parbattanews

সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ে মিয়ানমারের ব্যাখ্যা এবং অভিযোগ গ্রহণ করেনি বাংলাদেশ

মিয়ানমারের ইয়াঙ্গনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে নিয়ে সেই দেশটির পক্ষ থেকে সীমান্তে সাম্প্রতিক উত্তেজনার ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, তা গ্রহণযোগ্য নয় বলে জানিয়েছে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

প্রথমবারের মতো গত সোমবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে মিয়ানমার তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত না নিয়ে মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য উস্কানি দিচ্ছে বলে বাংলাদেশ মনে করে।

বাংলাদেশ সেই উস্কানিতে পা না দিয়ে কূটনৈতিকভাবে বিষয়টির সমাধান করতে চাইছে বলে কর্মকর্তারা উল্লেখ করেন।

মঙ্গলবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিদেশি সব মিশনের রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনারদের সাথে বৈঠক করে বাংলাদেশের এই অবস্থান তুলে ধরেছেন।

সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টারের গোলা বিস্ফোরণ এবং অব্যাহত উত্তেজনার পটভূমিতে এরই মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চার দফায় তলব করে বাংলাদেশ প্রতিবাদ জানিয়েছে।

এর জবাবে ইয়াঙ্গনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মনজুরুল করিম খান চৌধুরীকে ডেকে নিয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাদের ব্যাখ্যা দিয়েছে।

মিয়ানমার ব্যাখ্যায় যা বলেছে:
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমার সরকার সীমান্তে গোলাগুলি এবং মর্টার হামলার দায় চাপিয়েছে বিদ্রোহীদল আরাকান আর্মি এবং আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসার ওপর।

এই বক্তব্যের সমর্থনে মিয়ানমার বলেছে, আরাকান আর্মি এবং আরসা মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের একটি চৌকিতে হামলা চালায় এবং এসময় তিনটি মর্টার শেল বাংলাদেশের মাটিতে গিয়ে পড়ে।

একইসাথে মিয়ানমার বাংলাদেশের ভেতরে আরকান আর্মি এবং আরসার ঘাঁটি থাকার অভিযোগ তুলে সেগুলো তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছে।

ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়: বাংলাদেশ
তবে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব এবং অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল খুরশেদ আলম বলছেন, মিয়ানমারের ব্যাখ্যা এবং অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।

আরাকান আর্মি বা আরসা সীমান্তে মর্টার হামলা করেছে বলে তারা (মিয়ানমার) যে ব্যাখ্যা দেয়, তা গ্রহণযোগ্য নয়।”

“আমরা তাদেরকে বলেছি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স নীতি। আমরা কাউকে আশ্রয় প্রশ্রয় দেই না। এটা আপনারা (মিয়ানমারকে) ভারতকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন,” তিনি বলেন।

“আমাদের (বাংলাদেশের) ভূমি ব্যবহার করে অন্য কারও বা কোন দেশের ক্ষতি করবে – এটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কখনও অনুমোদন করেননি এবং কখনও তা করবেন না।”

তিনি আরও জানান, মিয়ানমার বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের সীমানায় আরাকান আর্মির বাঙ্কার রয়েছে বলে কিছু জায়গার তথ্য দিয়েছিল। কিন্ত সেগুলো খতিয়ে দেখে কখনই এসব তথ্যের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।

‘মিয়ারমারের লক্ষ্য শূন্য রেখায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প’:
খুরশেদ আলমের বক্তব্য হচ্ছে, মিয়ানমার এসব বক্তব্য দিয়ে নিজের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে।

এর ব্যাখ্যায় মি. আলম বলেন, সীমান্তের শূন্যরেখায় কোণাপাড়া এলাকায় রোহিঙ্গাদের যে ক্যাম্পটা আছে, যেখানে তাদের (মিয়ানমার) গোলাগুলি হচ্ছে, এই ক্যাম্পটা অর্ধেক অংশ মিয়ানমারের ভেতরে। বাকি অর্ধেক বাংলাদেশের সীমান্তের কাছে।

“আমরা বলি, এই ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঢুকতে দেইনি। তারা মিয়ানমারের ভেতররই আছে।

“সেজন্য এই ক্যাম্পটা আগেও কয়েকবার তারা (মিয়ানমার) উঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে। এখন সীমান্তের অন্য এলাকাসহ এই ক্যাম্পে তারা (মিয়ানমার) উদ্দেশ্য নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গোলাগুলি করছে,” বলেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব।

এই রোহিঙ্গা ক্যাম্পটি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু এলাকায় মিয়ানমারের সাথে সীমান্তের শূন্যরেখায়, এই ক্যাম্পেই গত শুক্রবার মিয়ানমার থেকে আসা মর্টার শেল বিস্ফোরণে একজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়।

বাংলাদেশ এর প্রতিবাদ করার পরও মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলি অব্যাহত রয়েছে।

‘মিয়ানমারের ফাঁদে বাংলাদেশ পা দেবে না’:
রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেয়ার জন্য মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে উস্কানি দিয়ে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্য বাংলাদেশকে জড়াতে চাইছে বলে বাংলাদেশ মনে করছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত সোমবার ঢাকায় আসিয়ান জোটের দেশগুলোর কূটনীতিকদের কাছে নিজের অবস্থান তুলে ধরেছে।

মঙ্গলবার এই জোটের বাইরে অন্য সব দেশের মিশন প্রধানদের নিয়েও পররাষ্ট্র মন্ত্রলয়ের কর্মকর্তারা বৈঠক করেন।

সেই বৈঠকের পর ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খুরশেদ আলম বলেন, মিয়ানমারের উস্কানিতে বা ফাঁদে পা না দিয়ে বাংলাদেশ বিষয়টাতে কূটনৈতিকভাবে সমাধান চাইছে।

তিনি বলেন, “সীমান্তে মিয়ানমারের উস্কানির মুখেও বাংলাদেশ যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে, আমাদের সাথে বৈঠকে বিদেশি কূটনীতিকরা সেটার প্রশংসা করেছেন।

“দু’একজন (বিদেশি কূটনীতিক) আমাদের জিজ্ঞাসাও করেছেন যে আমরা শক্ত অ্যাকশন নিচ্ছিনা কেন – কিন্তু আমরা বলেছি, শক্ত অ্যাকশন নিলে তারা (মিয়ানমার) বলবে যে আমরা আরাকান আর্মিকে সার্পোট করছি।

“এছাড়া আমাদের মুল উদ্দেশ্য যেটা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো, সেটা বাধাগ্রস্ত হবে, যেটা আমরা চাই না। এজন্যই আমরা শক্ত অবস্থানে যাইনি,” বলেন খুরশেদ আলম।

‘বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশের পাশে থাকবে’
তিনি আরও জানান, তাদের বক্তব্য শুনে বা বাংলাদেশের অবস্থান জানার পর বিদেশি কূটনীতিকরা আশ্বস্ত করেছেন যে তাদের প্রত্যেকে দেশ বাংলাদেশের পাশে থাকবে।

অন্যদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কয়েকদিন আগেই বলেছেন, মিয়ানমারের সাথে সীমান্তে উত্তেজনার বিষয়টি বাংলাদেশ জাতিসংঘে উত্থাপন করবে।

এখন ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব খুরশেদ আলম জানিয়েছেন, মিয়ানমারের এই সীমান্ত ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ যে জাতিসংঘে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে বিদেশি কূটনীতিকরা বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।

কূটনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

সাবেক একজন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বিবিসিকে বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোই পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।

“মনে হচ্ছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।”

এদিকে, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাতেই তারা মিয়ানমার থেকে থেমে থেমে গুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন।

সীমান্তের শূন্যরেখায় থাকা ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের একজন নেতা তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তুলে ধরে জাতিসংঘের মহাসচিবের প্রতি চিঠি লিখেছেন বলে জানা গেছে

Exit mobile version