সাড়ে চার বছরেও রাঙামাটিতে পূরণ হয়নি আওয়ামীলীগের নির্বাচনী ওয়াদা

Rangamati Di-Heli Pic

আলমগীর মানিক, রাঙামাটি

সাড়ে চার বছরেও রাঙামাটি পার্বত্য জেলায় জনগণকে দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করতে পারেনি ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সরকার। নিয়ম মাফিক কিছু কর্মকাণ্ড ছাড়া অধিকাংশ নির্বাচনী ওয়াদা এখন ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে খোদ ক্ষমতাসীনদের নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকদের মাঝে। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে রাঙ্গামাটি জেলার আওয়ামীলীগ। বাড়ছে আন্তঃকোন্দল। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন দলের নেতাকর্মীরা। নিস্ক্রিয় হয়ে অনেকে নেমেছে ব্যবসায়। অনেকেই উদাসীন হয়ে পার করছেন সময়। এই সুযোগে সুযোগ সন্ধানীরা সরকারী দলের পদ পদবী পাওয়ার চেষ্টায় শুরু করছেন লেজুড়বৃত্তি।

স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দলের সমন্বয়হীতার কারণে ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে দলটি। এছাড়া গত নির্বাচনে জেলাবাসীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে না পারা, সংবিধানে পাহাড়ি জনগণকে জাতি হিসেবে ‘বাঙালী’ পরিচিত করা, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন ও আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতা মুক্তিযোদ্ধা অনিল তঞ্চঙ্গ্যা অপহরণের পর গুম ইত্যাদি কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের  উপর।

বর্তমানে এমনই অবস্থা যে দলীয় জনসংযোগেও সাড়া দিচ্ছেন না সাধারণ মানুষ। জনসংযোগে গিয়ে হামলারও শিকার হচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। গত বছর বাঘাইছড়িতে জনসংযোগ করতে গিয়ে জেলা আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি চিংকিউ রোয়াজা, মানব সম্পদ সম্পাদক কেরল চাকমা, বাঘাইছড়ি উপজেলা সভাপতি বৃষকেতু চাকমাসহ জনসংযোগেও সফরকারী আওয়ামীলীগের প্রতিনিধি দল স্থানীয়দের হাতে ব্যাপক মারধরের শিকার হয়। হামলায় মারাত্মক আহত হন চিংকিউ রোয়াজা। অবশেষে প্রাণ নিয়ে ফিরে চিংকিউসহ হামলার শিকার প্রতিনিধি দল রাঙ্গামাটি এসে সংবাদ সম্মেলন করেন। সম্মেলনে হামলার সম্পর্কে পরিস্কার কোন তথ্য না দিয়ে বৃষকেতু চাকমার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে সম্মেলনকারীরা। এর পর থেকে জনসংযোগ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে দলটির।

দলীয় সূত্র জানায়, দীপংকর তালুকদার বিগত নির্বাচনে জেলাবাসীকে ২৩টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এগুলোর মধ্যে-

১. সকল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও করার পাশাপাশি শিক্ষকের পাহাড়ি ভাতা চালু করা। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে  শর্ত শিথিল এবং নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন। ২.বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল, মেডিকেল কলেজ স্থাপন, রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজে সকল বিষয়ে অনার্স ও মার্স্টাসকোর্স চালু, মহিলা কলেজে গ্রাজুয়েশন কোর্স চালু ও নতুন ছাত্রীনিবাস নির্মাণ, কাপ্তাই সুইডিশ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট বিষয়ভিত্তিক সকল বিষয় চালু ও আধুনিকায়ন, বাঘাইছড়ি উপজেলার একমাত্র কাচালং ডিগ্রী কলেজে বি.এস.সি কোর্স চালু ও ভোকেশনাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা। ৩. রাঙ্গামাটির সকল হাসপাতাল আধুনিকায়ন  ও জেলা শহরের পুরাতন হাসপাতালকে ১০ শয্যা করার উদ্যোগ গ্রহন করা। ৪. আন্ত:উপজেলা সড়ক পাড়া/মহল্লা   সড়ক উন্নয়ন এবং বন্ধ সড়ক পুনঃ চালু করা। ৫।. সকল উপজেলায় নেটওর্য়াক সম্প্রসারণ করা। ৬.বিদ্যুৎহীন এলাকায় বিদ্যুৎ লাইন সম্প্রসারণ ও সৌর বিদ্যুৎ স্থাপন।৭.ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার  ও উন্নয়ন করা। ৮. ক্রীড়াঙ্গনের উন্নয়নের জন্য বাস্তব সম্মত গ্রহন করা। ৯.হেডম্যান কার্বারীদের ভাতা বৃদ্ধি করা। ১০.জোত পারমিট এর ট্রনজিট সহজ করা। ১১. শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা ১২. প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বেকাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা ১৩. প্রতিবন্ধীদের পূণর্বাসনের লক্ষ্যে আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। ১৪. ১৯৬০ সালে কাপ্তাই বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থদের কৃষি ঋণ মওকুফের ব্যবস্থা করা। ১৫. পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে ক্ষতিগ্রস্থ এবং অনাদায়ে ঋণ সুদাসলে মওকুফের ব্যবস্থা করা। ১৬. পর্যটন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে সরকারের উদ্যোগের পাশাপাশিবেসরকারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ প্রদান করা। ১৭.জেলায় ঠিকাদারী কাজে জামানত সহনীয় পর্যায়ে করা। ১৮. কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ ও কৃষি উপকরণ সরবরাহ করা। ১৯. রাবার, চা ও ফলজ বাগান সৃষ্টিতে উৎসাহ প্রদান ও সহযোগীতা করা। ২০. হিমাগার স্থাপনে সহযোগীতা করা। ২১. বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইনান্স কর্পোরেশন হতে সহজ শর্তে ঋণ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা। ২২. কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা বন্ধকালীন ভিজিএফ কার্ড বিতরণ করা এবং ২৩.জেলায় বিএনপি জোট সরকারের আমলে বন্ধ হয়ে যাওয়া কল-কারখানা চালু করা।

জেলাবাসীর মতে, কেন্দ্রীয়ভাবে বাস্তবায়িত দু-একটি বিষয় ছাড়া বাকিগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। এর ফলে ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।

দলীয় সূত্র আরো জানায়, বাঘাইছড়ি ঘটনার পর কেউ জনসংযোগে যেতে সাহস পাচ্ছে না।  দলের কার্যক্রম শক্তিশালী করতে গত বছর  ২৯ নভেম্বর আওয়ামীলীগের জেলা কমিটির  নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ধরে নেওয়া হয়েছিল নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ আবার সক্রিয় হবে কিন্তু নির্বাচনের পর দলটি আরো বেশী বেকায়দায় আছে। নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় দীপংকর তালুকদার সভাপতি এবং নির্বাচনের মাধ্যমে মুছা মাতব্বর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। কিন্তু নির্বাচনের ৫ মাস পরও আলোর মূখ দেখেনি পুর্ণাঙ্গ কমিটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক  জেলা আওয়ামীলীগের এক নেতা বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না হওয়ায় নেতারা এখন মিটিং-মিছিলে আর আসে না। দীপংকর তালুকদার শুধু রাঙ্গামাটি এসে ফিতা কেটে ঢাকায় চলে যান। দলের কোন খোঁজ খবর নিচ্ছেন না। কর্মসূচি বাস্তবায়নে তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তাকে যথাসময়ে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। অন্যদিকে কেউ আগ বাড়িয়ে কাজ করতে চাচ্ছে না।

জেলা ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, দীপংকর বাদে এখন কেউ কারোর কথা শুনছেন না। দীপংকর রাঙ্গামাটির কোন কর্মসূচিতে না থাকলে তাহলে অন্যান্য নেতাদের দেখা মিলছে না। সব মিলিয়ে বেকায়দায় আছে রাঙামাটির আওয়ামীলীগ। এই নেতাসহ দলের কয়েক নেতাদের ধারণা এই অবস্থায় ধাক্কা আসলে ধাক্কা সামলাতে পারবেনা দলটি।

জনগণের সাথে দুরত্ব বেড়েছে কথাটি স্বীকার করেন রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর। তিনি বলেন, দলের কিছু নেতার মধ্যে কিছু চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। এই থেকে উত্তোরণের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, পুর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় কাজ গতিশীল হতে পারছে না। তাদের উন্নয়নের কাজ অব্যাহত আছে উল্লেখ করে ভবিষ্যত নির্বাচনে তারাই বিজয়ী হবেন বলে আশা করে মুছা।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন