parbattanews

৩০ বছর ধরে গান গেয়ে সংসার চালান অন্ধ অন্ন জলদাশ

কখনো পাঁচশ কখনো বা এক হাজার টাকা আবার কোন সময় খালি হাতে ঘরে ফিরে যান দৃষ্টিহীন শিল্পী। সারাদিন বান্দরবানের নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে সিড়িঁতে আবার কখনো সড়কের পাশে পাহাড়ের ধারে আসর বসিয়ে ঢোল বাঁজিয়ে নিজের সুরেলা কণ্ঠে গান শোনাচ্ছেন তিনি। সন্ধ্যায় নেমে আসলে ফিরে যান নিজ বাড়িতে। আবার সকাল হলে গাড়ি যোগে ছুঁটে আসেন যৌথ খামার মুখে। সেখানে নেমে কখনো পায়ে হেঁটে আবার কারো সাহায্য পেলে চলে আসেন গাড়ি করে। তবে প্রায় সময় সন্তানের কাধেঁ উপর হাত দিয়ে কয়েক মেইল পথ হেটে ছুঁটে যান নীলাচল কেন্দ্রে পর্যটকদের আনন্দ দিতে।

সারাদিন নীলাচলে বসে ঢোল বাঁজিয়ে গান শুনাচ্ছেন অনেক জনকে। তার গলার মিষ্টি কণ্ঠে গানের সাথে তাল মিলিয়ে আনন্দে মেতে উঠেন পর্যটকরা। তাদের অনুরোধে বিভিন্ন গান গেয়ে শোনান দৃষ্টিহীন এই শিল্পী। তার ঢোলে গানের সুরে মুখরিত হয়ে উঠে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রটি। কখনো বাউল, আবার আঞ্চলিক, মুর্শিদি, বিচ্ছেদ ও পল্লী গান গেয়ে থেকেন। তার গানের খুশি হয়ে যা দিয়ে যান সেটি তার আয়। এভাবে টানা ৩০ বছর ধরে বান্দরবানের নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে বসে ঢোল বাঁজিয়ে গান শুনিয়ে আনন্দ দিয়ে আসছে তিনি। দিনশেষে যেসব টাকা উপার্জন করেন সেসব টাকায় টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

অন্ন জলদাশের চোখ হারিয়েছে আট বছর বয়সে। টাইফয়েড রোগের পাশপাশি অন্যান্য রোগের আক্রান্ত হওয়ার পর অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি। তান্ত্রিক ঔষধদের উপর নির্ভর করে তবুও চোখের দৃষ্টি ফেরাতে পারেননি। তখন থেকে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। তারপরেও হার মানেননি, অন্ধ হয়েও ভিক্ষা না করে গান শুনিয়ে আয় উপার্জন করছেন। তার একমাত্র সম্বল কাঁধের ঝুলে থাকা ঢোল। তার এই ঢোলের শব্দ শুনে ছুঁটে আসেন পর্যটকরা। আনন্দে মেতে উঠেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। সারাদিন গান শুনিয়ে যেসব আয় করেন সেসব টাকা দিয়ে তার সংসার চলে। তবে পর্যটক না থাকলে অনেক সময় খালি হাতে ফিরিয়ে যান। তবে তার গান শুনতে অপেক্ষায় প্রহরে থাকেন স্থানীয়সহ পর্যটকরাও।

দৃষ্টিহীন শিল্পীর অন্ন জলদাশের বয়স এখন চল্লিশ বছর। বসবাস করেন সাতকানিয়া উপজেলার ধর্মপুর গ্রামে। তার নিজ গ্রামে সম্পত্তি বলতে কোন কিছু নাই। নিজের সর্বশেষ সম্বল একটি বাড়ি। সেখানে পরিবারের সবাই বসবাস করেন। মাঝে মধ্যে এনজিও থেকে লোন নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। বাড়িতে তার তিন সন্তান রয়েছে। তারা পড়ালেখা জানেন না। পরিবার দরিদ্র হওয়ার কারণে সন্তানদের পড়ালেখা শিখাতে পারেননি। সন্তানরা সাহায্য করতে প্রতিদিন বাবার সাথে করে নীলাচলে আসেন। বিকাল গড়িয়ে গেলে আবার ছেলের কাঁধ ধরে বাড়িতে ফিয়ে যান। সাতকানিয়া থেকে যৌথ খামারের মুখে আসতে প্রতিদিন তার খরচ হয় দুইশত মাঝে মধ্যে আবার বিনামূল্যে নিয়ে আসেন চালকরা। নীলাচলে সারাদিন বসে থাকেন গান শোনাতে। কিন্তু কখনো খাওয়া হয় আবার কখনো পানি খেয়ে দিন পার করেন। নীলাচলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের আনন্দ দিতে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুঁটে যান তিনি।

ঘুরতে আসা পর্যটক কামাল, ইমন, শফিকুলসহ বেশ কয়েকজন শ্রোতা সাথে কথা হয়। তারা জানিয়েছেন, নীলাচলে ঘুরতে আসলে দৃষ্টিহীন শিল্পীর গান শোনেন সবাই। তার ঢোলের ও মধুর কণ্ঠের গান শুনে সবাই আনন্দ পান। তার গান শুনে অনেকে তাকে বিশ টাকা থেকে শুরু করে পাঁচশ টাকাও দিয়ে যায়। এভাবেই গান গেয়ে যে আয় হয় তা দিয়ে চলে তার সংসার। ইচ্ছেমতো গান শোনা হলে তারপর যাই। তবে যে যার স্থান থেকে সহযোগিতা হাত বাড়ানো জন্য সকলের প্রতি মিনতি করেন পর্যটকরা।

নীলাচলে চায়ের দোকানদার সুস্মিতা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, প্রতিদিন সকাল হলেই নীলাচলে চলে আসেন গান শোনাতে। মাঝে মধ্যে একা আবার অনেক সময় তার সন্তানকে সাথে নিয়ে আসে। সারাদিন সিঁড়িতে বসে ঢোল বাজিয়ে গান শোনান পর্যটকদের। অনেকে খুশি হয়ে টাকা দিয়ে যায়। সন্ধ্যায় হলে আবার চলে যায়। সহযোগিতা হাত বাড়িয়ে দিলে তার জন্য খুব ভালো হয়।

কথা হয় দৃষ্টিহীন শিল্পীর অন্ন জলদাশের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছোটবেলায় টাকার অভাবে চিকিৎসা করতে না পেরে তার দুই চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। এরপর থেকে একটি বাউল শিল্পীর কাছ থেকে গান শেখেন। পরে তাকে বিভিন্ন স্থানে গান করতে ভাড়া করে নিয়ে যায়। যা পান তাই দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। তাছাড়া বিগত ৩০ বছর ধরে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রে গান শুনিয়ে আসছেন। কখনো বাউল আবার কখনো আঞ্চলিকসহ নানা পদের গান। তার গান শুনে পর্যটকরা ২০ টাকা থেকে শুরু করে যা দিয়ে যায় সেটি তার আয়। কখনো পাঁচশ বার কখনো এক হাজার পান। মাঝে মধ্যে খালি হাতে ফিরে গেছেন।

অন্ন জলদাশ বলেন, আমার চোখ হারিয়েও থেমে থাকেনি। ভিক্ষা করতে আমার লজ্জা লাগে। তাই গান গেয়ে সবাইকে শোনায়। পরিবারের তিনজন ছেলে মেয়ে আছে। টাকার অভাবে কাউকে পড়ালেখা শেখাতে পারেনি। সংসারের আমি একজন অর্থ উপার্জন করি। আর সবাই এখনো নাবালক। প্রতিদিন নীলাচলে ছেলেদের নিয়ে এসে বসে সবাইকে গান শোনাচ্ছি। সন্ধায় হলে বাড়িতে ফিরে যায়। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে পাননি কোনো সহযোগিতা। তাই প্রধানমন্ত্রীসহ সমাজের বিত্তবানদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন অন্ন জলদাশ। একটু সহযোগিতা পেলে হয়তো শেষ বয়সটা শান্তিতে কাটাতে পারতেন তিনি।

ছবি: পর্যটকদের ঢোল বাঁজিয়ে গান শোনাচ্ছেন অন্ন জলদাশ। গতকাল বিকালে নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র থেকে তোলা।

Exit mobile version