশাসক মহোদয় সার্কেল চিফ এবং আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশপত্রসহ বাঘাইছড়ি ইউএনও মহোদয়ের কাছে চিঠি পাঠালে আমরা এ বিষয়ে জানতে পারি। ইউএনও মহোদয়ের চিঠি পেয়ে আমরা ৯ জুন ২০২২ উনার বাঘাইছড়ি অফিসে শুনানিতে হাজির হই। সেখানে বাঘাইছড়ি উপজেলার ইউএনও এবং বাঘাইছড়ির ওসি সাহেবসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিলেন। সেখানে ইউএনও এবং ওসি সাহেব ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে প্রশ্ন করেন, তুমি ত্রিপুরা হয়ে পাংখোয়াদের হেডম্যান হওয়ার জন্য দরখাস্ত কেনো করেছো? ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরা এই প্রশ্নের কোনো সঠিক জবাব দিতে পারেননি।

১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিতে উল্লেখ না থাকলেও এখানে প্রথাগত আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো হেডম্যান বা কারবারি মারা গেলে শূন্য পদে তার উত্তরাধিকার হিসেবে ছেলে বা মেয়েকে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। বাবার শূন্য পদে উপযুক্ত সন্তানকে নিয়োগ দেওয়াটাই এখানকার প্রথা। অনেক জায়গায় স্বামীর মৃত্যুতে স্ত্রীকে হেডম্যান বা কারবারি পদে নিয়োগ করার ঘটনাও আছে। ইতোমধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় ১৪ জন নারী হেডম্যান এবং ৫১৭ নারী কারবারি আছেন। এসব নারী হেডম্যান এবং কারবারিরা সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করে তাদের দক্ষতার প্রমাণ দিচ্ছেন।

১৯১৫ সাল থেকে ১৭১নং বেটলিং মৌজায় প্রথম হেডম্যান চংবিয়ালা পাংখোয়া, এর পর তার পুত্র লাল ছতা পাংখোয়া, এর পর তার পুত্র চংমিং থাঙা পাংখোয়া, এর পর তার পুত্র ছন ঙামা পাংখোয়া এবং এর পর তার পুত্র (আমার বাবা) রোয়াল থাত পাংখোয়া বংশপরমপরায় হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমার বাবা রোয়াল থাত পাংখোয়ার মৃত্যুর পর শিক্ষিত এবং যোগ্য কন্যা হিসেবে আমিই এই পদের উত্তরাধিকার হওয়ার অধিক দাবিদার। বংশপরমপরায় আমার পরিবার হেডম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসার কারণে এই দায়িত্ব পালনে আমার পারিবারিক যেমন ঐতিহ্য আছে, তেমনি বাবার কাজে দীর্ঘদিন সহযোগিতা করার কারণে হেডম্যানের দায়িত্ব পালনে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাও আছে। তাছাড়া, পাহাড়ের এত এত নারীরা হেডম্যান এবং কারবারির দায়িত্ব পালন করতে পারলে আমি কেন পারবো না?

এখন কোনো মহলের ষড়যন্ত্রের কারণে পাংখোয়াদের বেটলিং মৌজা যদি ডহিন্দ্র লাল ত্রিপুরার হাতে চলে যায় তাহলে আমাদের পরিবারকে মৌজাভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হতে পারে। অথবা আমাদের সাথে এমন আচরণ করা হতে পারে, যার কারণে হয়তো বাধ্য হয়েই আমাদেরকে মৌজাভূমি ছেড়ে যেতে হবে। এই অবস্থায় আমার পরিবারের পূর্বপুরুষদের শত বছরের স্মৃতি, ঐতিহ্যসহ আমাদের জন্মভূমি হারানোর ভয়ে আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে দিনযাপন করছি। তাই পরিবারের ঐতিহ্য এবং সম্মান রক্ষায় একজন নারী হয়েও সাজেকের মতো দুর্গম এলাকা থেকে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিস এবং ব্যক্তির নিকট ছুটাছুটি করছি আর চোখের জল ফেলছি। দুঃখে-কষ্টে অনেক সময় থালার ভাতও চোখের পানিতে ভিজে যায়, চোখের পানিতে ভেজা সেই ভাত খেয়েও আবার ছুটতে হয়। এত কিছু করেও আমি আমার অধিকার ফিরে পাওয়ার কোনো আশ্বাস কারো কাছ থেকে পাচ্ছি না।

এই অবস্থায় রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসক, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, ভূমি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে আমার আকুল আবেদন, আশা করি, আপনাদের কাছে সঠিক বিচার পাবো। যেকোনো মূল্যে আমি আমার পরিবারের ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই, আমার জন্মভূমি ১৭১নং বেটলিং মৌজার হেডম্যান হিসেবে আমি নিয়োগ পেতে চাই। আপনারা আমার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করুন। আমি এবং আমার পরিবার আপনাদের অবদানের জন্য চির কৃতজ্ঞ থাকবো।

লেখক: বেথেলহেম পারী পাংখোয়া, পিতা মৃত রোয়াল থাত পাংখোয়া, হেডম্যান, ১৭১নং বেটলিং মৌজা, সাজেক, বাঘাইছড়ি, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।

Exit mobile version