জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে ক্রিপ্টো কারেন্সি


প্রশ্ন করা যেতে পারে, মার্কিন ডলার কি পৃথিবীর সকল সম্পদের মূল ভিত্তি? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন নিজে দলবল নিয়ে মধ্যপ্রাচ্য সফর করে আরব দেশসমূহ থেকে বেসামরিক বিমান ও সমরাস্ত্র ক্রয়ের ফরমায়েশ নিচ্ছেন? সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব-আমিরাত মিলিয়ে আগামী এক দশকে প্রায় ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি নিলেন? কারেন্সি তথা মুদ্রা বলতে আমরা সাধারণত বুঝি সম্পদের পরিবর্তে কোন দেশের সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ও নিয়ন্ত্রিত স্মারক।
যে দেশের মুদ্রার বিপরীতে সম্পদের প্রাপ্তির পরিমাণ ও নিশ্চয়তা যতো বেশি, অফুরন্ত এবং বহু বেশি ধরণের, সে দেশের মুদ্রার মান ততো বেশি, ফলে একটি দেশ চাইলেই সেটার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের বিনিময় মূল্যের অতিরিক্ত মুদ্রা ছাপাতে পারে না, মুদ্রা ছাপতে হয় সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক নিয়মে দেশের মোট সম্পদের পরিমাণ হিসাব করে, রাজনৈতিক কারণে কিংবা শাসকশ্রেণীর অসৎ উদ্দেশ্যে এর বিপরীত কিছু করা হলে ঐ দেশের মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটে।
কোন দেশই প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য ও সেবা এককভাবে উৎপাদন করতে পারে না, তাই অন্য দেশ থেকে পণ্য এবং সেবা ও প্রযুক্তি আমদানি করতে হয়। এই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুপ্রাচীন, বিনিময় মুদ্রা প্রচলনের পূর্বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মূলত মূল্যবান ধাতু স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় সংগঠিত হতো। কালক্রমে মুদ্রার প্রচলন ঘটলে যেদেশের সম্পদ, সেবা ও প্রযুক্তির মান সবচেয়ে উন্নত এবং মূল্যবান ও অফুরন্ত, সেই দেশের সম্পদের বিপরীতে ইস্যুকৃত মুদ্রার চাহিদা অন্যান্য দেশ সমূহের মুদ্রার চেয়ে স্বাভাবিকভাবে বেশি হতে লাগলো, ফলশ্রুতিতে সে দেশের মুদ্রার বিনিময় মূল্য বেশি হতে লাগলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমরশক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, কৃষি এবং মহাকাশ গবেষণা সহ সকল ক্ষেত্রে সমরশক্তি ও মেধা শ্রেষ্ঠত্বের ভিত্তিতে এক অফুরন্ত সম্পদের আধার হিসেবে আবির্ভূত হলো। মার্কিনরা ব্রেইন ড্রেইন পলিসি ও সমরশক্তি শ্রেষ্ঠত্বের জোরে ইউরোপীয়দের সাথে জোট করে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০০ এর অধিক সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে একচ্ছত্র বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করলো। সাধারণভাবে দৃশ্যমান মূল্যবান সম্পদ বলতে জ্বালানি তেল, হীরা, রৌপ্য, স্বর্ণ এবং দূর্লভ খনিজ বুঝায়। মার্কিনরা কল্পনাতীত সমরশক্তির জোরে যুদ্ধের পর যুদ্ধ লাগিয়ে ও নিজেদের কূটনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে নিশ্চিত করেছে অদ্যাবধি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি নিত্য প্রয়োজনীয় খনিজ সম্পদ মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানি তেল বিক্রির আন্তর্জাতিক লেনদেন মার্কিন ডলারে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র একাধারে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ও অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার, বিশ্বব্যাপী একচ্ছত্র প্রভাবশালী এবং জ্বালানি তেল সহ মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ সমূহের বিক্রয়ের আন্তর্জাতিক লেনদেন ডলারে হওয়ায় খুব সহজেই ডলার এক প্রতিদ্বন্দ্বী আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হিসেবে আবির্ভূত হলো।
বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য নিজেদের ডলার রিজার্ভ ফান্ড গঠন করলো, সর্বক্ষেত্রে মার্কিন আধিপত্য এতোই বেশি যে ইউরোপীয় মুদ্রা সমূহ অনেকটা ডলার এর অধীন মুদ্রায় পরিণত হয়েছে। তাই দেশের অবস্থান ও সম্পদের ধরনের উপর নির্ভর করে কিছু কিছু দেশের মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের চেয়ে বেশি হলেও সম্পদের অফুরন্ততার ক্ষেত্রে ও বৈশ্বিক প্রভাবে মার্কিন ডলারের তুলনায় তেমন কিছুই নয়, তাই সেগুলো সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা হয়ে ওঠতে পারেনি, যেমনঃ ব্রিটিশ পাউন্ড, কুয়েতি দিনার।
স্পষ্টত সর্বজন স্বীকৃত আইনগত অনুমোদন ব্যতিত মুদ্রার কোন বিনিময় মূল্য সৃষ্টি হয় না, কোন স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ ব্যতিত কেউ সচারাচর মুদ্রার প্রচলন করতে পারে না। বৃহৎ বৈশ্বিক বহুজাতিক কোম্পানি গুলো চাইলেই নিজস্ব মুদ্রা বা লেনদেনের জন্য বিনিময় স্মারক ইস্যু করতে পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিধায় কেউ সেটা করে না।
হালে প্রযুক্তির উন্নয়নে কিছু কিছু দেশ লেনদেনে সময় বাঁচানো ও গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য জাতীয় মুদ্রার সমমানের ডিজিটাল কারেন্সি বা বিমূর্ত মুদ্রা ইস্যু করছে। এই নিবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয় হলো কিছু কিছু দেশ কর্তৃক স্বীকৃত ডিজিটাল কারেন্সি ইস্যু হওয়ার বহু আগে থেকেই বিশ্ব বাজারে প্রচলন হওয়া বিমূর্ত “ক্রিপ্টো কারেন্সি”। ইংরেজি শব্দ Crypto এর অভিধানগত বাংলা অর্থ হলো ‘চোরা’ বা ‘গুপ্ত’। অর্থাৎ ক্রিপ্টো কারেন্সি হলো চোরা বা গুপ্ত মুদ্রা,
আজ অবধি কোন সর্বজন স্বীকৃত আইনগত স্বীকৃতি নেই বিধায় বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেন অবৈধ। তাহলে অবৈধ ও স্বীকৃতি বিহীন গুপ্ত মুদ্রার মান লক্ষ ডলার হলো কিভাবে? এক কথায় এই রহস্যের মূল কারণ সমূহ নিহিত আছে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার এর আধিপত্য ও বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য ধরে রাখার জঘন্য নোংরা খেলা সমূহে।
একচ্ছত্র বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা সারা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ লাগিয়ে লাগিয়ে মার্কিন সামরিক ব্যয় বাড়িয়েছে অকল্পনীয়, অভ্যন্তরীণ ব্যয়ও বেড়েছে অবিশ্বাস্য, মার্কিন রাজস্ব সংগ্রহ বৈশ্বিক ব্যয় তো দূরে থাক, আভ্যন্তরীণ ব্যয় মিটাতেও হয়তো যথেষ্ট নয়। তবে ডলার বৈশ্বিক বিনিময় মুদ্রা হওয়ায় পিছিয়ে না গিয়ে বরং অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে নিয়ে স্বদম্ভে আজ অবধি ছুটছে অকল্পনীয় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু সবকিছুরই একটা সীমা আছে।
বর্তমানে মার্কিন ফেডারেল ঋণ ৩৭ হাজার বিলিয়ন ডলার বা ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই। এরমধ্যে বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৮.৫ ট্রিলিয়ন ডলার (যার ১.০৬ ট্রিলিয়ন ডলার জাপানের ও ৭৫৯ বিলিয়ন ডলার চীনের এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশ মিলিয়ে বাকি অংশ)। বিশ্বের অনেক গুলো দেশ এখন চীন ও রাশিয়া কর্তৃক সরাসরি প্রভাবিত, আবার উত্তর কোরিয়া ও ইরান এর মতো দেশগুলো সামরিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মোটামুটি টিকে থাকার শক্তি অর্জন করেছে, তাই এখন আর সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের হুমকি ধামকি কাজ করছে না। বাধ্য হয়ে বৈশ্বিক মুদ্রা ডলার এর নিয়ন্ত্রক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র দেশ সমূহের উপর বড় বড় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা একদম পরিস্কার যুক্তরাষ্ট্রের কাগজে ছাপানো ডলার বৈশ্বিক সম্পদ বা লেনদেনের মূল ভিত্তি নয়। বৈশ্বিক লেনদেনের মূল ভিত্তি হলো জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যোগান ও দূর্লভ খনিজ।
ইরান, রাশিয়া ও ভেনেজুয়েলার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধে বৈশ্বিক জ্বালানি তেল এর একটি বিশাল অংশের উপর যুক্তরাষ্ট্র মূলত নিজেই ডলারে লেনদেন এর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে! অথচ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একটি চরম ঘাটতির দেশ, যার ঋণের সুদের দৈনিক পরিমাণ ২.৬ বিলিয়ন ডলার এবং বাৎসরিক প্রায় ৯৪৯ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে চীন আবির্ভূত হয়েছে বিশ্ব উৎপাদন ও সরবরাহের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে, যা কিনা একাই ইরান-রাশিয়া-ভেনেজুয়েলার জ্বালানি তেল ভোগ করতে সক্ষম, বরং মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে পাবে ছাড় মূল্যে।
মুখে যা-ই বলুক ইউরোপীয়দের জন্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাস অপরিহার্য। অতএব এই তেল ও গ্যাস যদি ডলারের বাইরে লেনদেন হয় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরো শোচনীয় হবে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিষেধাজ্ঞা উল্টো প্রয়োগ করে শুধুমাত্র রুবল-এ জ্বালানি বিক্রি করে নিজের মুদ্রার মান বাড়িয়ে নিয়েছেন অনেকটা।
পরিস্থিতির চাপে যুক্তরাষ্ট্র বাধ্য হয়ে ক্রিপ্টো কারেন্সিতে নিষেধাজ্ঞায় থাকা দেশগুলোকে বড় বড় লেনদেন করতে দিচ্ছে এবং ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেন হচ্ছে ডলারে! এতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য কিছুটা পূরণ হচ্ছে, পাশাপাশি মুখও রক্ষা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অবাধ্য শক্তিশালী দেশসমূহ একটি মোটামুটি পর্যায়ের অসুবিধা ভোগ করছে। এমন পরিস্থিতিতে এখন Bitcoin, Ethereum, XRP Ripple এর মতো ক্রিপ্টো কারেন্সিগুলোর মূল্য আকাশ ছোঁয়া। গ্লোবাল ক্রিপ্টো মার্কেট এর আকার এখন ৩.৪৩ ডলার, যার প্রায় ৬১ শতাংশ হলো বিটকয়েন। একেকটি বিটকয়েন এর দাম এখন ১ লক্ষ ৪ হাজার ডলার ছুঁই ছুঁই! কেউ যদি এখন এই গ্লোবাল ক্রিপ্টো মার্কেটের সিংহভাগও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ঋণের সাথে যোগ করে বিবেচনা করে, তাহলে কি বেশি ভূল হবে?
বর্তমানে চীন জল, স্থল ও মহাকাশে সর্বত্র যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর এবং অতি নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স গবেষণা, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে নিয়ন্ত্রণ, ক্লাউড স্পেস এর মালিকানা, ৫জি ও ৬জি নেটওয়ার্ক, রুপান্তরিত ও সবুজ জ্বালানি, ইলেকট্রনিক ভেহিক্যাল, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান, নেটওয়ার্কিং/এআই প্রোডাক্ট উৎপাদন, বুলেট ট্রেন প্রযুক্তি এবং নিজস্ব একক মহাকাশ স্টেশন মিলিয়ে বহু ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে।
২০২১ সালে একটি আন্তঃমহাদেশীয় চীনা হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণে পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে লক্ষ্য বস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলো। অদ্যাবধি যেসব ক্ষেত্রে চীন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে আছে, যেগুলোতে ব্যবধান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সামান্য।
এতোদিন মনে করা হতো পশ্চিমা সমরাস্ত্রের তুলনায় চীনা সমরাস্ত্র নিম্ন, সদ্য সমাপ্ত পাক-ভারত খন্ড যুদ্ধে চীনের তৈরি বিমান থেকে ছোঁড়া চীনা পিএল-১৫ই মিসাইলের ভারতের ৪.৫ প্রজন্মের পশ্চিমা রাফাল যুদ্ধ বিমানে ১৯০ কিঃমিঃ দূর হতে পাকিস্তানি হিটের ফলে পুরো পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়েছে। ডলার বৈশ্বিক মুদ্রা হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য খর্ব করতে চীন ব্রিকস্ জোট গঠন করেছে।
বর্তমানে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশ এই জোটের আওতাভুক্ত, আরো ৩০টির অধিক দেশ ব্রিকস্-এ যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চীন ডলার ব্যতিত অতি দ্রুত, কম খরচে, সহজে এবং নিরাপদে আন্তর্জাতিক লেনদেন চালু করার জন্য নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলন করেছে, আন্তঃদেশীয় লেনদেনের জন্য ব্রিকস মুদ্রা প্রচলনের প্রক্রিয়া জোর কদমে এগিয়ে নিচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন চীনা উদ্যোগ কার্যকরী হলে আন্তর্জাতিক লেনদেন প্রক্রিয়ার সময় কয়েক দিন থেকে কয়েক সেকেন্ডে হয়তো নেমে আসবে। মার্কিন বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধ, সমরাস্ত্র শ্রেষ্ঠত্ব এবং দেশে দেশে অবৈধভাবে সরকারের পতন ঘটিয়ে ঘটিয়ে। বিপরীতে চীন সমরাস্ত্র উন্নয়নের পাশাপাশি মূলতঃ উৎপাদন সক্ষমতা, উন্নয়ন অংশীদারত্ব ও বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রভাব বিস্তার করেছে।
একটি মোক্ষম পর্যায়ে এসে চীন বিশ্বব্যাপী নিজস্ব বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার ও অংশীদারত্বের মহাপরিকল্পনা ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের পাশাপাশি ডলারের বিকল্প আন্তর্জাতিক মুদ্রা প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছে। এখন যদি চীন আগামী দু-চার বছরের মধ্যে ৬জি চালু করে Active Electronic Scanned Array (ASEA) রাডার এর রেঞ্জ ১০০০ কি. মিটার এবং পিএল-১৫ই এর মতো ক্ষেপণাস্ত্র গুলোর কার্যকরী রেঞ্জ ৬০০-৭০০ কি. মিটার করে ফেলতে সক্ষম হয়, তাহলে মার্কিন ও পশ্চিমা যুদ্ধ বিমান শ্রেষ্ঠত্বের আকস্মিক মৃত্যু হবে!
চীনের এরূপ ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ফলাফল বুঝতে পেরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনা পণ্যে ব্যাপক আমদানি শুল্ক আরোপ করেছিলেন। মজার বিষয় হলো চীন পিছিয়ে না গিয়ে পাল্টা শুল্ক আরোপ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপর দূর্লভ খনিজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়।
চীন হাতে থাকা বিটকয়েন মজুদের বড় অংশ ছেড়ে দিলে বিটকয়েন এর মূল্য লক্ষ ডলার থেকে চুরাশি হাজার দুইশত পঞ্চাশ ডলারে নেমে এসেছিলো, মার্কিন শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গিয়েছিলো। গত সপ্তাহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে আলোচনা করে সাময়িকভাবে শুল্ক অনেকটা পূর্বের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সাময়িক পরাজয় মেনে নিয়েছে! ৯০ দিন পর আবারও আলোচনা ও হিসাব হবে।
মার্কিনীদের সাথে চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কারণেই মূলত বিটকয়েন এর এই চরম উত্থান পতন। কার্যতঃ স্পষ্ট চীন যে দিন ডলারকে আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রার মর্যাদা হতে সরিয়ে দিতে সমর্থ হবে সেদিন ডলারের অধীনে থাকা এসব ক্রিপ্টো কারেন্সির অধিকাংশেরও পতন হবে। মূলত ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্যই আমেরিকা ক্রিপ্টো কারেন্সিকে ব্যাপকভাবে বৈধতা দিচ্ছে না।
সে নাগাদ এগুলোর মূল্য চরম উত্থান পতন এর মধ্য দিয়ে যাবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান বলছে ২০২৫ সালের দ্বিতীয় অর্ধে বিটকয়েন এর অগ্রগতি স্বর্ণকে ছাড়িয়ে যাবে, অথচ স্বর্ণের দর পতন হয়েছে কিংবা বিশ্ব বাজারে অবস্থা খুবই খারাপ তেমনটা মোটেই নয়! অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বিনিময় মুদ্রা ডলার এখন লাইফ সাপোর্টে থাকা একটি মুদ্রা, তাই আধিপত্য ধরে রাখতে ব্যয় কমানো ও বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য এমন পাগলের মতো শুরু করেছেন ব্যবসায়ী থেকে রাজনৈতিক বনে যাওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এরকম পরিস্থিতিতে স্থিতিশীলতা আনয়নে কাজ না করে উল্টো সুযোগ নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মার্চে রাস্ট্রীয়ভাবে বিটকয়েন রিজার্ভ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছেন! এটার আইনগত বা বিনিময় স্বীকৃতি কোন দেশের তেলের বাজার, যুক্তরাষ্ট্রের রাস্ট্রীয় সম্পদ, স্বর্ণ না কোন দূর্লভ খনিজ?
তিনি যদি বিটকয়েনকে রাস্ট্রীয় অনুমোদন/স্বীকৃতি দিতেন তাহলে হয়তো বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে কিছুটা নিরাপত্তা আসতো, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি হয়তো আরো কিছুটা বাড়তো, জনাব ট্রাম্প সেটা চান না বিধায় বিশ্ববাজারের মাথায় লবণ রেখে বড়ই খাওয়ার মতো এমন বিতর্কিত পদক্ষেপ নিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও চীনের সাথে চলমান বাণিজ্য যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে অবৈধ ক্রিপ্টো কারেন্সির লেনদেন নিঃসন্দেহে আরো বহুগুণ বেড়ে যাবে।
ট্রাম্প পরিবার এর ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবসা আছে, যেখানে দেশ ও বিদেশ হতে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে, বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন এটা মূলত প্রকাশ্যে পরোক্ষ ঘুষ লেনদেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী মনোভাব, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর ক্রিপ্টো কারেন্সি নিয়ে বিতর্কিত সব উদ্যোগ, চীনের সাথে বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব এবং ব্যাপক আর্থিক ঘাটতি নিয়ে বিশ্ব মোড়লপনার কারণে বহু দেশ ক্রিপ্টো কারেন্সির রিজার্ভ গড়ে তুলছে। নিষেধাজ্ঞা ফাঁকির পাশাপাশি অর্থ জালিয়াতি, গোয়েন্দা কার্যক্রম, অর্থ পাচার ও দূর্নীতির কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্রিপ্টো কারেন্সি।
তাই বাধ্য হয়ে আর্থিক লেনদেনে নিয়ন্ত্রণ রক্ষা, অর্থ পাচার, আর্থিক জালিয়াতি ও দূর্নীতি রোধের জন্য বহু দেশ ধীরে ধীরে অফিশিয়ালি বা আনঅফিশিয়ালি ক্রিপ্টো কারেন্সি কে স্বীকৃতি দিচ্ছে, ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা গুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে।
নিকট অতীতে আমাদের দেশে ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি অর্থ জালিয়াতি/পাচার সংগঠিত হয়েছে, এর মধ্যে ২০২৩ সালে এমটিএফই এর মাধ্যমে দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলো প্রায় ২০০০০ কোটি টাকা। দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রিপ্টো কারেন্সির মাধ্যমে অর্থ পাচার ও হুন্ডি ব্যবসা এবং দূর্নীতির পেমেন্ট গ্রহণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুবই বেশি!
উদাহরণ স্বরুপ কেউ যদি ১০০ বিটকয়েন পেমেন্ট নিয়ে দেশ বিরোধী কোন মারাত্মক কাজ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায় কিংবা সারাদেশ ঘুরে ঘুরে সভা-সমাবেশ/ওয়াজ মাহফিল করে বেড়ায়, রাস্ট্র কিভাবে তাঁর দূর্নীতির আসল রহস্য উদঘাটন করবে? এমটিএফই এর মতো কিছু যে আবারও ঘটবে না, সেটার নিশ্চয়তা কি? উন্মুক্ত উৎসে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক বাংলাদেশ ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেনে বিশ্বে ৩৫তম।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখতে পাচ্ছি দেশে ভয়াবহ আকারে বিভিন্ন নিম্নমানের ক্রিপ্টো কারেন্সির ট্রেডিং বিদ্যমান, অথচ এই লেনদেন আমাদের দেশে আক্ষরিক অর্থে অবৈধ, এসব নিম্নমানের ক্রিপ্টো কারেন্সি গুলোর সার্ভার নিশ্চিতভাবেই একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর বন্ধ হয়ে যায়,
কিন্তু এই ক্রিপ্টো কারেন্সি গুলোতে প্রথম দিকে বিনিয়োগ করতে পারলে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি, ফলশ্রুতিতে আমাদের দেশে বিদ্যমান বিনা পরিশ্রমে বড় লোক হওয়ার নেশায় মত্ত বিপুল সংখ্যক অকর্মক ও লোভী ব্যক্তিরা বারংবার প্রতারিত হওয়ার পরও ধার দেনা করে হলেও অবৈধ ক্রিপ্টো কারেন্সিতে বিনিয়োগ বজায় রাখছে! অতএব ক্রিপ্টো কারেন্সি লেনদেন নিয়ন্ত্রণ এবং পর্যবেক্ষণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ অতিব জরুরি আবশ্যক।
সূত্র : ওয়াচার.গুরু, পিজিপিএফ.ওআরজি, ঢাকা পোস্ট, এক্স