পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পাহাড়, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র ধ্বংস করে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে দালান-কোটা ও স্থাপনা। দ্রুতই পরিবর্তন হচ্ছে জলবায়ু। ভূ-গর্ভস্থ পানির লেয়ার চলে যাচ্ছে গভীরে।
গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সাগরপাড়ের কলাতলী এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়েছে সাগরপাড়ের ৩ শতাধিক আবাসিক হোটেল ও আশপাশের বাসাবাড়ির অসংখ্য পানির পাম্প। বিশুদ্ধ ও সুপেয় পানির সংকট দেখা যাচ্ছে প্রায় এলাকায়।
তথ্য মতে, কক্সবাজার জেলায় ৩০ হাজার নলকুপের ১১৫৯টি অকেজো হয়ে পড়েছে। পানি উঠছে না হাজার খানেক নলকুপে। দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ায় পানির সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। সদরের খুরুশকুলে স্থাপিত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পেও সুপেয় পানি মিলছে না। ভোগান্তি বেড়েছে বিশ্বের বৃহৎ মানবিক আশ্রয়ণ এলাকা উখিয়া-টেকনাফে। এমনকি কক্সবাজার পৌরসভার অনেক এলাকায় খাবার পানির নলকূপে লবণাক্ততা ধরা পড়ছে।
এদিকে, সুপেয় পানির ‘ঘনীভূত সংকট’ দূর করতে ‘সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ এর কাজ শুরু করছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। কক্সবাজার সদরের ঝিলংজা চান্দেরপাড়া সংলগ্ন বাঁকখালী তীরে ২ একর জমিতে ‘সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ হচ্ছে। চান্দেরপাড়া থেকে শহরের সুগন্ধা পয়েন্ট পর্যন্ত ৩৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকাজুড়ে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও পাইপ লাইনের কাজ চলছে। কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ ময়দান, সুগন্ধা পয়েন্ট, হাশমিয়া মাদরাসা- এই ৫টি পয়েন্টে ‘ওভার হেড’ বা উচ্চ জলাধারে স্থাপন করা হচ্ছে। প্রকল্পের কাজ ইতোমধ্যে ৭০ শতাংশের অধিক সম্পন্ন হয়েছে। ২০২২ সালের জুন নাগাদ সুফল পাবে পৌরবাসী।
শহরের মোহাজেরপাড়ায় স্থাপিত টাংকির পাহাড়ে নির্মিত হচ্ছে ‘ওয়াটার রিজার্ভার’, যাতে ৪০ লাখ লিটার পানি জমা থাকবে। বিশেষ মূহূর্তে সেখান থেকে পুরো শহরে পানি সরবরাহ করা যাবে। জরুরি সহায়তা প্রকল্পে (ইএপি) প্রায় শতকোটি টাকা অর্থায়ন করছে এডিবি।
কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর অফিস সুত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন ২ কোটি ৪০ লাখ লিটার পানি পরিশোধন করবে, এমন উচ্চ ক্ষমতার সরঞ্জাম যুক্ত করা হচ্ছে। শহরের ৩০০ হোটেল টার্গেটে সুগন্ধা পয়েন্টে নির্মিত হচ্ছে ৭ লাখ লিটার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন উচ্চ জলাধার।
মূল ট্রিটমেন্ট প্লান্ট থেকে সরবরাহকৃত পরিশোধিত পানি মোহাজেরপাড়ায় স্থাপিত টাংকির পাহাড়ে ‘অভার গ্রাউন্ডে’ জমা হবে, যেটি ৪০ লাখ পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন। সেখান থেকে কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, ঈদগাহ ময়দান, সুগন্ধা পয়েন্ট, হাশমিয়া মাদরাসা- এই ৫টি পয়েন্টে বসানো ‘ওভার হেড’ বা উচ্চ জলাধারে জমা থাকবে। ওখান থেকে আশপাশের এলাকায় সরবরাহ করা হবে।
পানি সংগ্রহ ও সরবরাহ প্রক্রিয়া:
প্রথমে সরাসরি বাঁকখালী নদী থেকে পানি সংগ্রহ করা হবে। তা জমা হবে ইনটেক পাম্প স্টেশনে। তার জন্য স্থাপন করা হয়েছে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি। যার মাধ্যমে পানি ও আবর্জনা আলাদা করা হবে। সংগৃহীত পানি ‘রেপিড মিক্সিং’ তথা বিশেষ প্রক্রিয়ায় পরিশোধন হবে। খাবার উপযুক্ত করেই ৫টি পয়েন্টে স্থাপিত ট্যাংক তথা জলাধারে পাইপ লাইনের মাধ্যমে পানি জমা করা হবে। সেখান থেকেই সরবরাহ করা হবে বিশুদ্ধ পানি।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজাদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আল আমিন বলেন, শহরের প্রায় এলাকায় দিনদিন লবণাক্ততা বাড়ছে। ‘সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’ বাস্তবায়ন হলে পৌর এলাকার আড়াই লাখ মানুষ বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি পাবে। তিনি বলেন, এডিবির শতকোটি টাকার অর্থায়নে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের জন্য এটি বৃহৎ একটি প্রকল্প।
প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আবদুল হালিম খান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক ‘সার্ফেস ওয়াটার’ বা ভূ-গর্ভস্থ পানিকে কাজে লাগাতে প্রকল্পটি হচ্ছে। যেটির সুফল পাবে পৌরবাসী।
কক্সবাজার পৌরসভার জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল বিভাগের মতে, কক্সবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকায় অসংখ্য অগভীর নলক‚প অকেজো হয়ে পড়েছে। ১০ বছর আগেও শহরের টেকপাড়ায় ১২০ থেকে ১৫০ ফুটের মধ্যে ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর পাওয়া যেত। অথচ এখন পানির জন্য যেতে হয় ৩০০ ফুটের বেশি গভীরে। গত কয়েক বছরে কক্সবাজার সাগরপাড়ের কলাতলী এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ সুপেয় পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নীচে নেমেছে। ফলে অকেজো হয়েছে সাগরপাড়ের ৩ শতাধিক আবাসিক হোটেল ও আশপাশের বাসাবাড়ির অসংখ্য পানির পাম্প। ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এমন অবস্থা বলে মনে করছে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তর। সাগরে বেয়ে পড়া প্রাকৃতিক পানি আটকিয়ে সংকট কিছুটা লাঘব সম্ভব মনে করছে পরিবেশবাদিরা।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অনাবৃষ্টি ও অতি তাপমাত্রা বলে মন্তব্য করেছেন কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী। তিনি বলেন, পৃথিবীতে পানির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ মিঠাপানি। এ মিঠাপানির ৩০ দশমিক ১ শতাংশ পানি থাকে ভূ-গর্ভে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি মাঠ-ঘাট, রাস্তা, জলাশয় ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় ও সারাবছর আমাদের পানির চাহিদা মেটায়। সূ² বালিকণা ভেদ করে মাটির নিচে জমা হয় বলে এ পানি হয় বিশুদ্ধ। বর্তমানে দুশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দেশে ক্রমাগত ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে অধিকাংশ এলাকা এখন কংক্রিটের শহর। ফলে মাটি ভেদ করে পানি নীচে পৌঁছাতে পারছে না। বৃষ্টির পানি খাল বা নদী-নালায় চলে যাচ্ছে। বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দেয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সুপেয় পানি অনেকটা নিশ্চিত হবে মনে করেন নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্বিক চৌধুরী।
তিনি বলেন, প্রতিটি ভবনে বৃষ্টির পানি রিচার্জ এবং ব্যবহারের ব্যবস্থা থাকলে ভূ-গর্ভস্থ পানি উপরে উঠতে পারে। সেই সাথে প্রাকৃতিক সম্পদও রক্ষা করা যেতে পারে। এজন্য বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে এগিয়ে আসা দরকার।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, চলমান ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট চালু হলে কক্সবাজার পৌরসভার নাগরিকদের জন্য সুপেয় খাবার পানির সমস্যা আর থাকবে না। পাশাপাশি কক্সবাজার পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের একটি দাবিও পূরণ হবে।