পাহাড়ের অস্থিরতায় পর্যটকদের চাপ বাড়ছে কক্সবাজার ও সিলেটে

fec-image

যেকোনো উৎসবে দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ থাকে বান্দরবান, রাঙ্গামাটিসহ পার্বত্যাঞ্চল। যদিও পাহাড়ে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে বান্দরবানসহ পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটি এলাকায় তুলনামূলক ভালো পর্যটক সমাগমের প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া সিলেট ও কক্সবাজারসহ দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বরাবরের মতোই দেশের বিত্তবান শ্রেণীর বড় অংশ এবারো ঈদ অবকাশের জন্য পাড়ি দিচ্ছেন পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান ও ট্যুর অপারেটররা জানিয়েছে, এবারের ঈদে বাংলাদেশী উচ্চবিত্তের প্রধান গন্তব্য থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), শ্রীলংকা ও ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশেও যাচ্ছেন অনেকে। আর মধ্যবিত্তের একাংশ যাচ্ছে প্রতিবেশী ভারত, ভুটান ও নেপালে।

অনলাইন ট্রাভেল এজেন্সি শেয়ার ট্রিপের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা একেএম মাহফুজুল আলম পলাশ বলেন, ‘বিদেশগামী বাংলাদেশী পর্যটকরা থাইল্যান্ড, মালদ্বীপ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া বেশি যাচ্ছেন। নতুন করে এ তালিকায় ভিয়েতনামও রয়েছে। তবে এবার ইউএইগামী বাংলাদেশীদের সংখ্যা কম।’

তিনি বলেন, ‘‌দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটনের মধ্যে কক্সবাজারের চাপ সবচেয়ে বেশি। সিলেট ও উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয়ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পর্যটক যাবেন। সিলেট বিভাগের দুর্গম এলাকাগুলো ভ্রমণে আলাদা একটি শ্রেণী তৈরি হয়েছে।’

পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ পর্যটন কেন্দ্র বান্দরবান। খাগড়াছড়ি বা রাঙ্গামাটির চেয়ে এখানে পর্যটক সমাগম হয় বেশি। বান্দরবান সদর ছাড়াও জেলার দুর্গম ছয় উপজেলা থানচি, রোয়াংছড়ি, আলীকদম, রুমা, লামা ও নাইক্ষ্যংছড়িতে প্রতি বছর প্রচুর পর্যটক আসেন। কয়েক বছর ধরে বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়গুলোয় কমিউনিটি ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা বাড়ায় ঈদকেন্দ্রিক পর্যটনে প্রচুর দর্শনার্থীর আগমন হতে দেখা গেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবান জেলায় দেখা দেয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানে পর্যটক ভ্রমণে কয়েক দফায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে এখানকার ব্যবসায়ীরা নানা পরিকল্পনা নিলেও সেগুলো বাস্তবায়ন খুব একটা সম্ভব হবে না বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

বান্দরবান শহরে হোটেল-মোটেল আছে অন্তত ৮৫টি। উপজেলাভিত্তিক হোটেল-মোটেলকে হিসেবে নিয়ে এ সংখ্যা দাঁড়ায় দেড় শতাধিকে। রমজানের তৃতীয় সপ্তাহেও এসব আবাসিক হোটেলে অগ্রিম বুকিং ছিল ৩০ শতাংশের বেশি। পর্যটন ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল রমজানের শেষ দিকে এ হার ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু সর্বশেষ কয়েক দিন আগে বান্দরবানের রুমা, থানচিতে ঘটে যাওয়া ব্যাংক ডাকাতির ঘটনা ও যৌথবাহিনীর অভিযানে বুকিংয়ের হার কিছুটা কমেছে। অনেকেই বুকিং প্রত্যাহারও করেছেন।

জানতে চাইলে বান্দরবান হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে বান্দরবানের পর্যটন শিল্প বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গত দুই বছরে কয়েক দফায় বান্দরবানের বেশ কয়েকটি উপজেলায় পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা ছিল। এবার সংকট থাকলেও জেলা সদরকেন্দ্রিক অনেক পর্যটন স্পট রয়েছে। প্রশাসনের সহযোগিতায় সদরকেন্দ্রিক পর্যটনকে উৎসাহিত করতে আমরা কাজ করছি। দুর্গম উপজেলাগুলোর পরিস্থিতির কারণে জেলায় ঈদে ২০-৩০ শতাংশ পর্যটক কমার আশঙ্কা রয়েছে।’

পাহাড়ের অস্থিরতায় বাড়তি পর্যটকের চাপ পড়তে যাচ্ছে কক্সবাজারের ওপর। ধারণ সক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটককে সেবা দিতে কক্সবাজারের প্রায় সাড়ে ৫০০ হোটেল-মোটেল প্রস্তুতি নিলেও সেটি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীদের হিসাবে এখানে পর্যটক সেবার সঙ্গে যুক্ত নিবন্ধিত আবাসিক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫২০টি। এসব প্রতিষ্ঠানের সর্বমোট ধারণক্ষমতা প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার। তাছাড়া অনিবন্ধিত হোটেল-মোটেল ও সরকারি রেস্ট হাউজসহ আরো অন্তত ৩০ হাজার পর্যটকের রাতযাপনের সুযোগ রয়েছে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণ পর্যটক সমাগমের রেকর্ড রয়েছে কক্সবাজারে। তবে এবার পার্বত্যাঞ্চলের অস্থিরতার পাশাপাশি যাতায়াতে ট্রেন যুক্ত হওয়ায় পর্যটকের আধিক্য অতীতের যেকোনো সময়কে ছাড়াতে পারে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

কক্সবাজার হোটেল, রিসোর্ট, গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, ‘ঈদ সামনে রেখে কক্সবাজারের হোটেল-রেস্তোরাঁর সংস্কারকাজ চলছে। পর্যটকদের বাড়তি চাপ সামলানো ও ভোগান্তি কমাতে প্রতি বছর ঈদে নতুন বিনিয়োগ করেন মালিকরা। এ বছর ঈদুল ফিতর ও নববর্ষের টানা দীর্ঘ ছুটির কারণে কক্সবাজারে ভিড় বেশি হবে। পার্বত্য জেলাগুলোয় অস্থিরতার কারণেও কক্সবাজারে ঈদকেন্দ্রিক পর্যটনের চাপ আসবে। আমরা বিষয়টি মাথায় রেখে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা রাখার পরিকল্পনা করছি। পাশাপাশি পর্যটকদের ভোগান্তি কমাতে বিশেষ নির্দেশনা ছাড়াও প্রশাসনের নজরদারি বাড়ানো হবে।’

এবার কক্সবাজারমুখী পর্যটকের চাপ সামাল দিতে এরই মধ্যে বিভিন্ন এয়ারলাইনসের ফ্লাইট সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। আগে প্রতিদিন চার-পাঁচটি ফ্লাইট চলাচল করলেও ঈদ উপলক্ষে প্রতিদিন ২০টি (উভয়মুখী) ফ্লাইট চলাচল করবে কক্সবাজারে। নিয়মিত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দুই জোড়া আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করছে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ চালুর পর থেকেই। এছাড়া ঈদ সামনে রেখে বাংলাদেশ রেলওয়ে কক্সবাজারের জন্য প্রতিদিন দুই জোড়া বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলো সরাসরি কক্সবাজারে পৌঁছলেও বিশেষ দুই জোড়া ট্রেন প্রতিদিন চট্টগ্রাম থেকে একাধিক স্টেশনে যাত্রাবিরতি দিয়ে কক্সবাজারে যাত্রী পরিবহন করবে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তজা হোসেন বলেন, ‘‌ঈদের একদিন আগ থেকে কক্সবাজার রুটে চাপ রয়েছে। ঈদের পরের দিন থেকে কক্সবাজারে দৈনিক ২০টি ফ্লাইট আসবে, ২০টি যাবে। এবারের ঈদে ছুটিতে পর্যটকের টিকিটের চাহিদা বেশি। এরই মধ্যে আমরা আরো কয়েকটি ফ্লাইট বাড়ানোর পরিকল্পনা করছি।’

দেশের বিভিন্ন পর্যটন স্পটে পর্যটক সমাগম সবচেয়ে বেশি হয় শীত মৌসুমে। এরপর সবচেয়ে বেশি হয় ঈদ-পরবর্তী সপ্তাহজুড়ে। টানা ছুটির কারণে কক্সবাজারের মতো দেশের অন্যান্য পর্যটন কেন্দ্রেও এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়বে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

সিলেট বিভাগের জেলাগুলোয় সারা বছরই পর্যটকের ভিড় থাকে। এবারের ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে সিলেট অঞ্চলের জেলাগুলোয় পর্যটক সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে মনে করছেন হবিগঞ্জের দ্য প্যালেস লাক্সারি রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘এবারের ঈদের ছুটি বেশ লম্বা। আগামী ১২-১৪ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের রিসোর্টের বুকিং বেশ ভালো। ১৫-১৬ তারিখের বুকিং কিছুটা শ্লথ। তবে ২০-২১ তারিখ বুকিংয়ের চাপ অনেক বেশি। পর্যটকরা সিলেটে আসেন চা বাগান, পাহাড় ও ঝরনা দেখতে। এবার বৃষ্টি হওয়ায় চা বাগান অনেক বেশি সবুজ। আশা করছি, পর্যটকরা এবারের ঈদ ভালোভাবেই উপভোগ করতে পারবেন।’

পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির হোটেল-মোটেলগুলোয় পর্যটকরা আগাম বুকিং দিয়ে রাখলেও পাহাড়ের বর্তমান প্রেক্ষাপটে উদ্বেগ রয়েছে রাঙ্গামাটির পর্যটন শিল্প নিয়েও। তবে হোটেল-মোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, পরপর কয়েকটি উৎসব একসঙ্গে পড়ে যাওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে তারা এখনো খুব একটা শঙ্কিত নন। রাঙ্গামাটি পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা বলেন, ‘এবারের দুটি উৎসব একত্রিত হয়েছি। একদিকে ঈদ আরেকদিকে নববর্ষ—যেটা রাঙ্গামাটিতে বিজু উৎসব। একই সময়ে দুটি উৎসবের কারণে আমরা প্রত্যাশা করছি রাঙ্গামাটিতে আশানুরূপ পর্যটকে সমাগম ঘটবে। পর্যটকদের সেবায় আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।’

রাঙ্গামাটি জেলা আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মঈনুদ্দিন সেলিম বলেন, ‘বিগত কয়েক বছরের চেয়ে এবারের ঈদে ছুটিতে রাঙ্গামাটিতে রেকর্ডসংখ্যক পর্যটকের সমাগম হবে প্রত্যাশা করছি। এরই মধ্যে জেলা শহরে অবস্থিত হোটেল-মোটেলগুলোয় ৭০ শতাংশ রুম বুকিং হয়ে গেছে। ঈদ ঘিরে আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীরা ভালো ব্যবসা করতে পারবেন আশা করি।’

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতেও এবার পর্যটক সমাগম বেশি হবে বলে প্রত্যাশা করছেন ব্যবসায়ীরা। এরই মধ্যে ৬০ শতাংশ হোটেল-মোটেল কক্ষ বুকিং হয়েছে বলে স্থানীয় হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। পর্যটকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ও সেবা দিতে প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও পৌর কর্তৃপক্ষ।

হোটেল-মোটেল ওনার্স অসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরিফ বলেন, ‘‌আমরা আশাবাদী পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পয়লা বৈশাখের ছুটিকে কেন্দ্র করে কুয়াকাটায় অনেক ট্যুরিস্টের আগমন হবে। আবার আগের মতো প্রাণ খুঁজে পাবে কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। হোটেল-মোটেলগুলোয় ৬০ শতাংশের মতো আগাম বুকিং হয়েছে।’

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: কক্সবাজার, পর্যটক, সিলেটে
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন