উপদেষ্টা ফরিদা আখতার

ফারাক্কা বাঁধ এ দেশে কারবালা তৈরি করেছে

fec-image

এখন সময় এসেছে এই অধিকার ভারতের কাছ থেকে আদায় করে নেওয়ার

পদ্মার উজানে ভারতের দেওয়া ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশে কারবালা তৈরি করেছে বলে দাবি করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেছেন, পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ার কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এ দেশ। সরকার তৎপর রয়েছে ন্যায্য হিস্যা আদায়ে।

শুক্রবার (১৬ মে) বিকেলে রাজশাহী কলেজে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন তিনি। ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাজশাহী কলেজের মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি যোগ দেন।

মৎস্য উপদেষ্টা বলেন, আজকের এই দিনে ৯০ বছর বয়সে ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন মাওলানা ভাসানী। ভারতের সঙ্গে তো আবারও চুক্তি করছি আমরা। চুক্তি সাইন করব। যদি ঠিকমতো পানি না পাই আমরা, সেক্ষেত্রে দরকার হলে আন্তর্জাতিকভাবেও এটা নিয়ে যাব আমরা। যে ক্লজগুলো ফারাক্কা চুক্তিতে আছে, সেটা আদায় করার চেষ্টা করব আমরা।

তিনি বলেন, ছয় কোটি মানুষ সরাসরি ও পরোক্ষভাবে আরও অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফারাক্কার কারণে। জীবন-জীবিকা, খাদ্য, মাছ, জলজ প্রাণী সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। পানিও শুকিয়ে গেছে। এই দেশে কারবালা তৈরি করেছে ফারাক্কা। কাজেই এই বিচার চাইব আমরা। সরকার হিসেবে চাপ সৃষ্টি করব আমরা। এই চাপ থাকবেই। সেভাবেই চুক্তি নবায়ন করব আমরা।

সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. ইফতিখারুল আলম মাসুদ। তিনি তার প্রবন্ধে কয়েকটি প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “আগামী বছর ফারাক্কা চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। নতুন চুক্তি নবায়নের সময় গ্যারান্টি ক্লজ, যা শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করে—তা অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”

ড. ইফতিখারুল আলম মাসুদ বলেন, “ফারাক্কার সমস্যাকে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সংকট হিসেবে চিহ্নিত করে রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। জনমত গড়ে তুলতে হবে। সমাধানে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।”

সভায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব। তিনি বলেন, “ফারাক্কা আমাদের অভিশাপ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৮ কোটি মানুষের দেশে নদী বিশেষজ্ঞ পাঁচজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভারতের কাছ থেকে পানি আদায় করতে হলে আমাদের নিজস্ব নদী বিশেষজ্ঞ দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ে নদী আইন বিষয়ক একটি বিভাগ খোলা উচিত। ফারাক্কা বাঁধ দেওয়ার পর বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতির সঠিক হিসাব নিরূপণ করাও জরুরি।”

তিনি আরো বলেন, “বিগত ১৬ বছরে ভারতের তাঁবেদারি করেও ন্যায্য হিস্যা আদায় করা যায়নি। এখন অন্যান্য দলও ভারতকে তুষ্ট করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। এই স্বপ্নকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে হবে। এ জন্য আমাদের ছাত্র-জনতাকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে হবে।”

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, “ভারত সব সময় গঙ্গা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্রকে একই অববাহিকা ধরে সমস্যা সমাধানের কথা বলে। কিন্তু এভাবে সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ করতে হবে। শুধু গঙ্গার পানি চেয়ে কাজ হবে না, প্রধান দাবি হতে হবে ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ।”

প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, “ভারত প্রকৃতির রহমতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই বাঁধ নির্মাণ করেছে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৪৯ বছর আগেই এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদেরও দাঁড়াতে হবে। বাঁধটাই ধ্বংস করতে হবে। ভারতেও এ নিয়ে আন্দোলন রয়েছে। আমাদের সামনে এটাই শেষ সুযোগ—চরম আন্দোলনের মাধ্যমে ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ।”

লেখক ও গবেষক বেনজিন খান বলেন, “ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভাগিরথী নদী থেকে পলিমুক্ত পানি সরিয়ে নিচ্ছে, আর বর্ষা মৌসুমে আমাদের পলিযুক্ত পানি দিচ্ছে। এতে নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে, বন্যায় দেশ ডুবে যাচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদি গণহত্যার সামিল। এই অবস্থা চলতে পারে না।”

তিনি আরো বলেন, “উজানের দেশ ভাটির দেশের অসম্মতিতে নদীতে কোনো কাজ করতে পারে না। অতিরিক্ত পানি তুলতেও পারে না—আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী। তাই এই বাঁধ অবৈধ। এখন পানির হিস্যা নয়, আমাদের দাবি হতে হবে, ফারাক্কা বাঁধ অপসারণ। এজন্য ভারতের প্রতিবেশী শত্রু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। কারণ শত্রুর শত্রুই বন্ধু।”

সভায় সভাপতিত্ব করেন ফারাক্কা লংমার্চের ৪৯ বর্ষপূর্তি উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক ও নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। তিনি বলেন, “আগের সরকারের নানামুখী বাধা উপেক্ষা করে ২০১৪ সাল থেকে আমরা এই দিবসটি উদযাপন করে আসছি। এখন এই আন্দোলনে যুবসমাজ যুক্ত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বিগত সরকার সামনে একজনকে দাঁড় করিয়ে বাকি সবাইকে অগোচরে রেখেছে। আমি দাবি করব, পাঠ্যপুস্তকে যেন মওলানা ভাসানীকে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।”

সভায় আরো বক্তব্য দেন- রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মু. যহুর আলী, রাজশাহী অ্যাডভোকেট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবুল কাশেম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠক ত্বা-সিন খান। সভা সঞ্চালনায় ছিলেন লেখক ফজলুল হক তুহিন ও সাংবাদিক সাদিকুল ইসলাম স্বপন।

সভা শুরুর আগে রাজশাহী কলেজের সামনে থেকে র‌্যালি বের করা হয়। সেটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে একই স্থানে গিয়ে শেষ হয়। পরে উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এলে রাজশাহী কলেজ বিএনসিসির পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: ফরিদা আখতার, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন