কয়েকটি ঘটনা এবং তাদের যোগসাজশ

fec-image

সামাজিকমাধ্যমে একটি ভিডিও দেখলাম। যেখানে সম্ভবত জুমার খুৎবা দিচ্ছেন একজন ঈমাম। তিনি তুলনা করছেন ইউরোপের সাথে আমাদের। তিনি বলছেন, ইউরোপে দুর্নীতি কম। সেখানের মানুষ রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে চলেন। রাস্তা নোংরা করেন না। আরও নানা কিছু। তার ভাষায়, সেখানের মানুষরা মুসলিম না হয়েও ইসলামের কথাগুলো মেনে চলছেন বিপরীতে আমরা করছি উল্টোটা।

আমি সেই খুৎবা দানকারীর সমালোচনা করছি না। যিনি বা যারা শেয়ার করে বিষয়টিকে মানুষের নজরে এনেছেন তাদেরকেও সাধুবাদ জানাচ্ছি। সাথে তাদের কে আরেকটি ব্যাপার মনে করিয়ে দিচ্ছি ইসলাম হলো সম্পূর্ণ জীবনবিধান, যা আল্লাহ তায়ালাই ঘোষণা করেছেন। সুতরাং সম্পূর্ণ জীবনে শুধু ঈশ্বর বা খোদার উপসনা কিংবা ইবাদতের বিষয়টিই থাকে না, অন্য ব্যাপারগুলোও থাকে। রাস্তা নোংরা না করার কথা তারই একটি। এটা ধর্মীয় কর্মের অংশ না, সামাজিক কর্মের অংশ। অর্থাৎ ধর্ম সামাজিকও। এই যে ঘুষ না নেওয়া, এটা ধর্মের উপাসনার অংশ নয়, এটা রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কিত। রাষ্ট্র ব্যবস্থার অংশ। এখানেও ইসলাম। সুতরাং ভিডিওটা যারা প্রচার করেছেন তাদের ঈমামের তুলনার পাশাপাশি ইসলামের পরিধিটাও ভাবতে হবে।

ইদানিং অনেককেই আফসোস করতে দেখি, ‘ইসলামি দল বা ইসলামপন্থীরা মানুষের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে, তা হোক সামাজিক, প্রশাসনিক কিংবা রাষ্ট্রীয়-সেগুলোর কেন প্রতিবাদ করছেন না। অথচ আবু ত্ব-হা নামের একজন গুম হলে বাম-সেকুলাররাও প্রতিবাদ করেছেন।’ তাদের অভিব্যক্তি অনেকটা ঠোঁট ফোলানো অভিমানী বাচ্চার মতো। অথচ তারা সাম্প্রতিক অতীতটাও ভুলে বসে আছেন। তারা ভুলে বসে আছেন, তারাই ঠেলে বারবার ইসলামপন্থীদের ধর্মের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তারা যখনই সামাজিক ব্যাপারে কথা বলতে এসেছে, তাদের কথা না শুনে, তাদের যুক্তির ভালোমন্দ একসাথে বসে আলাপ না করে, সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। তাদের কোনো জায়গাতেই স্পেস দেওয়া হয়নি। কোনো আলাপেই তাদের যুক্তিকে আলোচনা তো দূরের কথা উপস্থাপনই করতে দেওয়া হয়নি। বরং যখন ইসলামের কথা বলা হয়েছে, তাকে নানা তকমায় অভিসিক্ত করে অভিযুক্ত করা হয়েছে। কী কী করা হয়েছে বা বলা হয়েছে তার বিস্তারিত বলতে চাই না। এখনো হয়তো সেই আলোচনার প্রস্তুতি সবার নেই। তবে একটা বিষয় ভালো যে, অনেকেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন সমাজের মূলস্রোতকে পাশ কাটিয়ে আর যাই হোক অন্তত সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়।

একজন পাহাড়ি ও ইসলাম

বান্দরবানে একজন নবমুসলিম নিহত হয়েছেন। বলা হয়, যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে যারা বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড চালায় সেই পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছেন তিনি। নিহত সেই মানুষটি ক্ষুদ্র জাতি যাকে নৃগোষ্ঠী আখ্যা দেয় আমাদের সংবিধান তারই একজন ছিলেন। যিনি পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করে ওমর ফারুক নাম ধারণ করেন। ইসলাম গ্রহণ করেই ক্ষান্ত হননি তিনি। তার আহ্বানে আরও কয়েকটি পরিবার ইসলাম গ্রহণ করেছিল। শুধু তাই নয়, পাহাড়ে নিজ জমিতে মসজিদ বানিয়ে তিনি ইসলামের অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, পাহাড়ে ধর্মান্তকরণ নতুন কিছু নয়। যেখানে ধর্মান্তকরণ সম্পন্ন হলে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি নানা সহায়তা পায়। নতুন ঘর থেকে শুরু করে তৈজসপত্র এমনকি প্রযুক্তিগত বিলাস সামগ্রীও বাদ যায় না। কিন্তু সেটা অবশ্যই ইসলামের ক্ষেত্রে নয়। ইসলামের বিষয়টি এখানে উল্টো। একে তো ইসলামকে পাহাড়িদের অনেকেই বিষদৃষ্টিতে দেখেন। মুসলমান যুবকদের সাথে প্রেম করার জন্য অনার কিলিংয়ের মতো ঘটনাও রয়েছে পার্বত্য এলাকায়। অর্থাৎ ইসলামকে এখানে এক কথায় প্রতিরোধের দৃষ্টিতে দেখা হয়। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের ক্ষেত্রে তো কথাই নেই। সেখানে ওমর ফারুক প্রতিকূল স্রোতের বিরুদ্ধে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং প্রচার করেছেন। ক্ষুদ্র জাতির মধ্যে ক্রমেই ইসলামের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হচ্ছিলো, অন্য পরিবারগুলোর ইসলাম গ্রহণের মধ্যেই তা বোঝা যায়। সেটাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওমর ফারুকের মৃত্যুর কারণ।

না, ওমর ফারুক কোনো রাজনৈতিক দল করতেন না। পাহাড়িদের প্রতি বিদ্বেষও সৃষ্টি করেননি তিনি। সমাজে তার জন্যে কোনো ধরনের অসহিষ্ণুতাও তৈরি হয়নি। তিনি সশস্ত্র জিহাদের ডাকও দেননি। তিনি শুধু ইসলামের প্র্যাকটিস করছিলেন। তাতেই তাকে হত্যা করা হল। জানিয়ে দেওয়া হলো, ইসলামের অনুশীলন এবং ইসলাম প্রচার পাহাড়ে নিষিদ্ধ। অথচ যারা পাহাড় নিয়ে কথা বলেন, এ বিষয়ে তাদের টু শব্দটি নেই। ওমর ফারুকও তো পাহাড়ের একজন, সম্প্রদায়গতভাবে তিনি বাঙালি নন, একজন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। তবে তার মৃত্যুতে পাহাড়-পাহাড়িদের নিয়ে যারা কথা বলেন তারা চুপ কেন?

বিদ্বেষের ঝাঁপি

এই চুপ থাকার কারণ বিশ্লেষণ করতে গেলেই প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে যায়। যে ঝাঁপি থেকে বের হতে থাকে বিদ্বেষ আর স্বার্থের ভয়ংকর সব সাপ। যে সাপগুলো দিনের পর দিন ছোবল মেরে যাচ্ছে আমাদের সামাজিক, সম্প্রদায়গত এবং রাষ্ট্রীয় ঐক্যের শরীরে। সেই ছোবলে আমরা ক্রমশ খণ্ডিত হচ্ছি, আর বিষের যন্ত্রণায় নিজের অবিচ্ছেদ্য শরীরেও আঘাত করছি। বিচ্ছিন্ন করছি নিজেকে নিজের থেকে। আত্মকলহ আর সংঘাতে আমরা এতই ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছি সেই সব সাপদের আনন্দিত হিসহিস আমাদের কানে আসছে না। তাদের লোভের দ্বিখণ্ডিত জিহ্বার আস্ফালন আমাদের নজর কাড়ছে না।

শঙ্কা ও সম্ভাবনা

ইসলামপন্থীরা কেন অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলেন না, এমন ভাবার আগে এসব ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করা উচিত। একই সাথে ইসলামের পক্ষ নিয়ে লজিক্যালি যারা কথা বলেন, তাদের ক্ষেত্রেও দেখা যায়, কথা শুরুর আগেই আত্মপক্ষ সমর্থনের স্টাইলে ‘আমি প্র্যাকটিসিং মুসলিম না, তবুও আমি বলছি’-এ ধরনের সংলাপ আওরান। এখানে নিজেকে কেন প্রমাণ করতে হবে, আমি মুসলিম কিন্তু ধর্ম অনুশীলন করি না। আমার অনেক লেখাতে আমিও বলেছি, আমি ধর্মীয় আচার পালন করি না। কেন বলেছি, ইসলাম বিষয়ে কথা বলতে গেলে, আবার আমাকেও না কেউ নানা তকমায় অভিহিত করে, এই শঙ্কায়। হ্যাঁ, এটা শঙ্কারই কথা। যদি কেউ বলেন, শঙ্কার নয়, তাহলে তিনি সম্ভবত আমাদের সমাজের নন।

জানি, কেউ কেউ ব্লগার হত্যার কথা বলবেন। চরমপন্থা শুধু ইসলামের নামে নয়, সব ধর্ম বা বর্ণের নামেই রয়েছে। আরএসএস’কে কী বলবেন আপনি? এই তো সেদিন ভারতের ত্রিপুরাতে তিন মুসলিম যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। তাদের অপরাধ ছিল তারা গাড়িতে করে গরু নিয়ে যাচ্ছিল! ওই যে কানাডাতে গাড়ি তুলে দিয়ে মুসলিম পরিবারের চারজনকে হত্যা, তাকে কী বলবেন?

শুধু ধর্ম কেন বর্ণবাদের কথাই ধরুণ, ফ্লয়েড মারা গেল কোন মন্ত্রে? হোয়াইট সুপ্রিমেসি তো ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। তাই বলে ধর্ম মানেই খারাপ, ধার্মিকরাও? সব বর্ণই রেসিস্ট, সব সাদারাই? শ্রেণিশত্রু খতমটাও মানুষ হত্যা, তাই বলে কী সব কম্যুনিস্টই হত্যার পক্ষে? না, এমন ভাবনা হলো ভুল, এমন চিন্তা কুচিন্তা। এই চিন্তার বেড়াজাল থেকে বেরুতে হবে। মানুষে মানুষে ঐক্য গড়ার চিন্তা করতে হবে।

শেষ কথা

মানুষকে হত্যা করে কখনো বেহেশত কিংবা স্বর্গ মেলে না। মানুষকে হত্যা করে ধর্মের সাম্যবাদ কিংবা রাজনীতির সমান অধিকার কায়েম বা প্রতিষ্ঠা হয় না। মানুষকে ঘৃণা করেও না। দোজখ বা নরকের অপর হলো নাম ঘৃণা এবং তার অধিবাসীরা ঘৃণাবাদী। সকল রকম ঘৃণাবাদ বর্জন করাটাই ধর্ম এবং শুদ্ধ রাজনীতি। মানুষকে ভালোবাসাটাই ধর্ম। সকল মানুষের সমঅধিকারটা বিশুদ্ধ রাজনীতি। সুতরাং চিন্তাটাকে বিস্তৃত করতে হবে, সিলেক্টিভ পরিধির ক্ষুদ্র বৃত্তটা ভাঙতে হবে। তবেই না সকল অবিচার, অত্যাচারের অবসান সম্ভব।

কাকন রেজা : সাংবাদিক ও কলাম লেখক

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন