অধিকারের নামে পাহাড়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে ইউপিডিএফ


প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির জন্য খ্যাত পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাঁদাবাজি, জাতিগত সমস্যা ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে যেখানে চরম সঙ্কট সৃষ্টি করে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। তাদের সশস্ত্র গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড পার্বত্য অঞ্চলের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের বেপরোয়া কার্যকলাপ শুধু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উপরই নয় বরং সমগ্র দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।
সশস্ত্র এই সন্ত্রাসী বাহিনীর তাণ্ডবে ২০০৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩৩২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। নিহত হয়েছেন ১২৪ জন। ইউপিডিএফের হামলায় আহত হয়েছেন ৪২ জন। বেশির ভাগের সাথে ইউপিডিএফের মূল দল জড়িত।
পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে ১৯৯৮ সালে ২৬ ডিসেম্বর ইউপিডিএফ গঠিত হয়। গড়ে ওঠার পর থেকেই এই গোষ্ঠী পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। তারা নিজেদের ‘পার্বত্য জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের’ সংগঠন হিসেবে দাবি করলেও কার্যত তাদের কর্মকাণ্ড স্থানীয় জনগণের জন্য ভয়াবহ আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে। চুক্তির পর শান্তি প্রতিষ্ঠার যে প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল, ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুম, অস্ত্রবাজি ও সহিংসতায় তা বারবার ব্যাহত হয়েছে। দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে পার্বত্য অঞ্চলে আবারো তারা মেতে উঠেছে সন্ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টিতে।
সম্প্রতিক সময়ে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মোবাইল টাওয়ার কোম্পানির কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ চাঁদা দাবি করে ইউপিডিএফ। দাবি পূরণ না হওয়ায় তারা টাওয়ার ধ্বংস, নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেয়া এবং অফিস ভাঙচুর করে। একইসাথে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী একাধিকবার বিপুল অস্ত্র চালান আটক করেছে, যা ইউপিডিএফের আন্তর্জাতিক অস্ত্র চোরাচালান নেটওয়ার্কে জড়িত থাকার প্রমাণ করে। এ ছাড়া সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে তাদের ছয়টি ক্যাম্প রয়েছে, যা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে সংগঠনটি সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে যোগসাজশ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।
২০২৫ সালের ২৩ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি ও গুইমারা এলাকায় ইউপিডিএফ এবং অঙ্গসংগঠনগুলো বিক্ষোভ, হরতাল, রাস্তা অবরোধ, হামলা এবং অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করে। ওই ঘটনায় ১১ জন সেনা আহত হয়। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃঢ় সংযম ও মানবিকতার সাথে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করে।
জানা যায়, ২০০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির গিলাছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে টহল পরিচালনার সময় ইউপিডিফের সশস্ত্র সদস্যরা টহল দলের ওপর অতর্কিত গুলিবর্ষণ করলে ক্যাপ্টেন মো: নূরুল আজম গাজী গুরুতর আহত হন। পরে তাকে চট্টগ্রাম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চালক মামুন হত্যাকে কেন্দ্র করে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মূল এবং অঙ্গসংগঠনগুলো দীঘিনালা ও রাঙ্গামাটিতে সাম্প্রদায়িক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। ওই ঘটনায় ১১ জন সেনাসদস্য আহত হন। ২০২৫ সালের ২৪ জুন রাঙ্গামাটি জোনের আওতাধীন কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের কড়ইছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। ওই ঘটনায় সৈনিক মো: তারিকুজ্জামান খান বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে টহল দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে তিনজন সন্ত্রাসীকে আটক এবং একটি এসএমজি, একটি ম্যাগাজিন, ৪৭ রাউন্ড অ্যামোনিশনসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার করে। এ ছাড়াও গত ১৫ বছরে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মূল এর সশস্ত্র সদস্যদের আন্তঃদলীয় কোন্দলে ২৮ জন নিহত, ৬০ জন আহত, আঞ্চলিক দলের সাথে গুলি বিনিময়ের ঘটনায় ১২৪ জন নিহত, ৪২ জন আহত হয় এবং বিভিন্ন সময় ৩৩২ জনকে অপহরণ এ ছাড়াও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ২৭ বার গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য, দলটি পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি বছর আনুমানিক ৩০৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করে থাকে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এবং তার অঙ্গসংগঠনগুলোর সশস্ত্র কর্মকাণ্ড অঞ্চলটির স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অবস্থাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। চাঁদাবাজি, অপহরণ, গুলি বিনিময়, হামলা এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কার্যক্রম তাদের নিয়মিত কর্মকাণ্ড। ২০২৪-২০২৫ সালের বিভিন্ন সংঘর্ষ ও অরাজকতার ঘটনা প্রমাণ করে যে, তারা পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে সুপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃঢ় সংযম এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম হয়েছে এবং সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিহত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকে সংযমী আচরণের আহ্বান জানানো হচ্ছে। তবে সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা, জনগণের নিরাপত্তা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রায় যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইউপিডিএফ বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ সমূহ : ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকায় একটি সম্মেলনে গঠিত হয়, প্রধানত পার্বত্য চট্টগ্রামের ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরে পার্বত্য চুক্তির বিরোধিতা করে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে। গঠনের পর থেকে এই সংগঠনটি অধিকারের নামে চাঁদাবাজি, অপহরণ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা, গুম এবং সাধারণ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে আসছে। এর ফলে সংগঠনটি ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে ২৬টি গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে, যা অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ইউপিডিএফের চাঁদাবাজি পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছে, যা প্রায়ই অপহরণ বা হত্যায় পর্যবসিত হয়। ২০০১ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
১৬ এপ্রিল ২০২৫ সালে অপহরণ : খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে বিঝু উৎসব শেষে পাঁচজন শিক্ষার্থীকে (রিশন চাকমা, দিব্যি চাকমা, মৈত্রীময় চাকমা, লংঙি ম্রো ও অলড্রিন ত্রিপুরা) ইউপিডিএফ অপহরণ করে। পরে সেনা অভিযানের পর মুক্তি দেয়া হয়।
২৪ জুন ২০২৫ সালে সংঘর্ষ : কজইছড়ি, কাউখালী, রাঙ্গামাটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে একজন সেনাসদস্য আহত হয়, ১৬ জন নিহত এবং ৩১ জন আহত হয়।
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ সালে হামলা এবং আন্দোলন : গুইমারা, খাগড়াছড়িতে পিসিপির অতর্কিত হামলায় ১১ জন সেনাসদস্য আহত হয়। একই দিনে ধর্ষণ ঘটনাকে পুঁজি করে সহিংস আন্দোলন শুরু হয়, যাতে তিনজন নিহত, তিনজন পুলিশ আহত এবং প্রায় ৩০ জন আহত হয়।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গুলিবিনিময় : ২৬ নভেম্বর ২০১৯ দীঘিনালায় কয়েক ঘণ্টাব্যাপী গুলিবিনিময়; ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ লক্ষীছড়িতে ২ জন সেনা অফিসার আহত; ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খাগড়াছড়িতে গোলাগুলিতে ১০ জন সেনাসদস্য আহত হন। ইউপিডিএফ পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক পাহাড়ি ও বাঙালি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইস্যু ভিত্তিক আন্দোলন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের জন্য ইউপিডিএফ দায়ী। এ অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের নামে ইউপিডিএফ বাঙালি ও সেনাবাহিনীর প্রবল বিরোধিতা করে আসছে।
ইউপিডিএফের এই কর্মকাণ্ডগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং মানবাধিকারকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করেছে। এটি সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করেছে এবং অঞ্চলের উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করেছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ আমরা আন্তর্জাতিক সংস্থা, জাতিসঙ্ঘ এবং বাংলাদেশ সরকারকে এই লঙ্ঘনগুলোর তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের দাবি জানাই।
উৎস : নয়াদিগন্ত অনলাইন, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫