সমকালীন প্রসঙ্গ

পর্যটন খাতে প্রণোদনা সহজ হোক

fec-image

মানুষের নিত্যনতুন এবং অজানা স্থানকে জানার এবং আবিস্কার করার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা থেকে পর্যটন শিল্পের বিকাশ। মানুষ এখন অভিজাত, চাকচিক্যময় এবং জনাকীর্ণ শহুরে এলাকা থেকে দূরে গিয়ে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে একান্তে অবগাহন করতে চায়। সমসাময়িক সময়ে পর্যটন শুধু নিছক বিনোদন বা ভ্রমণ আনন্দের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চাবিকাঠি হিসেবেও পরিগণিত। পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল, অতি বৈচিত্র্যময় এবং শ্রমঘন একটি শিল্প যা দেশের বিভিন্ন সেক্টরে হাজারো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।

ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পর্যটন শিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন। কারণ টেকসই উন্নয়নের ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে তিনটি সরাসরি পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, করোনা মহামারি সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের ভ্রমণ ও পর্যটন খাত কভিড-১৯ মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত একটি শিল্প। সাম্প্রতিক ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ২৬,৪৯০ কোটি টাকা পর্যটন খাত ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।

গত ২৯ জানুয়ারি গণমাধ্যমে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শর্ত পেরিয়ে কেউ পায়নি পর্যটনে প্রণোদনা। অথচ আমরা জানি, করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটন খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হচ্ছে, নানা শর্তের জটিলতায় কোনো উদ্যোক্তাই পাননি এ প্রণোদনার ঋণ। ট্যুরিজম বোর্ডের সিইও বলেছেন, ব্যাংকিং বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েও এ ব্যাপারে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।

সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশ, পর্যটন কেন্দ্রগুলো চালু হওয়ার পর বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই অর্থের অভাবে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে পারছেন না। আবার অনেকেই গুটিয়ে ফেলেছেন ব্যবসাও। এখন আবার করোনার ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণে পর্যটনকেন্দ্রগুলো হয়ে পড়ছে পর্যটকশূন্য। এই অবস্থায় পর্যটন খাতের সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব বহুমুখী হতে বাধ্য। এই খাতে প্রণোদনা প্রাপ্তির পথ মসৃণ না করলে পর্যটন শিল্পের ক্ষতির চিত্র আরও স্ম্ফীত হবে, যা কাম্য হতে পারে না।

ডব্লিউটিসির তথ্যানুসারে, ২০২১ সালের অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিবেদনে অনুমান করা হয়েছে, দেশের ভ্রমণ ও পর্যটন খাত ২০২০ সালে ৫৩,৯৬০ কোটি টাকার মোট দেশজ উৎপাদন সঞ্চয় করেছে, যা ২০১৯ সালে ছিল ৮০,৪৫০ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এই খাতের অবদান ৩২.৯ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। এ ছাড়া সংকটের মধ্যে গত বছর দেশের পর্যটন খাতের সঙ্গে জড়িত চার লাখের বেশি লোক চাকরি হারিয়েছে।

১৯৯১ সালে বাংলাদেশের পর্যটন নীতিমালার আলোকে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এই খাতের সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল হলেও নানা সমস্যার কারণে বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রত্যাশিত ও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সাধিত হয়নি। উপরন্তু সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস পর্যটন শিল্পকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে বিধায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট স্টেকহোল্ডাররা। তবে জাতিসংঘের বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, বৈশ্বিক পর্যটন পুনরায় চালুকরণের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি এবং ধীরে ধীরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করেছে দেশগুলো।

জাতিসংঘ বিশ্ব পর্যটন সংস্থা ২০২১ সালে বিশ্ব পর্যটন দিবসটির প্রতিপাদ্য ঠিক করেছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে পর্যটন’। এর মাধ্যমে কভিড-১৯-এ আর্থিক ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি সমাজে সকল প্রকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্য অবসান, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অসমতা দূরীকরণে পর্যটনের সক্ষমতাকে জানান দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার মতে, করোনা মহামারির কারণে উন্নত বা উন্নয়নশীল সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমাজের অসহায় ও খেটে খাওয়া মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে, করোনা-পরবর্তী সময়ে পর্যটন শিল্প সামাজিক-অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে সাহায্য করবে। পর্যটনের মাধ্যমেই উন্নত, অনুন্নত, ধনী, গরিব সবাইকে সব সুবিধা ন্যায্য এবং ব্যাপকভাবে প্রদান করে দারিদ্র্য ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। আর এই ন্যায্যতা এবং সুবিধার সমবণ্টন, এক কথায়, সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতাই অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির মূল কথা।

বাংলাদেশ সরকার কভিড-১৯ মহামারির কারণে পর্যটন শিল্পের যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন উপখাতের ব্যবসায় জড়িত পর্যটন অংশীজনের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী দেড় হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের এসএমই ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রেস্টুরেন্টের ভ্যাট কমানো হয়েছে। এ ছাড়া পর্যটন শিল্পের ক্ষতি চিহ্নিতকরণ ও সমাধানের উপায় নির্ধারণের জন্য ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন, করোনাকালীন পর্যটন শিল্প পুনরায় চালুকরণের জন্য অনুসরণীয় নির্দেশিকা প্রস্তুত ও বিতরণ, অনুসরণীয় নির্দেশিকার ওপর পর্যটন শিল্পের অংশীজনের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে, ট্যুরিজম রিকভারি প্ল্যান প্রস্তুতকরণ, পর্যটন শিল্পে ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তাদের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষিত প্রণোদনা প্রদানের জন্য সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়-দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয়, পর্যটন শিল্পের বিভিন্ন অংশীজনের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান, জেলা ও উপজেলায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ, অন-অ্যারাইভাল ভিসার আওতা বৃদ্ধির জন্য সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়কে চিঠি প্রদান ইত্যাদি কার্যক্রমও গ্রহণ করা হয়েছে।

পর্যটকদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁ মালিকদের পর্যটক নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব জনবল থাকতে হবে। খাবারের গুণগত মান বজায় রাখতে হবে। সেই খাবারের মান ও দামের মধ্যে সামঞ্জস্যতা থাকতে হবে। গবেষণাধর্মী কার্যক্রম বৃদ্ধির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে উপযোগী তথ্যের উদ্ঘাটন ও সংরক্ষণপূর্বক তা নিঃসন্দেহে জনকল্যাণে সমৃদ্ধি আনয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। অপার সম্ভাবনাময় ও প্রাকৃতিকভাবে সৌন্দর্যমণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও মহান স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছরেও আমরা পুরোপুরি সক্ষম হইনি পর্যটন খাতকে ঢেলে সাজাতে। তবে সাম্প্রতিককালে সরকারসহ বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান পর্যটনকে অর্থনৈতিক একটি কার্যকরী খাত হিসেবে রূপান্তরে সচেষ্ট হয়েছে। তাই পর্যটন শিল্পের বিকাশে গবেষণাধর্মী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যটনের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থাসহ বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। দেশের উন্নয়ন যাত্রায় পর্যটন শিল্পের সংযোজন শুধু আর্থিক সফলতাই বয়ে আনবে না, সেই সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ে এর সুফল ছড়িয়ে দেবে স্থানীয়দের অংশগ্রহণের মাধ্যমে।

লেখক: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া: সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: সমকাল

Print Friendly, PDF & Email
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন