পাহাড়ে সকল বিশৃঙ্খলা এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী সন্তু লারমার জেএসএস মূল দল!

fec-image

পার্বত্য শান্তিচুক্তির দীর্ঘ ২২ বছর পেরিয়ে গেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি অধরাই রয়ে গেল। ১৯৯৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং তৎকালীন পিসিজেএসএস এর মাঝে সংঘঠিত শান্তি চুক্তির অন্যতম শর্ত হিসেবে তৎকালীন শান্তি বাহিনীর সকল সদস্যের অস্ত্র জমা দেওয়া এবং আত্মসমর্পণের কথা ছিল। চুক্তি পরবর্তী বিভিন্ন সময় তৎকালীন শান্তিবাহিনীর বেশ কিছু সদস্য আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও সন্তু লারমা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু অস্ত্র জমা না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দেযন, যা তিনি একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাথে সাক্ষাৎকারে এর আগে স্বীকারও করেছেন। পরবর্তীতে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং আদর্শিক কারণে পিসিজেএসএস তথা জেএসএস ভেঙে ১৯৯৮ সালে প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বে ইউপিডিএফ নামে একটি দলের জন্ম হয়। ২০১০ সালে জেএসএস আবার ভাঙ্গনের মুখে পড়ে। সন্তু লারমার একসময়ের সহযোগী সুধা সিন্ধু খীসার নেতৃত্বে জেএসএসের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মী দল থেকে বের হয়ে জেএসএস সংস্কার নামে নতুন একটি সংগঠন গঠন করে। এর পর ২০১৭ সালে তপন জ্যোতি চাকমার নেতৃত্ব ইউপিডিএফ ভেঙ্গে নতুন আরও একটি সংগঠন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) দলের সৃষ্টি হয়।

দলটি থেকে বিভিন্ন সময় বেরিয়ে যাওয়া নেতা-কর্মীদের অভিযোগ,  মূলত সন্তু লারমার একরোখা মনোভাব, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবণতা হতেই মূল সংগঠনটি ভেঙ্গে আজ চারটি আঞ্চলিক সংগঠন সৃষ্টি হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে চারটি আঞ্চলিক দল মাঠে থাকলেও সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস মূল দল এবং প্রসীত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ মূল দল বিভিন্ন প্রকার অপকর্মে বেশি সক্রিয়। এই দল দুটি চাঁদাবাজি , সন্ত্রাসী ও হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অশান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফলে এ অঞ্চলে বসবাসরত মূল ধারার বাঙালি জাতিসত্ত্বার মানুষসহ ১২টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ নিদারুণ দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে জীবন যাপন করছে।

গত কয়েক বছরের পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, মূলত সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জেএসএস মূল দলের সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে পাহাড়ে কাঙ্খিত শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দলটি মতাদর্শের ক্ষেত্রে এতই উগ্র যে, তারা কোন প্রকারের বিরুদ্ধাচারণ সহ্য করতে পারে না। শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে গত ১ বছরে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক প্রায় ১২ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে দলটির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। এক্ষেত্রে তাদের মূল টার্গেট হলো উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর সদস্য, যারা মূলধারার রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত এবং জেএসএস মূল দল ছেড়ে অন্য আঞ্চলিক দলে যোগদান করেছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী শুধুমাত্র জেএসএস মূল দল এককভাবে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে থাকে। আর এই অর্থের বড় একটি অংশ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী দল থেকে অস্ত্র সংগ্রহ, সশস্ত্র সংগঠন পরিচালনা এবং দেশে-বিদেশে বিভিন্ন লবিস্ট গ্রুপকে নিজেদের স্বার্থে কথা বলার জন্য ব্যয় করে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, বর্তমানে জেএসএস মূল দলে আনুমানিক ১৫০০ জন সক্রিয় সশস্ত্র ক্যাডার রয়েছে। তবে এই বিশাল সশস্ত্র সন্ত্রাসী দল শুধুমাত্র চাঁদাবাজি বা আধিপত্য বিস্তারের জন্য তৈরি করা হয়নি তা সহজেই অনুমেয়। দলটির পরিচালিত বিভিন্ন ব্লগ এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনুসরণ করলে দেখা যায় যে দলটির নেতাকর্মীরা এখনো বাংলাদেশ হতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন জুম্মল্যান্ড সৃষ্টিতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে, যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।

এই বিপুল সংখ্যক সশস্ত্র সন্ত্রাসীর দলকে কাজে লাগিয়ে জেএসএস মূল দল পাহাড়ে ব্যাপক চাঁদাবাজি সহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আর চাঁদার কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেলে তারা নিরীহ মানুষকে গুম, খুন, অপহরণসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালিয়ে থাকে।কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া টার্গেট করা ব্যক্তির সহায়-সম্পদ। ধারণা করা হয়, গত ২৭ এপ্রিল ২০২০ এর থানচি অগ্নিকাণ্ড , ১৪ জুন ২০২০ রাঙামাটির শুভলং বাজারে অগ্নিকাণ্ড এবং সর্বশেষ ২৭ জুন ২০২০ বান্দরবানের রোয়াংছড়ি বাজারের অগ্নিকান্ডের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। একইভাবে শুধুমাত্র আদর্শিক দ্বন্দ্বে কারণে গত ১৫ মে ২০২০ বিলাইছড়িতে অবস্থিত ডক্টর দীপঙ্কর মহাথের’র আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র টি পুড়িয়ে দেয় জেএসএস মূল দলের সন্ত্রাসীরা, যা ডক্টর দীপঙ্কর ১৮ মে ২০২০ রাঙ্গামাটি প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করেন এবং তার এই অভিযোগের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এর আগে গত ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ, উপজেলা নির্বাচন পরবর্তী নির্বাচনের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে সাজেক থেকে বাঘাইছড়িতে ফেরত আসার সময় গাড়ি বহরের উপরে জেএসএস মূল দলের সন্ত্রাসীরা আক্রমণ চালালে ঘটনাস্থল ৬ জন ও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও দুজনসহ মোট ৮ জন মৃত্যুবরণ করে এবং এ হামলায় আরো ১৬ জন গুরুতর আহত হয়। এই ঘটনার সাথে সন্তু লারমা ও তার দলের সম্পৃক্ততার বিষয়টি পরবর্তীতে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং গোয়েন্দা সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়।

সন্তু লারমা ও তার দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সর্বশেষ শিকার মঙ্গলবার (৭ জুলাই ২০২০) বান্দরবানের বাঘমারা এলাকার ৬ জন নিরীহ পাহাড়ি মানুষ। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, হত্যাকাণ্ডের শিকার এই সকল ব্যক্তি একসময় জেএসএস মূল দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে সম্প্রতিক সময়ে তারা জেএসএস মূল দল ত্যাগ করে, যার মূল্য দিতে হলো জীবন দিয়ে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় যে, গত এক বছরে আন্তঃদলীয় কোন্দলে এই দলটির সন্ত্রাসীদের হাতে অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারিয়েছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এখন সময় এসেছে এই সন্ত্রাসী দলটির কর্মকাণ্ডের লাগাম টেনে ধরার। প্রয়োজনে সন্তু লারমার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই দলটির সন্ত্রাসী কার্যক্রম যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয় তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে মৃত্যুর মিছিল আরো দীর্ঘায়িত হতে থাকবে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং এই অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের জীবন রক্ষার্থে জেএসএস মূল দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত বিভিন্ন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের পদক্ষেপ গ্রহণে সরকারের কাছে বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি।

লেখক: খাগড়াছড়ি থেকে।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জেএসএস, হত্যাকাণ্ডের
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন