নির্বাচনী রোডম্যাপের পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া

fec-image

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বহুপ্রত্যাশিত নির্বাচনী রোডম্যাপ গতকাল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে বহুপ্রত্যাশিত নির্বাচনী রোডম্যাপ গতকাল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে বিএনপি খুশি হলেও পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি সামনে রেখে নির্বাচনের আরেকটা রোডম্যাপ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।

ইসির কর্মপরিকল্পনা ঘোষণাকে ‘অপরিপক্ব’, ‘আংশিক’ ও ‘কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক’ বলেও মনে করে দলটি। জুলাই সনদের আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি নিশ্চিত না করে নির্বাচনের দিকে যাওয়াটা সরকারের আগের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল বলে মনে করে এনসিপি।

ইসির রোডম্যাপকে স্বাগত জানিয়ে গতকাল গণমাধ্যমকে দেয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘রোডম্যাপ ঘোষণা হয়েছে। এতে আশাবাদী হয়েছি যে নির্বাচন কমিশন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। মূল কথা হচ্ছে, আমরা খুশি, উই আর হ্যাপি।’

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘যারা নির্বাচন বয়কট কিংবা বাধা দেয়ার চেষ্টা করবে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দেশের সমস্যা সমাধানে নির্বাচন ছাড়া কোনো উপায় নেই। তাই যারা হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে আগেও সহযোগিতা করেছে, সামনেও সব ধরনের সহায়তা করবে বলেও আশ্বস্ত করেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গতকাল বনানীতে এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেন, ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা অবশ্যই পুরো জাতির জন্য একটি সুসংবাদ। মানুষ এখন নির্বাচনমুখী হতে পারবে। সবাই অপেক্ষা করছে—দেশে একটা নির্বাচন হোক এবং

এর মাধ্যমে দেশে একটা নির্বাচিত সরকার আসবে, সংসদ প্রতিষ্ঠা হবে। সে সরকার বা সংসদ জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, জবাবদিহি থাকবে।’ নির্বাচনের পর দেশের অর্থনীতি বড় আকারে ঘুরে দাঁড়াবে এবং গুড স্কিল ডেভেলপমেন্ট হবে বলেও মনে করেন সাবেক এ বাণিজ্যমন্ত্রী।

প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণায় জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। যথাযথ সময়েই এটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের দিক থেকেও একই রকম নির্দেশনা ছিল। এখন রোডম্যাপ অনুযায়ী জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেয়া হবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।’

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার এক প্রতিক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপকে গতানুগতিক বলে উল্লেখ করেন। গণমাধ্যমে গতকাল রাতে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি বলেন, ‘জাতির প্রত্যাশা আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। কিন্তু কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি।

এমনকি জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং এর বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াও চূড়ান্ত হয়নি। এ অবস্থায় রোডম্যাপ ঘোষণা অপরিপক্ব ও আংশিক। এতে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি। জুলাই বিপ্লবের চেতনা ধারণ করে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি ভিত্তি প্রদান এবং এর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে রোডম্যাপ ঘোষণা করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি।’

ইসির জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়া একটি রুটিন ওয়ার্ক উল্লেখ করে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেন, ‘সংস্কারের বিষয় বিবেচনা করলে আরো উত্তম হতো।’ পিআর পদ্ধতি সামনে রেখে নির্বাচনের আরেকটা রোডম্যাপ দিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি তিনি আহ্বান জানান।

জাতীয় প্রেস ক্লাবে গতকাল এক আলোচনা সভায় জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘ইলেকশন কমিশনকে বলবে, পিআর পদ্ধতি সামনে রেখে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঠিক করেন। ট্র্যাডিশনালটা করছেন তো, আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের পিআরকে নিয়েও আরেকটা করেন।’

সরকার সংস্কার ছাড়াই নির্বাচনের সময় ঘোষণা করেছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সংস্কার যাতে আইনি ভিত্তি না পায় তার জন্য টালবাহানা শুরু হয়েছে। কিন্তু সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচন এ দেশের মানুষ মানবে না।’

রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে গণসংহতি আন্দোলনও। দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান জাতীয় স্বার্থ। নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন রোডম্যাপেরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই।’

গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘একই সঙ্গে আমরা আহ্বান জানাই, আন্দোলনকারী সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনকালীন পরিবেশ, ভোটার তালিকা প্রকাশ ও সংশোধনসহ নির্বাচন-সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করুন। নির্বাচন-সংক্রান্ত নীতিমালা ও অন্যান্য বিষয়ে সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আহ্বান জানাই।’

জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার আগে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা সরকারের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের শামিল বলে উল্লেখ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটি বলছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে এবং এর দায় সরকারকেই নিতে হবে। রাজধানীর বাংলামোটরে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গতকাল দলটির আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব। তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা ছিল বিচার ও সংস্কার। সে লক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে, যেখানে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো জাতীয় নাগরিক পার্টিও নিজেদের মতামত তুলে ধরে।

এ সংস্কার কার্যক্রম চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ঐকমত্য কমিশন প্রণীত জুলাই সনদের খসড়া কিছুদিন আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে দেয়া হয়। এ বিষয়ে এনসিপি তাদের মতামত তুলে ধরে কমিশনের কাছে জমা দেয়। যদিও জুলাই সনদের খসড়ায় সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো রোডম্যাপ না থাকা আমাদের হতাশ করেছে।’

এনসিপি কোনোভাবেই নির্বাচনবিরোধী নয় উল্লেখ করে আদীব বলেন, ‘সেদিক থেকে রোডম্যাপ ঘোষণা ইতিবাচক। তবে যত দ্রুত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি হবে, তত দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়া যাবে বলে আমরা মনে করি। সনদ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত না করে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণ ভবিষ্যতে সংকট তৈরি করতে পারে, যার দায় সরকারকেই নিতে হবে।’

নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘পুরনো বন্দোবস্তের নির্বাচনী রোডম্যাপ জুলাই অভ্যুত্থানকে অস্বীকারের নামান্তর।’

ইসলামী আন্দোলন বলেছে, নির্বাচন বিদ্যমান নিয়মে হবে নাকি পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে হবে, তা নিয়ে কোনো সমাধান হয়নি। অনেক রাজনৈতিক দল পিআর চাইছে। এর একটা সুরাহা হওয়ার আগেই এমন কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করার নৈতিক অধিকার নির্বাচন কমিশনের নেই। অন্য যেকোনো রোডম্যাপের আগে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের রোডম্যাপ দিতে হবে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশন যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, সেটাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। এক বিবৃতিতে দলের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, তারা আশা করেছিলেন, কমিশন নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার আগে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে একটা মতবিনিময় করবে।

কিন্তু তারা তা করেনি। এবি পার্টি মনে করে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করলেও জনমনে নির্বাচন নিয়ে একটা সংশয় লক্ষ করা যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা। প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপারে আস্থা সৃষ্টি করতে না পারলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা কঠিন হতে পারে বলেও মনে করে দলটি।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন