parbattanews

তুলাছড়িতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হুমকিতে প্রাণভয়ে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করছে নও মুসলিমরা

তুলাছড়ি গ্রামে অবস্থিত শহীদ ইমাম উমর ফারুক ত্রিপুরার বাড়ি

বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে আলোচিত ইমাম উমর ফারুক ত্রিপুরা হত্যাকাণ্ডের পর থেমে নেই উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা। তুলাছড়ি ও আশেপাশের নও মুসলিমদেরকেও উমর ফারুকের মতো হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের হুমকির মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে অত্র এলাকার অধিকাংশ নও মুসলিম ইতোমধ্যেই পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে। যারা ধর্মান্তরিত হয়নি তারা প্রাণভয়ে এলাকা ত্যাগ করে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও তারা নিরাপদ বোধ করছে না। নওমুসলিমদের আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে তাদেরকে হত্যার হুমকি পাঠাচ্ছে উপজাতীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ। নও মুসলিমদের দাবী, উমর ফারুক হত্যাকারীদের গ্রেফতার না করায় সন্ত্রাসীরা আস্কারা পেয়ে আরো এমন হুমকি দেয়ার সাহস পাচ্ছে।

এদিকে ইমাম উমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের ১৯ দিন পর হয়ে গেলেও পুলিশ এ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি। কোনো আসামী আটক তো দুরে থাকুক আসামীদের সনাক্ত করতেও সক্ষম হয়নি। স্থানীয় নও মুসলিমদের অভিযোগে, ১৮ জুন উমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের পরদিন পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যাওয়ার পর এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আর ঘটনাস্থলে আসেনি।তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রোয়াংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৌহিদ হোসেন। উমর ফারুকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম ত্রিপুরা মামলার এজাহারে সুস্পষ্ট ভাষায় ‘অজ্ঞাতনামা ৪/৫জন জেএসএস পাহাড়ী সন্ত্রাসী’ বলে উল্লেখ করলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত আসামী সনাক্ত করতে পারেনি।

সম্প্রীতির বান্দরবানের অন্তর্ভূক্ত উপজেলা রোয়াংছড়ি অত্যন্ত ‍দূর্গম। বান্দরবান থেকে পূর্ব দিকে অবস্থিত রোয়াংছড়ি উপজেলায় সড়ক পথে ২২ কি.মি. যেতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা। আলোচিত তুলাছড়ি গ্রাম রোয়াংছড়ি উপজেলার ৩ নং আলেক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্গত। উপজেলা সদর থেকে পূর্বদিকে ১৮ কি.মি দুরে অবস্থিত এই গ্রামে যাওয়ার জন্য সরাসরি কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। ১৮ কি.মি. এর মধ্যে ১০ কি.মি. পর্যন্ত সিএনজি, মটর সাইকেলে যাওয়া গেলেও বাকি ৮ কি.মি. দূর্গম পাহাড়ি রাস্তায় অনেকগুলো উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে হয়। এই দূর্গমতার কারণে এলাকাটি উপজাতীয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য বলা চলে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলতে তুলাছড়ি থেকে ৩ কি.মি. দুরে লংলাইয়ে অবস্থিত সেনাক্যাম্পই একমাত্র ভরসা।



পার্বত্যনিউজের অনুসন্ধানে জানা গিয়েছে, তুলাছড়ি গ্রামে মোট ২৯টি উপজাতীয় পরিবার বসবাস করে।এরমধ্যে ৫ পরিবার নও মুসলিম, ১ পরিবার বৌদ্ধ ও বাকি ২৩ পরিবার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এই গ্রামে একটি বৌদ্ধ মন্দির, একটি মসজিদ ও তিনটি গির্জা রয়েছে। গির্জাগুলোর মধ্যে ১ টি ক্যাথলিক, ১ টি প্রোটস্ট্যান্ট ও ১টি বিলিভার্স। মসজিদটি শহীদ ইমাম উমর ফারুকের জমিতে তার নিজের প্রতিষ্ঠিত।

তুলাছড়ি গ্রামে ১২ পরিবার মুসলিম থাকলেও উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ভয়ে ৭ পরিবার পুণরায় পূর্বের ধর্মে অর্থাৎ খ্রিস্টান ধর্মে ফেরত গিয়েছে। বাকি ৫ পরিবারের মধ্যে ১ পরিবার শহীদ ইমাম উমর ফারুকের পরিবার বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে রোয়াংছড়িতে অনেকটা আত্মগোপন করে রয়েছে। বাকি ৪ পরিবার উমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের পর উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে প্রাণভয়ে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে গিয়েছে।

পার্শ্ববর্তী সাধু হেডম্যানপাড়া, শিলবান্ধা পাড়া, যাদুমণি পাড়া, নারেংপাড়ার নও মুসলিম পরিবারগুলোর অধিকাংশই ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে পূর্বের ধর্মে ফেরত গিয়েছে। যারা যায়নি তাদের প্রায় সবাই সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে এলাকা ছাড়া। তারা পার্শ্ববর্তী অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকায় অবস্থিত নও মুসলিম পরিবারগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসীরা সেখানে বসবাসকারীদের আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে। এই গ্রামগুলোতে মোট ৩২ পরিবার ইসলাম গ্রহণ করলেও সন্ত্রাসী ও মিশনারীদের হুমকির মুখে ১৫ পরিবার প্রাণভয়ে পূর্বের ধর্মে ফেরত গিয়েছে। বাকি ১৭ পরিবারের বেশিরভাগই প্রাণভয়ে এলাকা ছাড়া।

অন্যদিকে স্থানীয় নও মুসলিমরা প্রায় সকলেই শ্রমজীবী। তারা জুম চাষ ও বাগানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের তারা জুম চাষ বা বাগানে কাজ করার জন্য জঙ্গলে বা দুরের পাহাড়ে যেতে ভয় পাচ্ছে।

স্থানীয় পরিস্থিতি জানতে পার্বত্যনিউজ কথা বলে, তুলাছড়ি গ্রামের পার্শ্ববর্তী কচ্ছপতলী গ্রামে অবস্থিত মসজিদ কমিটির সভাপতি নও মুসলিম আবদুস সালাম ত্রিপুরার(৫১) সাথে।তার পূর্বনাম অংশিলা ত্রিপুরা।তিনি ২০১৫ সালে শহীদ উমর ফারুকের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। কচ্ছপতলীতে সেনা ক্যাম্প থাকায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ এলাকাটি। ফলে তুলাছড়ি, যাদুমণি পাড়া, নারেং পাড়া, সাধু হেডম্যান পাড়ার নও মুসলিমরা উমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডের পর প্রাণ ভয়ে গ্রাম ছেড়ে প্রাথমিকভাবে আবদুস সালামের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। আবদুস সালাম ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে জানান, উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা প্রত্যেক নও মুসলিমকে হত্যা করার জন্য একটি হিট লিস্ট তৈরি করেছে। সেই তালিকায় উমর ফারুক এক নম্বরে ছিলেন, আমি দুই নম্বরে। উমর ফারুককে হত্যার পর আমি এক নম্বর টার্গেট। এখানে সেনাবাহিনী থাকায় সন্ত্রাসী আসতে না পারলেও আমাদের আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে। তারা আমার বাড়ি চারদিক থেকে ঘিরে ব্রাশফায়ার করার হুমকি দিয়েছে।

তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কারো পক্ষেই আর নিজ গৃহে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই অনেকেই কচ্ছপতলিতে জায়গা জমি দেখছেন। মূলত খুনীরা আটক না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, তুলাছড়ি ও এর আশেপাশের এলাকায় মোট ৩৩ পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে বর্তমানে মাত্র ১৭ পরিবার রয়েছে। বাকিরা প্রাণ বাঁচাতে পূর্বের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছে।

আবদুস সালাম ত্রিপুরা আরো জানান, ১৮ তারিখ উমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের পর ১৯ তারিখ পুলিশ এসে লাশ নিয়ে গেছে। এরপর আর এলাকায় আসে নাই। আমাদের রোয়াংছড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে জবানবন্দী নিয়েছে।

শহীদ ইমাম ওমর ফারুকের প্রতিবেশী সাদিকুল ইসলাম ত্রিপুরা(২৫)। পূর্ব নাম জৈ থং ত্রিপুরা। তিনি উমর ফারুকের মসজিদে ২০১৯ সালে কলেমা পড়ে মুসলিম হয়েছে। তুলাছড়িতে উমর ফারুকের বাড়ির তিন ঘর পরেই তার বাড়ি। উমর ফারুক হত্যাকাণ্ডের পর গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন পাশ্ববর্তী এলাকার এক নও মুসলিম পরিবারে।

সাদিকুল ইসলাম ত্রিপুরা পার্বত্যনিউজকে বলেন, বর্তমানে তারা ভয়াবহ আতঙ্কে রয়েছেন। সন্ত্রাসীদের ভয়ে পরিবার নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় থাকছেন না। কিছুদিন পরপর ঠিকান পরিবর্তন করতে হচ্ছে তাকে। বর্তমানে যেখানে আছেন সেখানে সেনাবাহিনীর টহল থাকায় সন্ত্রাসীরা সরাসরি এসে হুমকি দিতে পারছে না। কিন্তু আত্মীয় স্বজনের মাধ্যমে হুমকি দিচ্ছে। হুমকিদাতার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি শান্তিবাহিনীর নাম উচ্চারণ করে বলেন, সন্ত্রাসীরা বার্তা পাঠাচ্ছে, উমর ফারুকের দেহ ও মাথা তো একসাথে রেখেছিলাম, কিন্তু এখনো যেসব ত্রিপুরা ইসলাম ধর্মে রয়ে গেছে তাদের মাথা ও ধড় আলাদা করে ফেলা হবে।

সাদিকুল ইসলাম ত্রিপুরা বলেন, তুলাছড়িতে আগে মুসলিম ছিলো ১১ পরিবার। সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ৬ পরিবার খ্রিস্টান ধর্মে ফেরত গিয়েছে। এখন উমর ফারুকের পরিবারসহ মোট ৫ পরিবার মুসলিম রয়েছে। এর মধ্যে উমর ফারুকের পরিবার চলে যাওয়ায় ৪ পরিবার রয়েছে, যাদের কেউই এখন আর এলাকায় নেই। নারেং পাড়ায় ৫ পরিবার নওমুসলিম ছিলো যাদের মধ্যে তিন পরিবার প্রাণ বাঁচাতে পূর্ব ধর্মে ফিরে গেছে। সাধু হেডম্যান পাড়ায় ৮ পরিবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে ৬ পরিবার পূর্ব ধর্মে ফেরত গিয়েছে। শিলবান্ধা পাড়ায় ৫ পরিবার ইসলাম গ্রহণ করলেও বর্তমানে ৩ পরিবার রয়েছে। বাকি ২ পরিবার প্রাণভয়ে পূর্বধর্মে ফেরত গিয়েছে। কচ্ছপতলী যাদুমনি পাড়ায় ৩ পরিবার নওমুসলিম রয়েছে। পাড়াটি সেনা ক্যাম্পের কাছাকাছি হওয়ায় সন্ত্রাসীদের তৎপরতা কম। ফলে সেখানকার সকলেই ইসলাম ধর্মে অটুট রয়েছে।

সাদিকুল ইসলাম ত্রিপুরা আশঙ্কা করছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে বাকি সকল নও মুসলিমদের হয় এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে নতুবা পুর্বের ধর্মে ফেরত যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, আমরা সকলে দিনমজুর। কাজ করে খাই। সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে আমরা পাহাড়ে গিয়ে কাজ করতে পারছি না। বর্তমানে জমানো টাকা ফুরিয়ে আসছে। বাইরে থেকে কিছু সাহায্য পাচ্ছি। কিন্তু এটাও তো এক সময় শেষ হবে। সেনাবাহিনীরা কতদিন নিরাপত্তা দেবে? তারা চলে যাবে এক সময়। কিন্তু সন্ত্রাসীরা রয়ে যাবে। আমাদের কাজে ফিরতে হবে। সন্ত্রাসীদের আটক করা না গেলে এটা সম্ভব নয়। সরকারের প্রতি আহ্বান আমাদের জন্য কিছু করুন। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন। কচ্ছপতলীর আবদুস সালামকে গত পরশু হুমকি দিয়েছে এ বলে যে, ওনার ঘর কি পাকা নাকি বেড়ার? যদি বেড়ার হয় তাহলে ওনার ঘর ঘিরে সন্ত্রাসীরা ব্রাশ ফায়ার করে সকলকে হত্যা করবে। তিনি খুনীদের আটকে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

তুলাছড়ি পাড়ার নও মুসলিম মোহাম্মদ হোসেন(৪০) পার্বত্যনিউজকে বলেন,  সন্ত্রাসীরা গত ২ জুলাইও হুমকি দিয়েছে। তারা টার্গেট লিস্ট করেছে। এই তালিকায় ১ নম্বরে উমর ফারুক ছিলো। তিনি মারা যাওয়ার পর এখন আবদুস সালাম নাকি এখন এক নম্বরে। তাকেও উমর ফারুকের মতো হত্যা করা হবে। এভাবে একে একে সকল নও মুসলিমকে হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনী এখানে থাকায় আমরা কিছুটা নিরাপদ। কিন্তু গ্রামে ফিরে যেতে পারছি না। জুম চাষ করতে যেতে পারছি না। অতি দ্রুত সন্ত্রাসীদের আটক করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেন তিনি।

এ ব্যাপারে রোয়াংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তৌহিদ হোসেনকে মামলার পরবর্তী আপডেইট সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মামলার কোনো আপডেইট নেই। কাউকে আটক করা যায়নি। কারা খুনি তাও জানা যায়নি। অপারেশন অব্যাহত রয়েছে।

কিন্তু লাশ নিয়ে আসার পর আর ঘটনাস্থলে পুলিশ না যাওয়ার স্থানীয়দের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। মুসলিমদের উপর হুমকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হতে পারে, কিন্তু আমাকে কেউ এ ব্যাপারে কিছু জানায়নি।

Exit mobile version