আনসার সদস্যদের বেতনের টাকা কেটে কর্তাদের ব্যবসা!

033229Pic-27

রেজোয়ান বিশ্বাস : রাজধানীর রমনা থানার সামনে গত বৃহস্পতিবার মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন এক আনসার সদস্য। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটি রাখতেই দেখা যায় তাঁর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশ সদস্য সেই দৃশ্য দেখে এগিয়ে গিয়ে কান্নার কারণ জানতে চান। ওই আনসার সদস্য তাঁকে বলেন, প্রতি মাসেই জুলুম করে বেতনের টাকা থেকে একটি অংশ কেটে রাখেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। প্রতিবাদ করায় ওই কর্মকর্তা তাঁকে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দিয়েছেন। পরে ওই আনসার সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর বেতন মাসে আট হাজার ৭৫৪ টাকা। এই টাকা দিয়েই দুই সন্তান, স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে খুব কষ্টে সংসার চালাতে হয়। এক মাস বেতন না পেলে পরিবার উপোস থাকে। আর বেতনের পুরো টাকা না পেলে কষ্ট বাড়ে। কিন্তু প্রতি মাসেই বেতন দেওয়ার সময় নানা টালবাহানা করেন কর্মকর্তারা। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক আশা নিয়ে সকালে বেতনের টাকা তুলতে অফিসে যাই। কিন্তু ছয় হাজার টাকা হাতে দিয়ে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাকে জানান, বাকি দুই হাজার টাকা পরে দেওয়া হবে।’

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অফিসে কর্মরত আরো অন্তত ৩০ জন আনসার সদস্যের সঙ্গে কথা বলে একই ধরনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁদেরও বেতনের একাংশ কেটে রাখেন কর্মকর্তারা। আবার বেতন দেওয়ার সময় খুচরা বা ভাংতি না থাকার অজুহাতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ১০ থেকে ২০ টাকা করে কম দেন। রেশনের গম ও চাল কম দেওয়া হয় ওজনে। এ ছাড়া চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে

অন্যমিডিয়া

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে দিতে হয় ছয় মাসের মোবাইল ফোন খরচের টাকা। সাপ্তাহিক ছুটির বাইরে বাড়তি ছুটি নিলে ঘুষ দিতে হয় কর্মকর্তাদের। অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করলেও শাস্তি দেওয়া হয়। আবার ঘুষ দিলে সেই শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যায়। এ রকম নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আনসারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন মাঠপর্যায়ের লক্ষাধিক সদস্য।

অভিযোগ রয়েছে, আনসার সদস্যদের বেতনের অংশ কেটে নিয়ে ঊর্ধ্বতন আনসার কর্মকর্তারা নিজেদের ব্যবসার কাজে লাগান। এরপর সুবিধামতো ওই টাকা কয়েক কিস্তিতে ফেরত দেন তাঁরা। এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে সদস্যদের চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেন কর্মকর্তারা। এমনকি এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এ পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনের চাকরিও চলে গেছে।

জানা যায়, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার নিরাপত্তা, জননিরাপত্তামূলক কাজ, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিরাপত্তাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। থানা পর্যায় থেকে জেলা কমান্ড্যান্টদের মাধ্যমে বেসরকারিভাবে আনসারে লোক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০-২৫ জনের টিম করে তাঁদের ৪২ দিনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সফিপুর আনসার একাডেমিতে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আনসার সদস্যরা জেলা কমান্ড্যান্টের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পান। নিয়ম অনুযায়ী একজন আনসার সদস্যকে তিন বছরের চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতি মাসে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে জেলা কমান্ড্যান্টদের কাছে তাঁদের বেতনের টাকা পাঠানো হয়। জেলা কমান্ড্যান্টের কাছ থেকে থানা আনসার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ের আনসার সদস্যদের বেতন দেওয়া হয়। বর্তমানে অর্ধলক্ষাধিক আনসার সদস্য মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালনকারী মাঠপর্যায়ের বেশির ভাগ আনসার সদস্যই সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানা অবিচারের শিকার।

জানা যায়, খণ্ডকালীন চুক্তিতে মাঠপর্যায়ে নিয়োজিত দরিদ্র আনসার সদস্যরা যাতে ঠিকমতো বেতন পান সে জন্য আনসার-ভিডিপি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যাংকের মাধ্যমে তাঁদের বেতন দেওয়া হয় না। অভিযোগ আছে, আনসার সদস্যদের বেতনের টাকা উঠিয়ে ওই কর্মকর্তারা অন্য ব্যাংকে নিজস্ব অ্যাকাউন্টে রাখেন। মাস শেষে থানা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তাঁদের বেতনের টাকা দেওয়া হয় হাতে হাতে। অথচ মাসের শুরুতেই বেতন দেওয়ার কথা।

মো. আরমান, সাইদুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন আনসার সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠপর্যায়ের একজন আনসার সদস্য বেতন পান আট হাজার ৭৫৪ টাকা। পাশাপাশি প্রতি মাসে রেশন পান ২৮ কেজি চাল, ২৮ কেজি গম ও দুই লিটার সয়াবিন তেল। কিন্তু বেতনের টাকা কেটে নেওয়ার পাশাপাশি মাস শেষে ২৮ কেজির পরিবর্তে ২৪ কেজি চাল ও ২৪ কেজি গম দেওয়া হচ্ছে একেকজনকে। গত বুধবার তেজগাঁও আনসার গুদাম থেকে রেশন উত্তোলন করা কয়েকজন আনসার সদস্য দাবি করেন, প্রতি মাসে ৯ জনের গ্রুপ করে একসঙ্গে তাঁরা রেশন তোলেন। কিন্তু ওই চাল-গম বাসায় নিয়ে ওজন করে তাঁরা বস্তাপ্রতি ৫ থেকে ১০ কেজি চাল ও গম কম পান। পরে এ নিয়ে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হয় না। রেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জানানো হলে উল্টো তাঁরা নাখোশ হন। বেশি বলতে গেলে চাকরিচ্যুত করার হুমকি দেওয়া হয়। জানা যায়, মাঠকর্মীদের রেশনের চাল ও গম কম দিয়ে যা জমে তা কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আনসার সদস্য বলেন, সাপ্তাহিক ছুটি নেই। প্রতিদিন আট থেকে ১২ ঘণ্টা রাস্তায়, অফিসের গেটে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। তিন মাস পর ছুটি পেয়ে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গ্রামে যাওয়ার অনুমতি মেলে তাঁর। কিন্তু আট দিনের ছুটি পেতে তাঁকে প্লাটুন কমান্ডারকে ৫০০ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

জাতীয় সংসদের হুইপ আতিউর রহমান আতিক গত মাসে এক সভায় শেরপুরে আনসার সদস্য নিয়োগে ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ আনেন। গত ১৪ জানুয়ারি শেরপুরের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তিনি ওই অভিযোগ করেন। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে হুইপ আতিক আনসারের সহকারী জেলা কমান্ড্যান্ট ঘুষ-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বলে তাঁর কাছে এর ব্যাখ্যা দাবি করেন। হুইপ আতিক বলেন, ‘যেসব গরিব মানুষ ভিটামাটি ও হালের গরু বিক্রি করে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিয়েছে সে রকম প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমার কাছে রয়েছে।’ হুইপের বক্তব্য সমর্থন করে শেরপুর সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মো. ছানোয়ার হোসেন ছানু বলেন, আনসার নিয়োগে শতভাগ অনিয়ম হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে আনসার-ভিডিপির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খন্দকার বাবর আলীর বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে দায়িত্ব পালনকারী আনসার-ভিডিপি সদস্যদের সম্মানী ভাতার কয়েক লাখ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, ওই দুটি নির্বাচনে তিন হাজার ১১২ জন আনসার সদস্যের প্রত্যেককে এক হাজার ৯৫০ টাকা করে দেওয়ার কথা থাকলেও কাউকেই পুরো টাকা দেওয়া হয়নি। অন্যায়ভাবে ১৬ জনের হাজিরা কেটে এবং প্রত্যেকের কাছ থেকে যাতায়াত বাবদ ১০০ থেকে ২০০ টাকা কেটে রাখেন কর্মকর্তারা।

এদিকে মাঠকর্মীদের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে কয়েকজন কর্মকর্তা পুরোপুরি তা অস্বীকার করেন। আনসারের ঢাকা জেলার উপপরিচালক (প্রশাসন) নূরে আলম সিদ্দিকি কালের কণ্ঠকে বলেন, আনসার বাহিনীতে কোনো ধরনের দুর্নীতি প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। তবে এত বড় বাহিনীতে কিছু অনিয়ম থাকতে পারে। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মাঠপর্যায়ের আনসার সদস্যদের কাছ থেকে এ ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায়নি। কেউ অভিযোগ দিলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সারা দেশে আনসার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। আনসারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সরকারের এক শ্রেণির কর্মকর্তা তাঁদের রক্ষা করে চলেছেন বলে অভিযোগ আছে। আনসারের কোনো কোনো কর্মকর্তা বিভিন্ন দুর্নীতিতে লিপ্ত রয়েছেন বলে সম্প্রতি একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সরকারকে জানানো হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরের সফিপুরে বাংলাদেশ আনসার-ভিডিপি একাডেমিতে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৩৬তম জাতীয় সমাবেশ ২০১৬ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের পর দরবারে আনসার সদস্যরা নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন।

উৎস : কালেরকণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন