হঠাৎ লবণের দরপতন, প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায় চাষীরা

fec-image

মাঠে লবণ উৎপাদন হতে না হতেই দরপতন শুরু হয়েছে। সিন্ডিকেটের কারণে সপ্তাহের ব্যবধানে মাঠ পর্যায়ে দাম কমেছে প্রায় সাড়ে ৩০০ টাকা। অথচ ৮০ কেজির বস্তা লবণের দাম ছিল ৮০০ টাকা। এই ধারা অব্যাহত থাকলে দেশি লবণশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। মাঠে মার খাবে চাষীরা। দেশের সম্ভাবনাময় এই খাতকে বাঁচাতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন চাষীরা।

এবিষয়ে মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেছেন কক্সবাজার লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। লিখিত বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সমন্বয়ক এডভোকেট শহীদুল্লাহ্।

তিনি বলেন, চলতি মৌসুমে প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুকুলে থাকায় দেশি উৎপাদিত লবণ দেশের মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হওয়ায় কিছু অসাধু মিল মালিক বিদেশী লবণ আমদানিতে ব্যর্থ হয়ে সিন্ডিকেট করে চাষিদের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করছে। তারা চাষীদের লবণ চাষে অনুৎসাহিত করে বিদেশী লবণের উপর দেশকে নির্ভরশীল করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এই মুহূর্তে ষড়যন্ত্র বন্ধ করা না গেলে দেশি লবণ শিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে।

লবণচাষীদের তথ্য হলো, একজন লবণ চাষী ৩ কানি জমিতে চাষ করতে সক্ষম। সেই অনুপাতে গেলো বছর লবণ মাঠের মূল্য প্রতি কানি ১৮ হাজার টাকা হিসাবে ৩ কানিতে ৫৪ হাজার টাকা লাগিয়ত মূল্য দিতে হয়। পানি দেয়ার জন্য মেশিনের জ্বালানি খরচ পড়েছে কানি প্রতি ২ হাজার ৫০০ টাকা করে ৩ কানিতে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। পলিথিন বাবদ প্রতিকেজি ৭০ টাকা হিসাবে (প্রতিকানিতে ৬৫ পাউন্ড) প্রতিকানিতে ৪ হাজার ৫৫০ টাকা করে ৩ কানিতে ১৩ হাজার ৬৫০ টাকা এবং খাওয়া-দাওয়া বেতন বাবদ ২০ হাজার টাকা। এক মৌসুমে (৫ মাসে) এক লাখ টাকা মতো শ্রমিক খরচ পড়ে।

সেই হিসাবে ৩ কানি জমিতে উৎপাদন খরচ পড়ে ১ লাখ ৭৫ হাজার ১৫০ টাকা। প্রতি কানিতে সর্বোচ্চ ২৫০ মণ হিসেবে ৩ কানি লবণ উৎপাদন হয় ৭৫০ মণ। সুতরাং, প্রতি মণে উৎপাদন খরচ পড়ে প্রায় ২৩৪ টাকা। মণ প্রতি লেবার চার্জ ও ইউপি ট্যাক্স ৩৩ টাকা, তার সাথে মণ প্রতি ঢাকার বোট ভাড়া ৫০ টাকা যোগ হলে লবণের উৎপাদন মূল্য দাঁড়ায় মণপ্রতি ৩১৭ টাকা।

লবণের মূল্য ২৫০ টাকা হলে প্রতিমণ লবণে চাষীদের উৎপাদন ঘাটতি হয় ৬৭ টাকা। ৩ কানি জমিতে ৭৫০ মণ লবণের ঘাটতি (একজন চাষার ক্ষতি) ৫০ হাজার ২৫০ টাকা। এই ক্ষতি পোষাতে না পেরে চাষীরা যে কোন মুহূর্তে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে পারেন।

দেশি লবণ চাষীরা যখন চলতি মৌসুমে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিতে আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করে ঐকান্তিক পরিশ্রম করে প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে গুটিকয়েক অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট করে লবণের মূল্য কমিয়ে দেয়ার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছেন। তারা চায়, উৎপাদন খরচ মেটাতে ব্যর্থ হয়ে লবণ চাষিরা অনুৎসাহিত হয়ে লবণ মাঠ ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন। তখন দেশীয় লবণ উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে বিদেশী লবণের উপর দেশকে আমদানি নির্ভর করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করতে চাইছে মিল মালিক চক্রটি।

কক্সবাজার ও বাঁশখালীর কিছু অংশ নিয়ে প্রায় ৫৭ হাজার ২৭০ একর জমিতে অন্তত ৫৫ হাজার লোক লবণ চাষে জড়িত। এছাড়া লবণের উপর বিভিন্ন ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষ। ফলে দেশি লবণ শিল্প ধ্বংস হলে বেকার হবে হাজারো মানুষ, যাদের বিকল্প পেশা নেই।

দেশে প্রচুর পরিমাণ লবণ মজুদ আছে। তবু অসাধু মিল মালিক সিন্ডিকেট লবণের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে চলতি মৌসুমে লবণ সংকটের ভুল তথ্য উত্থাপন করে সরকারের বিভিন্ন মহলকে চাপ সৃষ্টি করলে ২০২১ সালের নভেম্বরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল সভার (জুম মিটিং) আয়োজন করলে ভোক্তা, লবণ চাষী ও ব্যবসায়ীদের মতামত গ্রহণ করে বিসিকের দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে সর্বসম্মতিক্রমে ‘লবণ আমদানির প্রয়োজন নাই’ মর্মে সিদ্ধান্ত হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু অসাধু গুটিকয়েক মিল মালিক সিন্ডিকেট লবণ সংকটের বিষয় উপস্থাপন করে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে আবারও চাপ সৃষ্টি করলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিবের সভাপতিত্বে গত ২৭ জানুয়ারি পুণরায় জুম মিটিং হয়। ওই সভায়ও চাষী প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি এবং লবণের সাথে সম্পৃক্ত গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিগণ জুম মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে ‘লবণের সংকট না হওয়ার নিশ্চয়তা’ প্রদান করে বক্তব্য উপস্থাপন করলে লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র আবারও নস্যাৎ হয়ে যায়।

অসাধু সিন্ডিকেটটি লবণ আমদানির জন্য সরকারের বিভিন্ন মহলে চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখেন। এতে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার শহরের হিলডাউন সার্কিট হাউসে পুনরায় ‘লবণ আমদানির প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা’ যাচাইয়ে সকলের সাথে মতবিনিময় করেন। ওই সভায় উপস্থিত সকলে দেশে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন এবং এ বছর লবণ ঘাটতি হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই মর্মে নিশ্চয়তা দিয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন এবং আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূলে থাকলে দেশীয় উৎপাদিত লবণ চাহিদা পূরণ করে উদ্বৃত্ত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এতে মিল মালিক সিন্ডিকেটের লবণ আমদানির ষড়যন্ত্র তৃতীয়বারের মতো নস্যাৎ হয়ে যায়।

লবণ মিল মালিক সিন্ডিকেটটি দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টার পরও লবণ আমদানিতে ব্যর্থ হয়ে গুটিকয়েক মিল মালিক আবারও সিন্ডিকেট তৈরি করে লবণের ক্রয়মূল্য উৎপাদন মূল্যের চেয়ে কম করে বাজার মূল্য নির্ধারণ করে চাষীদের লবণ বিক্রি করতে বাধ্য করছেন।

এতে চাষীরা অতিমাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে ব্যর্থ হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

এখানে উল্লেখ করা দরকার, দেশি লবণের মূল্য সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কমিয়ে রাখলেও মিল মালিকদের ভোজ্য সল্ট (খাবার লবণ) প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বাজার মূল্য রাখা হয়। দেশি লবণ চাষীদের কাছ থেকে কম মূল্যে কিনলেও খাবার লবণের কোন মূল্য কখনোই কম রাখা হয় না।

প্রতি কেজি লবণের মূল্য ১০টাকা হলে ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে মর্মে প্রস্তাব উত্থাপন করে জেলা প্রশাসন। কিন্তু সিন্ডিকেটের চাপের কারণে প্রস্তাবনা কার্যকর হয়নি।

প্রধানমন্ত্রী, শিল্প মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভুক্তভোগীরা জানান, লবণ নীতি অনুসরণ করে দেশি লবণের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণপূর্বক দেশি শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

অসাধু সিন্ডিকেটের দেশ বিরোধী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে ৫৫ হাজার চাষীকে রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ।

সংবাদ সম্মেলনে লবণ চাষী ও ব্যবসায়ী সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে মিজানুর রহমান চৌধুরী খোকন মিয়া, কলিম উল্লাহ কলি, সোয়াইবুল ইসলাম সবুজ, ইউসুফ বদরীসহ সংশ্লিষ্টরা বক্তব্য রাখেন।

তারা বলেন, ফেব্রুয়ারীতে ব্যবসায়ীরা যে দামে লবণ কিনে প্যাকেটে বাজারজাত করেছিল এখন অর্ধেক কম দামে কিনেও প্যাকেট লবণের দাম একই। এসিআই, মোল্লা, ফ্রেশ, সিটি এই চারটি কোম্পানির সিন্ডিকেটের কারণে লবণের ক্ষতি হচ্ছে।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন