ট্রাম্পের বাগরাম বিমান ঘাঁটি দখলে নেওয়ার হুমকির মর্মার্থ কী?

fec-image

অতি সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আফগানিস্তানের সর্ব বৃহৎ বিমান ঘাঁটি বাগরাম পুনরায় মার্কিন নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন। কিন্তু ২০ সেপ্টেম্বর ট্রাম্প যখন ব্যক্তিগত সোস্যাল মিডিয়ায় কড়া ভাষায় লিখেন, ‘যদি আফগানিস্তান বাগরাম বিমান ঘাঁটি এটার নির্মাণকারী আমেরিকাকে ফেরত না দেয়, তাহলে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।’ তখন এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। কারণ, আমেরিকা আফগানিস্তানে ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে ২০ বছর পর যুদ্ধে বিতাড়িত তালেবানদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে আফগানিস্তান ত্যাগ করেছে অত্যন্ত লজ্জাজনকভাবে! উল্লেখ্য যে, বাগরাম বিমান ঘাঁটি পঞ্চাশের দশকে তত্কালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্মাণ করেছিলো। তাহলে কেন এখন ট্রাম্প এমন মন্তব্য করছেন? সেটা মোটামুটি যৌক্তিকভাবে পরিপূর্ণ অনুধাবন করতে হলে ২০ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে অদ্যাবধি ট্রাম্পের মন্তব্যসমূহ এবং কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত আলোচনা জরুরি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সিআইএ, ডিপার্টমেন্ট অফ স্টেট, ডিপার্টমেন্ট অফ ওয়ার (পেন্টাগন), এফবিআই, ইজরাইল/মোসাদ, ‘ফাইভ আইস’ জোটের সদস্য (যুক্তরাজ্য, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া), ন্যাটো জোটভুক্ত দেশসমূহ, নাসা, মার্কিন ইহুদি লবী, কায়েমি স্বার্থবাদী সমরাস্ত্র প্রস্ততকারী ও অসংখ্য বহুজাতিক মার্কিন কোম্পানিসহ বহুবিধ উত্স থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক আধিপত্য ধরে রাখার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট গোপনীয় তথ্য প্রাপ্ত হন। জীবিত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টগণ এবং সাবেক মন্ত্রী ও সাবেক গুরুত্বপূর্ণ পদবীর ব্যক্তিগণকেও প্রথা মোতাবেক অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা তথ্য অবহিত করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম ও ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অতি সাধারণ একজন ভূরাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেও প্রতীয়মান হয় যে, তিনি অত্যন্ত নিম্নমানের ব্যক্তিত্বের অধিকারী। প্রথম মেয়াদ ও বর্তমান মেয়াদে প্রায় বছর অতিক্রান্ত হলেও তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার আয়ত্ত করতে অক্ষম/অনিচ্ছুক। চরম আত্মপ্রচারে অভ্যস্ত ও মিথ্যা বাহবা পেতে ইচ্ছুক। মুসলিমবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী। আর্থিকভাবে অনৈতিক মনোভাবাপন্ন। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিথ্যা বলেন, বিজ্ঞান- অর্থনীতি-কূটনীতি-আন্তর্জাতিক আইনে সুপ্রতিষ্ঠিত অসংখ্য বৈশ্বিক বিষয়ে নিজস্ব ভ্রান্ত মতামতে বিশ্বাসী। ট্রাম্প হয়তো আমেরিকার ইতিহাসে একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি গালি হিসেবে ব্যবহৃত অশ্রাব্য শব্দ কথোপকথনে ক্যামেরার সামনে/জনসমক্ষে ব্যবহার করেছেন!

এছাড়াও ট্রাম্প নিজে যেটা সঠিক মনে করেন সেটার বৈধ এবং ন্যায্য বিরোধিতাও মারাত্মক অপছন্দ করেন। সে জন্য তাঁর প্রথম মেয়াদে অত্যন্ত পেশাদার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল (অব.) জিম ম্যাটিস পদত্যাগ করেছিলেন। তত্পরবর্তী প্রতিরক্ষামন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ডক্টর মার্ক টি এসপারের সাথেও চরম বিরোধ দেখা দিয়েছিলো। অপরদিকে প্রথম মেয়াদের প্রথম নিরাপত্তা উপদেষ্টা যুদ্ধবাজ জন বোল্টনকে ট্রাম্প বরখাস্ত করেছিলেন ইরানের সাথে যুদ্ধ জড়ানোর জন্য অতি বাড়াবাড়ি করার কারণে। এক্ষেত্রে অবশ্য ট্রাম্প সঠিক ছিলেন। অর্থাৎ অনেক অসংলগ্ন কথাবার্তা বললেও প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ছিলেন মারাত্মক যুদ্ধ বিরোধী এবং সিরিয়ায় একটি বিমান বন্দরে হামলা ব্যতিত তেমন কোনো সংঘর্ষে জড়াননি। ঐ হামলার পূর্বে এমনকি রাশিয়া এবং আসাদ প্রশাসনকে পূর্বেই অবহিত করা হয়েছিলো ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য। এছাড়াও প্রথম মেয়াদে তাঁর আরো উল্লেখযোগ্য সামরিক কর্মকাণ্ড হলো পালিত আইএস জঙ্গি প্রধান বাগদাদিকে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা। তালেবানদের সাথে আলোচনা করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার চূড়ান্ত করা এবং সিরিয়ায় মার্কিন সৈন্য কমিয়ে তুর্কী আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া।

মাঝখানে ৪ বছর বিরতির পর ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুকে প্রথম মেয়াদের সাথে তুলনা করলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। যখন তখন যে কোনো দেশ বা প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দিচ্ছেন, চরম জাতীয়তাবাদী স্লোগান ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ও ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন বা মাগা’ প্রচার করে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসলেও এগোচ্ছেন একেবারে নগ্ন ‘ইজরাইল ফার্স্ট’ নীতিতে! উল্লেখ্য যে গত মেয়াদেও ট্রাম্প ইজরাইলের জন্য জেরুজালেম এবং গোলান মালভূমির অবৈধ দখলদারিত্বের আইনগত স্বীকৃতিসহ বহু কিছু করেছেন। তবে কোনো যুদ্ধে জড়াননি। এবার গাজা গণহত্যায় ইজরাইলকে নিঃশর্ত সমর্থন দিচ্ছেন। নজিরবিহীনভাবে ঘোষিত আলোচনা চলা অবস্থায় সম্পূর্ণ বেঈমানী করে নেতানিয়াহুকে ইরানে হামলা চালাতে দিয়েছেন এবং নিজেও ইরানি অসামরিক পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছেন।

একই কায়দায় কাতারের মধ্যস্ততায় গাজার যুদ্ধ বিরতি আলোচনা চলাকালীন হামাস নেতৃত্বকে কাতারের আলোচনা স্থলে ইজরাইল হামলা করলেও পূর্বে বা পরে ট্রাম্প কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেননি। বিপরীতে ইজরাইল পরোক্ষভাবে নিশ্চিত করেছে, হামলার প্রায় এক ঘণ্টা পূর্বে ট্রাম্পকে বিস্তারিত জানানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ট্রাম্প ইজরাইল ব্যতিত বাকি মার্কিন মিত্র দেশসমূহের আস্থা ও বিশ্বাস ইতিহাসের সর্বনিম্নে এনে ঠেকিয়েছেন! ট্রাম্প জাতিসংঘ অধিবেশনে অসংখ্য অসংলগ্ন বক্তব্য প্রদানের পাশাপাশি লন্ডনের মুসলিম মেয়র সাদিক খানকে উদ্দেশ্য করে চরম মুসলিমবিদ্বেষী ও অভিবাসী বিরোধী মন্তব্য করতেও পিছপা হননি! মার্কিন শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়া এবং অবৈধ ক্রিপ্টো কারেন্সি ব্যবসার সাথে জড়িত থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করলে ট্রাম্প একজন অস্ট্রোলিয়ান সাংবাদিককে সে পুরো দেশের ক্ষতি করছে ও তার প্রধানমন্ত্রীর কাছে নালিশ করবেন বলে সরাসরি অন ক্যামেরায় হুমকি দেন! গত কয়েক মাসে কয়েকটি রাষ্ট্রের সামরিক সংঘর্ষ ও কৌশলগত বিরোধে অদৃশ্য মার্কিন মধ্যস্ততার সূত্র ধরে ট্রাম্প নজিরবিহীনভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার জন্য নিজস্ব প্রচারণা চালাচ্ছেন। নরওয়ের একটি পত্রিকা দাবি করেছে, ট্রাম্প নিজে পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে সরাসরি দেশটির অর্থমন্ত্রীকে কল করেছেন! এসব কিছু ছাড়াও এই মেয়াদে ট্রাম্পের কথিত আমদানি শুল্ক যুদ্ধ, অভিবাসীদের অফিশিয়ালি এলিয়েন বলে সম্বোধন, জেফ্রি এপিস্টেইন ফাইল কেলেঙ্কারি, ইজরাইলের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্যের বিপরীতে অকল্পনীয় মার্কিন রাষ্ট্রীয় ঋণ তথা বাজেট ঘাটতির মতো বিষয়গুলো নিয়ে মারজরি টেইলর গ্রিনি ও সাবেক ফক্স নিউজ সাংবাদিক কার্লসনের মতো বহু প্রভাবশালী চরম জাতীয়তাবাদী ট্রাম্প সমর্থকও এখন মূলত তাঁর নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছেন।

এতো ব্যাপক বৈশ্বিক গোপনীয় তথ্য প্রাপ্তি বৃত্তের সর্বোচ্চ অবস্থানে থেকেও ট্রাম্প মন্তব্য করেছেন, আমি আর্মেনিয়া ও কম্বোডিয়ার মধ্যে যুদ্ধ থামিয়েছি, যেখানে মূলত প্রথম পক্ষ হলো থাইল্যান্ড। তুর্কী প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সফরকালে হোয়াইট হাউসে আজারবাইজান-আর্মেনিয়া বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আজারবাইজানী প্রেসিডেন্ট আলিয়েভর নাম শুনে জিজ্ঞেস করেন, ‘সে কে?’ সার্বিকভাবে এটা প্রতীয়মান হয় যে, এরকম নিম্নমানের ব্যক্তিত্বের অরাজনৈতিক একজন ৭৯ বছর বয়স্ক ব্যক্তির চাঞ্চল্যকর ভূরাজনৈতিক মন্তব্য মোটেই তাঁর নিজস্ব কোনো উদ্ভাবনী চিন্তা কিংবা নেতৃত্বের গুণাবলী হতে নিঃসৃত নয়! ট্রাম্পের প্রতিটি মন্তব্য মূলত গোপনীয় গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও বৈশ্বিক আধিপত্য ধরে রাখার জন্য কৌশলগত গোপন মার্কিন পরিকল্পনার মূলভাব। উদাহরণ স্বরূপ প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের দুটি আকস্মিক বক্তব্যের প্রসঙ্গে বলা যায়, প্রথমত ‘টিকটক আমেরিকা ক্রয় করবে আমেরিকান কোনো কোম্পানি অথবা চীন বিক্রি না করলে নিষিদ্ধ করার হুমকি হবে, দ্বিতীয়ত সিরিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে ইহুদি লবীর তীব্র সমালোচনার মুখে মিডিয়ায় সরাসরি বলা, আমি তেল দখলে রেখেছি, তেল দখলে রাখার প্রয়োজনীয় সৈন্য থাকবে। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘ প্রায় ৫ বছর পর গত কয়েকদিন আগে টিকটিকের আমেরিকান সার্ভারের মালিকানা বিক্রিতে সম্মত হয়েছে চীন এবং সিরিয়ায় আসাদের পতন হলেও অদ্যাবধি সবচেয়ে বড় বড় তেল কূপগুলো আমেরিকার দখলে আছে।

বর্তমান মেয়াদে ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব থেকে পানামা খাল নিয়ে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। গাজা ও ইরান ইস্যুতে হুবহু নেতানিয়াহুর ভাষায় কথায় বলতে থাকেন। ফলাফল পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে, গাজা গণহত্যায় প্রত্যক্ষ আমেরিকান সমর্থন এবং নেতানিয়াহুর ইরান হামলায় সরাসরি আমেরিকান অংশগ্রহণ। এখন ট্রাম্প মাদক ব্যবসায়ী নির্মূলের নামে ভেনেজুয়েলা সরাসরি সামরিক অভিযান শুরুর দ্বারপ্রান্তে অবস্থান করছেন, নজিরবিহীনভাবে বৈঠকের জন্য দুনিয়ার সকল প্রান্ত থেকে জেনারেলগণকে যুদ্ধ মন্ত্রণালয়ে মিটিংয়ে ডেকেছেন যুদ্ধমন্ত্রী পেট হেগসেথ, ন্যাটো আকাশ সীমা লংঘনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও নাকচ করে দেওয়া যাচ্ছে না। যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়ে এরকম অবস্থান পরিবর্তনের আবহে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি নিয়ে ট্রাম্পের চাঞ্চল্যকর মন্তব্য মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আমেরিকার দীর্ঘস্থায়ী নতুন ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনারই ইঙ্গিত মাত্র।

নিজে সৈন্য প্রত্যাহার চূড়ান্ত করার প্রায় ৫ বছর পরে ট্রাম্পের আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি দখলে নিতে চাওয়া মোটেই কোনো একক কারণনির্ভর নয়। দৃশ্যতঃ এই তাড়াহুড়ো এবং অসংলগ্ন বক্তব্যের মূলে হলো সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি। পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র পাকিস্তান যে কোনোমূল্যে সৌদি আরবকে রক্ষায় চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং এই চুক্তিতে আরো বেশ কয়েকটি ধনী আরব রাষ্ট্র যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যতের যে কোনো যুদ্ধে মূল পাক ভূখন্ড থেকে ইজরাইলগামী ক্ষেপণাস্ত্র রুখতে এবং ইরানের উপর সহজে হামলা করতে আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি এখন আমেরিকার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। আমেরিকা বিদায় নেওয়ার পর আফগানিস্তানের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই চীনা আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আফগানিস্তানের বিশাল খনিজ ভান্ডারের দুর্লভ খনিজ এখন চীনের নিয়ন্ত্রণে এবং চীনের সাথে সম্পাদিত হয়েছে তেল উত্তোলন ও খনিজ অনুসন্ধান চুক্তি, লোহা ও কপার উত্তোলনে ভারতও মোটামুটি সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। বিশেষজ্ঞগণের ধারণা, আফগানিস্তানে মজুদ খনিজ সম্পদের আনুমানিক মূল্য ১ হতে ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের মধ্যে। আবার অনেক বিশেষজ্ঞ মত প্রকাশ করেন, আফগানিস্তান বিশ্বের সর্ব বৃহৎ লিথিয়াম মজুদের অধিকারী। লোহার আনুমানিক মজুদ ২ বিলিয়ন টনের উপরে। এছাড়া উল্লেখযোগ্য স্বর্ণ মজুদ ছাড়াও মূল্যবান বহুবিধ রত্ন-পাথরের মজুদের জন্য আফগানিস্তান বহু আগে থেকেই বিখ্যাত। যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে আফগানিস্তানের খনিজ মজুদ পুরোপুরি নির্ভুলভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি, অধিকন্তু ভৌগোলিক অবস্থান বিচারে বরং আরো বহু বেশি খনিজ/খনি আবিষ্কৃত হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। গত জুলাই মাসে স্যাটেলাইট ইমেজ ও গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে কিছু কিছু আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাগরাম বিমান ঘাঁটি এখন চীনের অসামরিক নিয়ন্ত্রণে আছে, চীনারা উন্নত রাডার স্থাপনসহ সেখানে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে।

৮ জুলাই নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ন্যাটো কর্মকর্তা রয়টার্সকে বলেন, ‘বাগরাম একটি কৌশলগত সম্পদ। বিদেশি শক্তি কর্তৃক এটার ব্যবহারে আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।’ ল্যান্ডলক আফগানিস্তানকে পাকিস্তান হয়ে চীনের সাথে সংযুক্ত করা ও বন্দর সুবিধা প্রদানের কার্যক্রমও এগিয়ে যাওয়ার পথে, দীর্ঘদিন মার্কিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলে আফগানিস্তানের চরমভাবে ইরানি চাবাহার বন্দর নির্ভরতাও তৈরি হতে পারে। তালেবানের পুরনো শত্রু রাশিয়া অফিশিয়ালি তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্বিপাক্ষিক কার্যক্রম শুরু করেছে এবং রাশিয়া আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে ইরানের সাথে সরাসরি রেলযোগে ও পাইপলাইন স্থাপনে আগ্রহী।

আরব শেখ এবং আমিরগণ কাতারে ইজরাইলি হামলায় তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারায় এটা আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, শত শত বিলিয়ন ডলারের পশ্চিমা অস্ত্র মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় হুমকি ও হিংস্র হায়েনা রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে আসলে কখনোই তাদের সুরক্ষা দেবে না। বিপরীতে আমেরিকা পরিষ্কার উপলব্ধি করছে, চীনা সমরাস্ত্রের অন্যতম ব্যবহারকারী পাকিস্তানের সাথে ধনী আরব দেশগুলোর প্রত্যক্ষ প্রতিরক্ষা চুক্তি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের চীনা অস্ত্রের আগমন ঘটাবে মধ্যপ্রাচ্যে এবং অচিরেই পাক সশস্ত্রবাহিনী ও আরব দেশগুলোর মধ্যে একটি আন্তঃকর্মক্ষমতা তৈরি হবে। যেখানে ধীরে ধীরে চীনা সমরাস্ত্র, পাকিস্তানি ক্ষেপণাস্ত্র তথা পারমাণবিক বোমা সামনের সারিতে চলে আসবে, এখন পাকিস্তানের আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিশ্চিত আরো বেশি গতি পাবে এবং যুদ্ধ বিমান তৈরি প্রজেক্টে এখন হয়তো আরো বেশি বহুজাতিক হয়ে যাবে। বিপদে মুসলিম উম্মাহর জন্য বুকে গুলি নেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীরও আধুনিকায়নে ব্যাপক আরব বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব এবং এক্ষেত্রেও আন্তঃকর্মক্ষমতা তৈরি হবে মূলত চীনা সমরাস্ত্রের মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকানো এবং রাশিয়ান অর্থনীতির গলা চেপে ধরার জন্য ভারতকে ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে, ভারত উল্টো আজ্ঞাবহ রাস্ট্র হওয়ার পরিবর্তে কৌশলগত স্বাধীনতা তথা সমকক্ষতা চেয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের অযৌক্তিক আমদানি শুল্ক যুদ্ধ ভারতকে অপ্রত্যাশিতভাবে চীনের আরো কাছে ঠেলে দিয়েছে।

হালে মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্প প্রয়োজনীয় দূর্লভ খনিজের প্রায় শতকরা ৮০ শতাংশের জন্য চীনের উপর নির্ভরশীল, আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উত্স মিলিয়ে পুরো বৈশ্বিক দুর্লভ খনিজ সরবরাহ চক্রে চীনের একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চীনের উপর এই নির্ভরতা কমাতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের করা বার্মা এ্যাক্টের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে জান্তা সরকার অথবা বিদ্রোহীদের মাধ্যমে হলেও মায়ানমার থেকে দুর্লভ খনিজ বের করতেও গোপন তত্পরতা অব্যাহত রেখেছে। বাস্তবতা হলো ভারতের সাথে সম্পর্ক এবং মায়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে সে পরিকল্পনা অসংখ্য যদি, কিন্তু এবং বন্ধনী নির্ভর হয়ে যাচ্ছে শুরুতেই। সৌদি পদক্ষেপে হঠাৎ কূটনৈতিক শক পাওয়া যুক্তরাষ্ট্র জন্য মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় এরকম পরিস্থিতিতে চীনা স্বার্থে আঘাতের জন্য ছায়া যুদ্ধ শুরু করা, বশে আনার জন্য ভারতের দূর্বল পয়েন্ট গুলোতে আঘাত করা, ইজরাইল এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রাশিয়া ও ইরানের আরো একটি সীমান্ত এলাকায় সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য আফগানিস্তানের বাগরাম বিমান ঘাঁটি ও বঙ্গোপসাগর হয়ে গেছে এখন অপরিহার্য লক্ষ্যবস্তু গুলোর মধ্যে অন্যতম।

ট্রাম্পের বাগরাম বিমান ঘাঁটি দখলে নেওয়ার ইচ্ছে একেবারে সম্ভাবনা বিহীন বলাটা হবে বোকামি। যুক্তরাজ্য সফরকালে ট্রাম্প মিডিয়াকে বলেছেন, “এটা আমরা ফেরত নিতে চাচ্ছি কোনভাবেই সেটা বড় সংবাদ হওয়ার কথা নয়, আমরা এটা ফেরত নেওয়ার চেষ্টা করছি কারণ আমাদের কাছ থেকে তাদের (তালেবান সরকারের) কিছু প্রয়োজন।” ট্রাম্প পরিস্কারভাবে আফগানিস্তানের আটককৃত রিজার্ভ ৯ বিলিয়ন ডলার এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মুক্তির জন্য তালেবান সরকারের ব্যাক চ্যানেল তদবিরের বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। এবিষয়ে আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা জাকির জালাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করেন, ‘আফগান ভূখন্ডে কোন প্রকার সামরিক উপস্থিতি ব্যতিত আফগানিস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের একে অপরের সাথে কাজ করা উচিত। পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে কাবুল ওয়াশিংটনের সাথে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রস্তুত আছে।’ ট্রাম্পের বাগরাম বিমান ঘাঁটি দখলে নেওয়ার হুমকির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লি জিয়ান বলেন, ‘চীন আফগানিস্তানের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং ভৌগোলিক অখন্ডতাকে সম্মান করে। আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আফগান জনগণের হাতে থাকা উচিত।’ চীনা মুখপাত্রের বক্তব্য থেকে নিশ্চিত আভাস পাওয়া যায় তালেবান সরকারের সাথে সম্পর্ক এবং আফগানিস্তানে চীনা কর্মকাণ্ডের গভীরতা কতটুকু! ডলার নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবকিছুর পরও মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মুক্তি এবং জব্দকৃত ৯ বিলিয়ন ডলারের অধিক অবমুক্ত করা অবশ্যই বর্তমান আফগান সরকারের অগ্রাধিকারে থাকবে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বৃহৎ আমদানিকারক রাস্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাত, যেহেতু আমেরিকা- ইজরাইল এর স্বার্থে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সম্পদশালী এই দেশটির অবদান ও আনুগত্য বাক্যে লিখে বুঝানো দুষ্কর।

সর্বোপরি ট্রাম্পের বাগরাম বিমান ঘাঁটি দখলে নেওয়ার হুমকি অনেকটা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে কয়েক মাস আগে কিংবা পরে, দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকা-চীন-ভারত ত্রিমুখী ছায়াযুদ্ধ আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্বে বিবেচনায় রাখতে হবে আমেরিকা বৈশ্বিক ক্রিপ্টো কারেন্সি বাজারসহ মিলিয়ে প্রকৃতপক্ষে ৪০ থেকে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার রাস্ট্রীয় ঋণে ডুবে থাকা প্রায় পুরোপুরি ঘাটতি বাজেটের একটি দেশ, ইউক্রেন যুদ্ধ আমেরিকার জন্য অনেক বড় সমস্যা এবং ইজরাইল এর সকল যুদ্ধ ব্যয় মূলত আমেরিকা কে বহন করতে হয়। এখনো পর্যন্ত গুলি না ছুড়ে যুদ্ধ জয় নীতিতে থাকা চীন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের শিল্প ও বাণিজ্যের মূল ভিত্তি এবং ভারত ব্যতিত প্রতিটি দেশে আমেরিকার তুলনায় মারাত্মক বেশি জনপ্রিয়, চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এবং ডলারের বিকল্প ব্রিকস কারেন্সি উদ্যোগ সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশ বাড়ছে, বর্তমানে কৌশলগত কারণে আপাততঃ চীন ও ভারত অদৃশ্যভাবে একই সরল রেখায় অবস্থান করছে, যা মায়ানমার ও আফগানিস্তানে আধিপত্য আরো সুসংহতকরণে চীনকে যথেষ্ট সুবিধা দিবে, ইজরাইল ফ্যাক্টরের কারণে চীন যদি ইচ্ছে করে সিআইএ প্লে বুক অনুসরণ করে যে কোনো মুসলিম প্রধান উন্নয়নশীল দেশে মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই লক্ষ লক্ষ জনতাকে রাস্তায় নামিয়ে আমেরিকা বিরোধী বিক্ষোভ আয়োজন করে ফেলতে পারবে। এছাড়াও সামরিক হুমকি এবং সরাসরি দখলদারিত্বের পরিবর্তে চীনের বড় বড় দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ নীতির কারণে বারংবার কথিত চীনপন্থী সরকার পতন ঘটিয়েও আমেরিকা কখনো দক্ষিণ এশিয়ায় সুবিধা করতে পারবে না, শুধুই ঐ দেশগুলো অবকাঠামোগতভাবে ও অর্থনৈতিকভাবে বারংবার পিছিয়ে যাবে। দেখা যাবে সেই কথিত গণতন্ত্রপন্থী/দুর্নীতি বিরোধী সরকার এসেও কখনো চীনা ঋণ পরিশোধে অস্বীকার করতে পারবে না, যেটা করার ক্ষমতা খোদ আমেরিকারও নেই। আবার দেশ চালাতে হলে বড় বড় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ ও উন্নয়ন এবং ঋণের জন্য সেই চীনের কাছেই যেতে হবে, গ্লোবাল সাপ্লাই চেইনে চীনা আধিপত্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মতো ব্যবহার শুরু হলে কী কী ঘটতে পারে সেটার বিস্তারিত আলোচনা না হয় বাদ-ই দিলাম। পাকিস্তান ব্যতিত দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলো এখন চরম উভয় সংকট পরিস্থিতির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে, মজবুত ও নির্ভরযোগ্য সামরিক শক্তি এখন পাকিস্তানের সকল সমস্যা সমাধানে আলো দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য চীন ও আমেরিকা উভয় পক্ষের মিত্র আরব দেশসমূহ, তুরস্ক এবং পাকিস্তান সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে, সেজন্য অবশ্যই সমন্বিত সামরিক ও অসামরিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা একান্ত আবশ্যক।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন