পার্বত্যাঞ্চলে কারা শোষিত, কারা শোষক?

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা শোষিত আর কারা শোষক, এই প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়। এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে জনসংখ্যানুপাতে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির হার দেখা যেতে পারে। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন মতে, তিন পার্বত্য জেলা তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান জেলার মোট জনসংখ্যা ১৮৪২৮১৫ জন। এর মধ্যে বাঙালি ৯২২৫৯৮ (৫০.০৬%) জন এবং অবাঙালি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ৯২০২১৭ (৪৯.৯৪%) জন। অবাঙালি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের মধ্যে খিয়াং ৪,৮২৬ (০.২৯%), খুমি ৩,৭৮০ (০.২৩%), গুর্খা ১০০ (০.০১%), চাক ৩,০৭৭ (০.১৯%), চাকমা ৪৮৩,২৯৯ (২৯.২৯%), তঞ্চঙ্গা ৪৫,৯৭২ (২.৭৯%), ত্রিপুরা ১৫৬,৫৭৮ (৯.৪৯%), পাংখোয়া/পাংখো ১,৮৫৭ (০.১১%), বম ১৩,১৯৩ (০.৮০%), মারমা ২২৪,২৬১ (১৩.৫৯%), ম্রো ৫২,৪৫৫ (৩.১৮%), লুসাই ৩৮০ (০.০২%)।

এখন দেখা যাক রাষ্ট্রীয় সুবিধা প্রাপ্তির হার কেমন?

খাদ্যশস্য বরাদ্দ

গত ১৩ মে ২০২৫ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রকল্প কর্মসূচি থেকে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের অনুকূলে খাদ্যশস্য বরাদ্দের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তবে এটি নতুন কোনো তালিকা নয়। গত ২৭ মার্চ ২০২৫ যে তালিকা প্রকাশের পর স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, জাতিগত বৈষম্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, সেটি বাতিল করে সংশোধিত এই তালিকা প্রকাশ করেছে মন্ত্রণালয়।

১৩ মে প্রকাশিত সংশোধিত তালিকায় ৫৮ জন ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে মোট বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে ১৫২২ মে. টন খাদ্যসশ্য।  এর মধ্যে বাঙালি ৫ জন (৮.৬২%) বরাদ্দ পেয়েছেন ৮০ মে. টন (৫.২৬%), চাকমা পেয়েছেন ৫২ জন (৮৯.৬৬%)  বরাদ্দ পেয়েছেন ১৪৩২ মে. টন (৯৪.০৯%) এবং মারমা পেয়েছেন ১ জন (১.৭২%) বরাদ্দ পেয়েছে ১০ মে. টন (০.৬৬%)।

এর আগে ২৭ মার্চ যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানেও মোট ৫৮ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে মোট ১৯১৩ মে. টন খাদ্যসশ্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে বাঙালি ৫ জন (৮.৬২%) বরাদ্দ পেয়েছেন ৮০ মে. টন (৪.১৮%), চাকমা পেয়েছেন ৫২ জন (৮৯.৬৬%)  বরাদ্দ পেয়েছেন ১৮২৩ মে. টন (৯৫.৩০%) এবং মারমা ১ জন (১.৭২%) বরাদ্দ পেয়েছেন ১০ মে. টন (০.৫২%)।অথচ, ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুসারে খাগড়াছড়ির মোট জনসংখ্যা ৭১৪১১৯ জন। এর মধ্যে বাঙালি ৩৬৪৭৪১ (৫১.০৮%) জন এবং অবাঙালি ৩৪৯৩৭৮ (৪৮.৯২%) জন। অবাঙালিদের মধ্যে চাকমা ১৭৫,১৬৫ (২৪.৫৩%) জন, ত্রিপুরা ৯৮,৫০০ (১৩.৮০%) জন, মারমা ৭৪,২১০ (১০.৩৯%)  জন এবং অবশিষ্টরা অন্যান্য জনগোষ্ঠির।

অর্থাৎ জনসংখ্যানুপাতে খাদ্যসশ্য বণ্টিত হলে বাঙালিদের পাওয়ার কথা ৫১.০৮% পেয়েছে ৮.৬২%, চাকমাদের পাওয়ার কথা ২৪.৫৩% পেয়েছে ৮৯.৬৬%, মারাদের পাওয়ার কথা ১০.৩৯% পেয়েছে ১.৭২%, ত্রিপুরাদের পাওয়ার কথা ১৩.৮০% পেয়েছে ০.০০%।

অর্থ বরাদ্দ

পার্বত্য মন্ত্রণালয় গত ২৫ মার্চ ২০২৫ খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের মাধ্যমে বণ্টনের জন্য আপদকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় ১৯৫ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানকে ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দিয়ে একটি তালিকা প্রকাশ করে। ১৯৫ ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় বাঙালি ৪১ (২১.০৩%), চাকমা ১০০ (৫১.২৮%), মারমা ৪২ (২১.৫৪%), ত্রিপুরা ১০ (৫.১৩%) এবং সাঁওতাল ২ (১.০৩%) অর্থ বরাদ্দ পেয়েছেন। জেলায় মোট বরাদ্দকৃত ৩ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকার মধ্যে বাঙালি ৪২ লাখ ৯০ হাজার টাকা (যা মোট বরাদ্দের ১৩.৭৩%), চাকমা ২ কোটি ২৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা (যা মোট বরাদ্দের ৭৩.০৯%), মারমা ২১ লাখ ৭০ হাজার টাকা (যা মোট বরাদ্দের ৬.৯৪%), ত্রিপুরা ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা (যা মোট বরাদ্দের ৫.৬০%) এবং সাঁওতাল ২ লাখ টাকা (যা মোট বরাদ্দের ০৬৪%) পেয়েছেন।

রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদে নিয়োগ

রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের অধীনে RHDC- ERRD-CHT, UNDP’ এর যৌথ প্রকল্পের জনবল নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে গত ২২ নভেম্বর ২০২৪ শুক্রবার। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে ২৩ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার। মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার পর ওই দিন তথা শনিবারই নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন পদে মোট ১৯ জনকে নিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাঙালি মাত্র ২ জন (১০ শতাংশ), অবাঙালি ১৭ জন (৯০ শতাংশ)!

উন্নয়ন বোর্ডের শিক্ষা বৃত্তি

গত ১৭ অক্টোবর ২০২৩  পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (পরিকল্পনা) মো. জসীম উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ২০২২-২৩ অর্থ বছরের শিক্ষা বৃত্তি প্রাপ্তদের তালিকা প্রকাশ করে উন্নয়ন বোর্ড। উন্নয়ন বোর্ড ২ হাজার ১শ’ ৯৯ শিক্ষার্থীকে বৃত্তির জন্য নির্বাচিত করেছে। বৃত্তি প্রাপ্ত ২ হাজার ১শ’ ৯৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে এবার বাঙালি শিক্ষার্থী ৬শ’ ৯৫ জন (মাত্র ৩১ দশমিক ৬১ শতাংশ) এবং অবাঙালি শিক্ষার্থী ১ হাজার ৫শ’ ৪ জন (৬৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ)। জনসংখ্যার দিক থেকে উভয় জনগোষ্ঠির সদস্য সংখ্যা প্রায় সমান সমান হলেও দুই সম্প্রদায়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী সংখ্যার ব্যবধান প্রায় ৩৭ শতাংশ।

রাঙামাটি জেলা পরিষদ শিক্ষাবৃত্তি

রাঙামাটি জেলা পরিষদের শিক্ষা উপবৃত্তি ২০২৩-এর তালিকায় দেখা যায়, এইচএসসি থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে জেলার ৬৫০ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করেছে জেলা পরিষদ। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাঙালি ২১৬ জন, যা মোট বৃত্তির ৩৩.২৩ শতাংশ, অন্যদিকে অবাঙালি তথা বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থী আছেন ৪৩৪ জন, যা মোট বৃত্তির ৬৬.৭৭ শতাংশ। অবাঙালি বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাকমা ২২৬ (৩৪.৭৭%), মারমা ৮৬ (১৩.২৩%), তঞ্চঙ্গা ৪৫ (৬.৯২%), ত্রিপুরা ২১ (৩.২৩%), পাংখুয়া ৪৯ (৭.৫৪%), বম ৩ (০.৪৬%) খিয়াং ১ (০.১৫%), আসাম ১ (০.১৫%), রাখাইন ১ (০.১৫%), চাক ১ (০.১৫%) এবং বাঙালি ২১৬ (৩৩.২৩%)।

পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত এই বৈষম্য শুধু উল্লেখিত উদাহরণগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং শিক্ষা, চাকরি, রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বত্রই বিরাজমান। আর এসব বৈষম্যই প্রমাণ করে পাহাড়ে কোন জনগোষ্ঠির মানুষ শোষণের শিকার হচ্ছে, আর কোন জনগোষ্ঠি অন্য সকল জনগোষ্ঠিকে শোষণ করছে।

 

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন