parbattanews

৮ ডিসেম্বর রামগড় ডাকঘরের ছাদে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ান

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের এলোপাথারি আক্রমণে বিধ্বস্ত ও পরাভূত হয়ে পাকবাহিনী লেজগুটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ৮ ডিসেম্বর ভারত সীমান্ত লাগোয়া রামগড় প্রধান ডাকঘরের ছাদের উপর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক সুলতান আহমেদের নেতৃত্বে সেদিন আমরা উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনায় লাল সবুজের এ পতাকা উত্তোলন করি । ঐদিন শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর পাওয়ার পর সীমান্তের ওপারে ত্রিপুরার সাব্রুমের কাঁঠালছড়ি ক্যাম্প থেকে নিজের রক্ষিত ঐ পতাকাটি নিয়ে এসেছিলেন সুলতান আহমেদ।

৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে ভারতীয় বিমান বাহিনীর তিনটি জেট বিমান রামগড়ে দখলদারবাহিনীর অবস্থানের উপর প্রবল বোমা বর্ষণ করে। প্রায় সাত মিনিট বোমা হামলা শেষে বিমান তিনটি ফিরে যাওয়ার সাথে সাথে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী সন্মিলিতভাবে কঠোর আক্রমন চালায় পাক হানাদারদের উপর। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় শত্রুরা। ফলে ভীতসন্ত্রস্ত পাকবাহিনীর সৈন্যরা ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে পিছু হটতে শুরু করে। ৮ ডিসেম্বর সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে আরো দুটি ভারতীয় বিমান পাকঘাঁটির উপর পাঁচ মিনিট বোমা বর্ষণ করে করে ভারতে ফিরে যায়। এতে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে পাক সেনারা। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা নিজের প্রাণ বাঁচাতে সদলবলে রামগড় থেকে পালাতে শুরু করে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাঁথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এ ইতিহাস বর্নণা করেন রামগড়ের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘২ মে রামগড় পতনের পর দীর্ঘ ৭ মাস ৬দিন পাকবাহিনীর দখলে থাকার পর ৮ ডিসেম্বর শত্রুরা অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার পর ইলিয়াছ মিয়াসহ কয়েকজন স্থানীয় মানুষ ভারত সীমান্তবর্তী ফেনী নদীঘেঁষা রামগড় থানা ঘাটে এসে জয় বাংলা স্লোগান দিতে থাকেন। সাব্রুম থানার ওসি মি. চক্রবর্তী ঐ লোকদের সাথে কথা বলে পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর মিত্রবাহিনীর কয়েকজন সদস্যসহ আমরা ২০ থেকে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ফেনী নদী পার হয়ে রামগড়ে এসে দেখি সত্যি সত্যিই শত্রুরা পালিয়ে গেছে। এসময় সবাই বিজয়োল্লাসে ফেটে পড়ি।’

তিনি বলেন, রামগড় পতনের পর ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। আসামের লোহারবন নামক ট্রেনিং সেন্টারে টানা এক মাস যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষ করে সাব্রুমের হরিণায় ফেরার পর গ্রুপ কমান্ডার হেমদারঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে (বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার) বিভিন্ন এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে অসংখ্যবার সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। অনেক যুদ্ধের মধ্যে এখনও যে যুদ্ধের কথা মনে পড়লে আজও তিনি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন তার বর্ণনা করতে গিয়ে এ বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘নভেম্বরের শেষ দিকে গ্রুপ কমান্ডার হেমদারঞ্জন ত্রিপুরার নেতৃত্বে আমরা ২০ থেক ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বৈষ্ণবপুর সীমান্ত দিয়ে নৌকায় করে ফেনী নদী পার হয়ে রামগড়ে প্রবেশ করি। সারারাত পায়ে হেঁটে ছড়া-খাল বনজঙ্গল পাড়ি দিয়ে মানিকছড়ির যোগ্যছলা ও সেম্প্রুপাড়া নামক স্থানে পৌঁছে কোন রকমে রাত কাটাই। পরদিন ভোরে পাকসেনারা তাদের অবস্থানের দিকে আসছে।এমন খবর পাওয়া মাত্রই সবাই পজিশন নিই শত্রুদের প্রতিহত করতে। সকাল ৯টার দিকে ২০০ থেকে ৩০০ জনের বিশাল শত্রুদল আমাদের নিশানার মধ্যে প্রবেশ করা মাত্রই তাদের লক্ষ্য করে শুরু করি গুলি ও হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে আক্রমণ। শত্রুরাও হাজার হাজার রাউন্ড পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। আমরা মাত্র ২৫ জনের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ প্রায় ২ ঘন্টা মোকাবেলা করি ২০০ থেকে ৩০০ জনের শত্রুপক্ষকে।

এক পর্যায়ে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গভীর বনজঙ্গলের ভিতরে নিরাপদে সরে পড়ি। এসময় ২৫ জনের গ্রুপ থেকে সমীর, অংকিউ ও নিতাই আমরা চার যোদ্ধা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। অচেনা গভীর বনে অভুক্ত অবস্থায় ৩দিন দিবারাত্রি পায়ে হেঁটে কাটাতে হয়। এ সময়ও শত্রুদের রোষাণলে পড়তে হয় একাধিকবার। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও জীবনবাজি রেখে সঙ্গে থাকা হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে পাকসেনাদের প্রতিহত করি। তিনদিন পর নাকাপা বাজরের পৌঁছলে সেখানকার লোকজন চা মুড়ি খেতে দেন আমাদের। সেখান থেকে পাহাড়ি পথে ভারত সীমান্তবর্তী লাচারিপাড়ায় পৌঁছে সন্ধ্যায় ফেনী নদী পাড় হওয়ার সময় পাকসেনারা টের পেয়ে বৃষ্টির মত গুলিবর্ষণ করে আমাদের লক্ষ্য করে। কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যু থেকে সেদিনও প্রাণে বেঁচে যাই আমরা।’

Exit mobile version