‘নিজেই হুজুর ডেকে সুফিয়াকে বিয়ে করেন বদি’

fec-image

আমি এমপি (আবদুর রহমান বদি) সাহেবের প্রথম স্ত্রী। তিনি নিজে হুজুর ডেকে এনে আমাকে বিয়ে করেন। দুই মাস পর আমার গর্ভে সন্তান (মো. ইসহাক) আসে। তখন বদি ভালো ছিলেন। নামাজ কালাম পড়তেন। তাকে ভালো দেখে একমত হই। বাচ্চা নিই। কিন্তু বিয়ের কথা কাউকে প্রকাশ করতে দেন নি। ঘটনাটি আমার মাকে জানালে অসন্তুষ্ট হন। ৫ মাস হয়ে গেলেও বিয়ের কথা প্রকাশ করতে না দেওয়ায় বদির পিতা (এজাহার মিয়া)কে ঘটনা বর্ণনা দিই। এরপর বিচার করেন। বকুনি দেন। আমাকে মেনে নেন নি। গর্ভের বাচ্চা নষ্ট করতে চাপ প্রয়োগ করেন আবদুর রহমান বদি। তার সঙ্গে ডাক্তারের নিকট যেতে বলেন। বাচ্চা নষ্ট না করলে আমাকে, আমার ভাই-বোনকে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এরপর এ ঘটনা কাউকে প্রকাশ না করার অঙ্গীকার নিয়ে পিতা-পুত্র মিলে বাড়ির কর্মচারি নুরুল ইসলামকে (রাজমেস্ত্রি) ডেকে আমার সঙ্গে বিয়ে পড়িয়ে দেন। -কথাগুলো উখিয়া-টেকনাফের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির প্রথম স্ত্রী দাবিদার সুফিয়া খাতুনের।

তিনি বলেন, নুরুল ইসলামের ঘরেই ভূমিষ্ট হয় মো. ইসহাক। অল্প সময়ে সন্তান কিভাবে জন্ম নিল? এমন প্রশ্নের জবাবে পুরনো কাহিনী প্রকাশ করি। সদ্যভূমিষ্ট সন্তানটি বাঁচাতে তার হাতেপায়ে ধরে রাজি করি। যেভাবে হোক, তিনি রাজি হন।

আবদুর রহমান বদির হুমকি ধমকি ও হত্যার ভয়ে নিজের গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তান মো. ইসহাককে বাঁচাতে পালিয়ে বেড়ান বদির প্রথম স্ত্রী দাবিদার সুফিয়া খাতুন। আশ্রয় নেন চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায়। খেয়ে না খেয়ে বড় করেন সন্তানকে।

মো. ইসহাক (২৬) আবদুর রহমান বদিকে জন্মদাতা পিতা দাবি করে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। আবেদন জানিয়েছেন ডিএনএ টেস্টের।

গত ১৩ ডিসেম্বর টেকনাফ সহকারী জজ আদালতে ইসহাকের আবেদনের প্রেক্ষিতে আগামী ১৪ জানুয়ারি আদালতে হাজির হওয়ার জন্য আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে সমন জারি করেন বিচারক।
ইসহাক কক্সবাজার সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির পরীক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পরীক্ষা আটকে আছে। বর্তমানে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের বিসিক শিল্প এলাকার দক্ষিণ মুহুরীপাড়ায় মায়ের সঙ্গে তিনি থাকেন।

মো. ইসহাকের পালক পিতা নুরুল ইসলাম বলেন, আমি জানতাম সুফিয়া ভাগ্নি, অবিবাহিত। তাই বিয়ে করি। আগে কি হয়েছে না হয়েছে জানতাম না।

তিনি বলেন, সুফিয়ার গর্ভে সন্তান থাকার কথা জেনেও আমার সাথে বিয়ে দেন বদি। তবু আমি মুখ খুলে কাউকে বলিনি। দুঃখ বুঝতে দিইনি। ইসহাক জন্ম নেয়ার পর তাকে কষ্ট করে লালন পালন করি। পড়ালেখা করাই। কষ্টের শেষ নাই। তারপরও তাকে (আবদুর রহমান বদিকে) ছোট করতে চাইনি। পিতৃপরিচয় চেয়ে বদির বিরুদ্ধে মামলা করেছে তাও জানি না।- বললেন ইসহাকের পালক পিতা।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন টেকনাফ ইউনিয়নের অলিয়াবাদে বসবাসরত সুফিয়াদের বাড়িতে বেশ কয়েকবার ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওইসময় সুফিয়ার পিতা ছিলেন সৌদি আরবে। পুরুষশূন্য বাড়িতে মায়ের সাথে থাকতেন যুবতী সুফিয়া খাতুন। বেপরোয়া ডাকাতির কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন তারা।

বিষয়টি ওই সময় তাৎকালীন টেকনাফ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাবেক সাংসদ বদির বাবা এজাহার মিয়াকে জানালে তিনি তার বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সুফিয়াদের ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিতে নির্দেশ দেন। তারাও চেয়ারম্যানের কথামতো বাড়িঘর বিক্রি করে দেন। পরে বদিদের বাড়িতে বিচারকার্যক্রম চলতো এমন একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে তাদের আশ্রয় দেন বদির পিতা এজহার মিয়া।

সুফিয়া খাতুন জানান, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির কাছে আশ্রয়ে থাকার সুবাদে বদির সাথে তার প্রতিদিন দেখা হতো, কথা হতো। একপর্যায়ে বদি একদিন তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। তিনি রাজি হয়ে যান।

পরে ১৯৯২ সালে ৫ এপ্রিল ইসলামিক রীতিনীতি অনুসারে বদির সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ে পড়ান আবদুর রহমান বদিদের পারিবারিক আবাসিক হোটেল নিরিবিলিতে তৎসময়ে কর্মরত মৌলভী আবদুস সালাম। বিয়ের সাক্ষী ছিলেন হোটেলের দারোয়ান এখলাছ। কিন্তুু বিয়ের কয়েক মাস পর বিয়ের বিষয়টি জেনে যান বদির পিতা এজহার মিয়া। তখন তার গর্ভের সন্তান ইসহাকের বয়স প্রায় ৬ মাস।

সুফিয়া এখন তার ছেলে ইসহাকের পিতৃপরিচয় চান। তার কোনও দাবি-দাওয়া নেই জানিয়ে ইসহাককে ছেলে হিসাবে মেনে নেওয়ার জন্য সাবেক স্বামী বদির প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

সুফিয়ার বর্তমান স্বামী নুরুল ইসলামের দাবি, সাবেক এমপি বদি তার সাথে প্রতারণা করেছেন। তিনি বলেন, বদির পিতা এজাহার মিয়া একদিন তাকে ডেকে বললেন, তোর জন্য একটা মেয়ে ঠিক করেছি। তখন অভিভাবক হিসেবে আমিও আর না করিনি। এসময় বদিও উপস্থিত ছিলেন। তিনিও সুফিয়াকে বিয়ে করতে তাকে অনুরোধ করেন এবং সবসময় পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেন।

তবে বিয়ের দুইমাস পর জানতে পারি স্ত্রী সুফিয়া গর্ভবতী। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুফিয়া আমাকে সব খুলে বলেন। পরে বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সুফিয়া।

এ বিষয়ে জানতে আবদুর রহমান বদির ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও মুঠোফোন রিসিভ করেন নি।

ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক এমপি বদিকে পিতা দাবীদার মো. ইসহাক বলেন, পিতা আবদুর রহমান বদি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোয়া করেন। লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু পিতা আবদুর রহমান বদি তার রাজনৈতিক শত্রু ও সামাজিক অবস্থানসহ নানা সমীকরণ দেখিয়ে মায়ের কাছে সময় নেন। মাও স্বামীর (আবদুর রহমান বদি) কথার অবাধ্য হননি। তাই তার মা সুফিয়া খাতুন এতোদিন চুপ ছিলেন।

ইসহাক আরও জানান, তার বয়স বাড়ার কারণে পিতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। বিষয়টি নিয়ে মা-ছেলে আবদুর রহমান বদির ছোটবোন শামসুন নাহারের সাথে যোগাযোগ করেন। তারা ঘরোয়াভাবে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করেন। আবদুর রহমান বদি কৌশলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন। এখন আমাদের সাথে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই অনন্যোপায় হয়ে পিতৃত্বের দাবিতে আদালতের দ্বারস্ত হয়েছেন।

সম্প্রতি দুদকের মামলায় হাজিরা দিয়ে টেকনাফে সংবর্ধনা গ্রহণকালে তার পিতা বদি ছেলে শাওন আর মেয়ে ছাড়া আর কোনো ছেলে মেয়ে নাই দাবি করে বক্তব্য রাখেন। এর পরে সিদ্ধান্ত নেন তিনি আর চুপ থাকবেন না। তাই তিনি আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন। এছাড়া এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরেও অভিযোগ করেছেন।

এদিকে, উখিয়া-টেকনাফের যে কোনো ছেলে-মেয়ে আদালতে গিয়ে বাবা দাবি করলে তাদেরকে ছেলে-মেয়ে হিসেবে মেনে নেবেন বলে জানিয়েছেন সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি। বদিকে বাবা দাবি করে সন্তানের স্বীকৃতি চেয়ে ইসহাক নামের এক যুবকের আদালতে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘোষণা দেন তিনি।

পিতা দাবি করার বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাবেক এমপি বদির সাথে আদালতে যাওয়া ছেলে দাবিদার যুবক ইসহাকের চেহারার সাথে মিল আছে দাবি করে তাকে স্বীকৃতি দিতে বদির প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন