parbattanews

২০২২ সালে নানাভাবে আলোচিত ছিল খাগড়াছড়ি

খাগড়াছড়ি নানাভাবে আলোচিত ছিল ২০২২ সাল। মায়ের সামনে স্কুলের গেট চাপায় শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্মাণাধীন ভবনের ক্যান্টিলিভার ধসে দুই শ্রমিক নিহত ও পাঁচ শ্রমিক আহত, অভাবের তাড়নায় নিজ সন্তানকে বিক্রির জন্য বাজারে নেওয়া, শিক্ষা কর্মকর্তা ও শিক্ষিকার প্রেম-রোমাঞ্চ বিয়ে। এছাড়াও মারামারি ও মামলা, আঞ্চলিক সংগঠনের সংঘাত, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার, মাদকদ্রব্য ধ্বংস, ভারতীয় পণ্য উদ্ধার, পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যু, কর্মসূচিকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সংঘাত, ১৪৪ ধারা জারি। এতো কিছু ঘটনার মধ্যেও আছে কিছু বিশেষ অর্জনও।

হিমালয়কন্যা নেপাল জয় করে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া খাগড়াছড়ির তিন কৃতি ফুটবলার আনাই, আনুচিং, মনিকা ও সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমাকে বীরোচিত সংবর্ধনা। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে সারা দেশের নবনির্মিত শতাধিক সেতুর সাথে দীর্ঘ প্রত্যাশিত খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন সড়কে ১শ ৮৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৪২টি সেতুর উদ্বোধন।

মায়ের সামনেই স্কুল গেট চাপায় নিহত শিশু

১০ আগস্ট সকালবেলা। মায়ের হাত ধরে খাগড়াছড়ি খবং পুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেটে পৌঁছায় শ্রাবণ। গেটের সামনে পৌঁছানো মাত্রই মায়ের সমানে বিদ্যালয়ের গেট চাপায় শ্রাবণ নিহত হয়। আলোচিত হৃদয় বিদারক এ ঘটনায় গঠিত হয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি। কিন্তু দীর্ঘ দিন পার হয়ে গেলেও গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। কিংবা দায়ীদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।

জেলা পরিষদ ভবনের ছাদ ধসে নিহত ২

৮ অক্টোবর বিকাল পৌনে ৪টার দিকে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের নতুন প্রশাসনিক ভবনের নির্মাণ কাজ চলছিলো। হঠাৎ কেন্ডিলিভারের ছাদ ধসে দুই নির্মাণ শ্রমিক নিহত ও অপর ৫ জন আহত হন। গত ৬ ডিসেম্বর দুই মাস পর শ্রমিকদের মাঝি জালাল খান খাগড়াছড়ি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে উল্লেখিত ৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন।

‘সন্তান বিক্রি’ করতে বাজারে তুললেন মা

১১ আগস্ট খাগড়াছড়ি জেলার ভাইবোনছড়ার পাকোজ্জ্যাছড়ি গ্রামের সোনালি চাকমা নিজের ৬ বছরের সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমাকে বাজারে বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। তিনি ছেলের দাম চান ১২ হাজার টাকা। এ খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে নজরে আসে জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের। পরিবারটির জন্য আর্থিক সহায়তা নিয়ে ছুটে যান সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য বাসন্তী চাকমা।

তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস তার দপ্তরে ডেকে এনে অসহায়-অসুস্থ এবং চালচুলোহীন মা সোনালি চাকমার হাতে এক লাখ টাকার চেক তুলে দেন। এছাড়া সোনালি চাকমাকে প্রধানমন্ত্রীর উপহার ২ লাখ ৬০ হাজার টাকার দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি ঘর প্রদান করা হয়। এছাড়াও শিশু সন্তান রামকৃষ্ণ চাকমার ভবিষ্যত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারি শিশু পরিবারে রাখা, সোনালি চাকমার সু-চিকিৎসা ও তাকে প্রতিবন্দি ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

শিক্ষিকা-শিক্ষা অফিসারের মারামারি

১৬ আগস্ট খাগড়াছড়িতে শিক্ষা অফিসার সুভায়ন খীসা ও মহালছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মৌসুমি ত্রিপুরার মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। এর পর প্রেম-রোমাঞ্চ, বিয়ে ও অবশেষে মামলা নিয়ে নেট দুনিয়ায় তোলপাড় হয়। দুই জনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বহুছবি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠনগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতে হতাহত

২০২২ সালে খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক সংগঠনের সংঘাতে বেশ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। তার মধ্যে ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে খাগড়াছড়ির গুইমারায় প্রতিপক্ষের গুলিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ প্রসীত) গ্রুপের সংগঠক অংথোই মারমা নিহত হন। এ ঘটনায় পরে খাগড়াছড়ির পাঁচ উপজেলায় আধাবেলা সড়ক অবরোধের নামে ইউপিডিএফ গাড়িতে আগুন ও গুলিবর্ষণসহ ব্যাপক তাণ্ডবলীলা চালায়।

সরকারের কাছে ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের আলোচনার প্রস্তাব

২০২২ সালে ইউপিডিএফ প্রসীত ও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএসের মধ্যকার দীর্ঘদিনের সমঝোতা ভেঙ্গে যায়। ইউপিডিএফের সঙ্গে সরকারের সংলাপ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ৯ জুন ইউপিডিএফ সরকারের কাছে একটি দাবিনামা পেশ করে। দাবিনামা পেশ করার এক দিন পরেই জেএসএস ও ইউপিডিএফের মধ্যে বিরোধ প্রকাশ্যে আসে।

১১ জুন থেকে দুটি সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কয়েক দফা বন্দুকযুদ্ধ হয়। ১২ জুলাই দীঘিনালায় ইউপিডিএফের সংগঠক জীবন ত্রিপুরা (২৬) এবং ১৮ জুলাই শরৎজ্যোতি চাকমা (১৯) নামে ইউপিডিএফের দুই কর্মীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়াও খাগড়াছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে অস্ত্রসহ বেশ কয়েকজন ইউপিডিএফ প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীকে আটক করা হয়।

ভারতীয় পণ্য আটক

২০২২ সালে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, মাটিরাঙ্গা, রামগড় ও পানছড়িতে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় পণ্য ও মাদক আটক হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ১৩ অক্টোবর রাতে খাগড়াছড়িতে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচারের উদ্দেশ্যে রাখা প্রায় ৬০ লাখ টাকার ভারতীয় পণ্য আটক করে জেলা প্রশাসন ও বিজিবি। আটক পণ্যের মধ্যে ছিল ১০টি বৌদ্ধমূর্তি, ১ হাজার ১১০ পিস ভারতীয় শাড়ি, ৩৪ সেট ভারতীয় চীবর, ৮৩৮ বক্স বিদেশি সিগারেট ও ২০০ পিস লুঙ্গী। এ সময় এসএ পরিবহনের ৩ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে আটক করা হয়। এছাড়াও জেলার মাটিরাঙ্গা, রামগড় ও পানিছড়িতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের পৃথক অভিযানে কয়েক কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ি, মাদক সিগারেট জব্দ করা হয়েছে।

গাঁজা ক্ষেত ধ্বংস

২০২২ সালেও খাগড়াছড়িতে সেনাবাহিনীর অভিযানে গাঁজা ক্ষেত ধ্বংসের অভিযান অব্যাহত ছিল। মহালছড়ি সেনা জোনের অভিযানে ধইল্লাপাড়া এলাকায় শত বিঘা গাঁজা ক্ষেত ধ্বংস করা হয়। ২ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ি সেনা রিজিয়নের আওতাধীন মহালছড়ি জোনের বিজিতলা সাবজোনের সদস্যরা ধইল্লাপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ১০০ বিঘা জমির গাঁজা ক্ষেত ধবংস করে। এছাড়াও ১৭ ডিসেম্বর মহালছড়ি জোনের সেনা সদস্যরা উপজেলার কলাবুনিয়া ছড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে প্রায় ৬-৮ বিঘা পরিমাণ গাঁজা ক্ষেত ধ্বংস করে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গহিন অরণ্য ও দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেখানে তুলনামূলক জনবসতি কম সে সকল জায়গা মাদক ব্যবসায়ীরা নিরাপদ এলাকা হিসাবে বেছে নেয়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, অস্ত্র ক্রয় ও তাদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে মাদক ব্যবসা থেকে অর্জিত অর্থ ব্যয় করা হয়ে থাকে। ধইল্লাপাড়া এলাকাটি প্রত্যন্ত ও দুর্গম হওয়ায় এই এলাকায় জনসাধারণের চলাচল নেই বললেই চলে।

ফুটবল কন্যাদের সংবর্ধনা

হিমালয় জয় করে সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়া খাগড়াছড়ির তিন কৃতি ফুটবলার আনাই, আনুচিং, মনিকা ও সহকারী কোচ তৃষ্ণা চাকমাকে ৩০ সেপ্টেম্বর নিজ জেলা খাগড়াছড়িতে বীরোচিত সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সুসজ্জিত একটি ছাদ খোলা গাড়িতে করে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রাসহ পুরো শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। পরে ঐতিহাসিক খাগড়াছড়ি স্টেডিয়ামে খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থার উদ্যোগে সম্মানমা স্মারক দেওয়া হয়। খাগড়াছড়ির তিন কৃতি ফুটবল কন্যা ও কোচ তৃষ্ণা চাকমাকে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস ৪ লাখ টাকা পুরস্কারের চেক হস্তান্তর করেন।

৪২টি সেতু উদ্বোধন

৭ নভেম্বর সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে সারা দেশে নবনির্মিত শতাধিক সেতুর সাথে দীর্ঘ প্রত্যাশিত খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন সড়কে ১শ ৮৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৪২টি সেতু উদ্বোধন করেন। সেতু উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে খাগড়াছড়ি ছিল সাজ সাজ রব। খাগড়াছড়ি জেলা শহর ব্যানার ও ফেস্টুন দিয়ে বর্ণিল সাজে সাজানো হয়। খাগড়াছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সাজানো হয় উদ্বোধনী মঞ্চ। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে মুগ্ধ হন।

একই দিনে শত সেতুর উদ্বোধনকে ঐতিহাসিক মন্তব্য করে এসময় শেখ হাসিনা বলেন, ‘পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তি চুক্তি করা হয়েছে। এ চুক্তির পর পাহাড়ের চিত্র বদলে গেছে। পাহাড়ের মানুষ আর পিছিয়ে নেই। সারা দেশের উন্নয়নই আমাদের লক্ষ্য। এ সেতুগুলো নির্মাণের মাধ্যমে নিরাপদ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। সেতুগুলো উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে, ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন গতি আসবে।’

পানিতে ডুবে ১০ শিশুর মৃত্যু, অন্যান্য হত্যাকাণ্ড

২০২২ সালে খাগড়াছড়িতে পানিতে ডুবে শিশুসহ অন্তত ১০ জন মারা গেছে। এছাড়ও পারিবারিক দ্বন্দ্বে জেলায় বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা না দেয়ায় কথা কাটাকাটির জেরে প্রবাসী বড় ভাইকে কুপিয়ে হত্যা করে ছোট ভাই মো. মোস্তাফিজুর রহমান (১৯)। এ ঘটনায় ১১ ডিসেম্বর রাতে মানিকছড়ি উপজেলার সেমুতাং গ্যাসফিল্ড এলাকায় নিজের বাড়ির শোয়ার ঘর থেকে প্রবাসী সাজ্জাদের গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ঘটনার তদন্তে করে জানা যায়, মূলত বড় ভাই সাজ্জাদের কাছে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা চায় ছোট ভাই মোস্তাফিজুর। সাজ্জাদ তা দিতে অস্বীকৃতি জানালে দু’জনের মধ্যে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে সাজ্জাদ ছোট ভাইকে হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মোস্তাফিজুর বড় ভাইকে গলাকেটে হত্যা করে।

Exit mobile version