সিলেটে ফের বন্যা, পানিবন্দি ৩ লাখ মানুষ

fec-image

ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে সিলেটে একাধিক এলাকা প্লাবিত। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় তিন লাখ মানুষ। পানি ঢুকে গেছে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কার্যালয়ে।

এদিকে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি আবারো বেড়ে গিয়ে ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম জেলার জিঞ্জিরাম, কালোর ও ধরণী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তিন দিন ধরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি

গত কয়েক দিনের মতো বুধবারও অবিরাম বৃষ্টি হয় সিলেটে। এতে পানি ক্রমশ বাড়ছে। এরই মধ্যে কোম্পানীগঞ্জ ও গোয়াইনঘাট উপজেলার তিন শতাধিক গ্রাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সিলেট সূত্রে জানা গেছে, সুরমা, কুশিয়ারা ও সারি নদীর পানি তিনটি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে গতকাল সকাল ৯টায় ১৩ দশমিক ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বুধবার (১৫ জুন) সকালে সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে ১২ দশমিক ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ ছাড়া কুশিয়ারা নদীর ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে পানি ৯ দশমিক ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ১১ সেন্টিমিটার ওপরে।

পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, ‘পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টি অব্যাহত থাকায় পানি বাড়ছে। মঙ্গলবার বিকেলে তিনটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া শুরু করে। এখনো তা অব্যাহত আছে। এমনটা থাকলে পুনরায় বন্যার আশঙ্কা আছে।’

স্থানীয় প্রশাসন ও এলাকাবাসী জানিয়েছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ৬টি ইউনিয়ন আছে। নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ায় এসব ইউনিয়নের ১৩৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে ৬টি ইউনিয়নেরই সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে।

উপজেলা পরিষদ, থানাসহ একাধিক সরকারি-বেসরকারি কার্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা সদরের অধিকাংশ দোকানপাট ও বাসাবাড়িতে পানি ঢুকেছে।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ রোড, থানা রোড ও ভূমি অফিস রোড পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব সড়কে নৌকা দিয়ে মানুষজন চলাচল করছেন।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লুসিকান্ত হাজং বলেন, ‘গত কয়েক দিন আগে শেষ হওয়া বন্যা পরিস্থিতির চেয়েও এখন পানি বেশি এসেছে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটসহ অসংখ্য স্থাপনা তলিয়ে গেছে। তবে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ কমাতে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে।’

এদিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে ১১টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়ে পড়েছে। এ উপজেলার ২৬৪টি গ্রামের মধ্যে অন্তত ২০০টি গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও দোকানপাটে পানি ঢুকে পড়েছে। গোয়াইনঘাট উপজেলা কমপ্লেক্স, হাসপাতাল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় গতকাল সকালে পানি ঢুকে পড়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিলুর রহমান বলেন, ‘টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে অসংখ্য এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি বাড়তে থাকায় পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। তবে প্রশাসন আশ্রয়কেন্দ্র চালুর পাশাপাশি মানুষজনের নিরাপদে থাকার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে।’

এর আগে গত ১৪ মে থেকে সিলেট নগরসহ ১৩টি উপজেলায় বন্যা দেখা দেয়। এতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন জানায়। প্রথম দফা বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার বন্যার আশঙ্কায় মানুষ চিন্তিত।

ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি

টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদ-নদীর পানি আবারো বেড়ে গিয়ে ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি।

তথ্য অনুযায়ী, বুধবার (১৫ জুন) সকাল ১০টা পর্যন্ত সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রভাবিত হচ্ছে। এরই মধ্যে প্লাবিত হয়েছে সুনামগঞ্জ সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারা বাজারসহ চারটি উপজেলার নিম্নাঞ্চল।

অন্যদিকে শহরের উত্তর আরপিন নগর, মধ্যবাজার, কাজির পয়েন্ট, জগন্নাথবাড়ি রোড, নবীনগর এলাকার বেশ কয়েকটি জায়গার নিম্নাঞ্চল এলাকা পানি প্রবেশ করেছে। এতে করে ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ, স্কুলের শিক্ষার্থী এবং ব্যবসায়ীরা।

মধ্যবাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, সকাল থেকে রাস্তায় পানি আর একটানা বৃষ্টিতে কোনো কাস্টমার নেই, বড় খারাপ অবস্থা এখানের।

সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্যে সুনামগঞ্জে আরো দুই দিন বৃষ্টিপাত থাকবে। এ সময় বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হতে পারে।’

এদিকে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন নিম্নাঞ্চল এলাকায় সৃষ্ট বন্যা মোকাবিলায় সব রকমের প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে জরুরি ত্রাণ সহায়তা প্রেরণ ও সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সজাগ থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন।

তিনি বলেন, ‘সুনামগঞ্জের ১২টি উপজেলায় ইতোমধ্যে ২০ টন করে খাদ্যসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জরুরি প্রয়োজনে সবাইকে কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।’

কুড়িগ্রামে পানিবন্দি ৫০ হাজার মানুষ

টানা বৃষ্টি আর ভারতের আসাম থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে কুড়িগ্রামের দুই উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। জেলার জিঞ্জিরাম, কালোর ও ধরণী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তিন দিন ধরে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

রৌমারী উপজেলা পরিষদ থেকে জানা গেছে, ঢলের পানিতে রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ৫৫ গ্রামের ৫০ হাজারের বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ডুবে গেছে ৫৯২ হেক্টর ফসলি জমি। এ ছাড়া ৫৬ কিলোমিটার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুই উপজেলার ৪০টি স্কুলে পাঠদান সাময়িক বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছে শিক্ষার্থীসহ বানভাসীরা। দুর্ভোগ এলাকায় দেখা দিয়েছে গোখাদ্যের সংকট। এরই মধ্যে কবলিতদের মাঝে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

রৌমারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে ৪০টি বিদ্যালয় পানিবন্দি হয়ে পড়ায় সাময়িকভাবে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। পানি কমে গেলে নিয়মিত পাঠদান শুরু হবে।

সরেজমিনে রৌমারীর যাদুরচর ইউনিয়নের পুরাতন যাদুরচর, কাশিয়াবাড়ী, লালকুড়া, বিক্রিবিল, চর লাঠিয়ালডাঙ্গা, বালিয়ামারী, শ্রীফলগাতি, খেওয়ারচর, বকবান্দা, আলগারচর, পাহাড়তলী, যাদুরচর পূর্বপাড়া, তিনঘড়িপাড়া ও বকবান্ধা গ্রামের বাড়িগুলোতে পানি ঢুকেছে।

এ ছাড়া রৌমারী সদর ইউনিয়নের বাওয়াইরগ্রাম, ঝাউবাড়ি, দুবলাবাড়ি, পাটাধোয়াপাড়া, রতনপুর, বামনেরচর, কলাবাড়ি, বড়াইবাড়ি,নতুন চুলিয়ারচর,উত্তর বারবান্দা, মির্জাপাড়া, ইজলামারী, ফুলবাড়ি, চুলিয়ারচর, চরবারবান্ধা, ভুন্দুরচর, নয়ারচরসহ অনেক গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

এদিকে চর রাজিবপুর উপজেলার বন্দবের ইউনিয়ন ও চর রাজিবপুর ইউনিয়নের ৫ থেকে ৬টি গ্রামের মানুষও পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

ঢলে ভেসে গেছে জমিতে থাকা খড় ও মাছের ঘের। পানিতে তলিয়ে গেছে কৃষকের ধান, পাটসহ নানা ফসলের জমি। এমনকি রৌমারীর নতুন বন্দর স্থলবন্দর ও জেলার একমাত্র বাংলাদেশ-ভারত বালিয়ামারী সীমান্ত হাটও পানিতে তলিয়ে গেছে।

রৌমারী সদর ইউনিয়নের নতুন চুলিয়ারচর গ্রামের কৃষক ছক্কু মিয়া বলেন, ‘কোনো মতে জমি থেকে ধান কাটতে পারলেও খড় শুকাতে পারিনি। সব ভেসে গেছে। এখন গরুর মুখে দেয়ার মতো কোনো খড় নাই।’

রৌমারী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আজিজুর রহমান জানান, ‘বানের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।’

রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল বলেন, ‘জিআরের বরাদ্দ থেকে ৩ লাখ টাকার শুকনো খাবার কেনা হয়েছে। এগুলো দ্রুত পানিবন্দি মানুষের মধ্যে সরবরাহ করা হবে। আরো বরাদ্দের জন্য জেলা প্রশাসককে জানানো হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই বিতরণ করা হবে।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা, সিলেট
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন