parbattanews

বিলাইছড়িতে উপজাতীয় কিশোরীকে গণধর্ষণ, উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের নিষ্ক্রীয়তা ও কিছু প্রশ্ন

মেহেদী হাসান পলাশ

রাঙামাটিতে সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসীদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে এলাকায় যাওয়ার পরে পূর্বের ধর্ষণের ভিডিও দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মাধ্যমে পুনরায় ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ এনে রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে ভূক্তভোগী পাহাড়ি এক কলেজ শিক্ষার্থী। রাঙামাটি জেলাধীন বিলাইছড়ি উপজেলার দূর্গম ফারুয়া ইউনিয়নে নিজ বাড়ির পার্শ্বোক্ত এগুইজ্জ্যাছড়ি এলাকায় উক্ত কলেজ শিক্ষার্থী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে মামলায় উল্লেখ রয়েছে। মঙ্গলবার (৩০ আগস্ট) রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের বিচারিক এইচ এম ইসমাইল হোসেন এর আদালতে পাঁচজনকে আসামি করে এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় অভিযুক্তরা হলেন, অঞ্জন তঞ্চঙ্গ্যা ওরফে এজেন্ট (৩০), রুজন দাশ (২৪), সুমন্ত চাকমা (২৫), স্নেহাশিষ বড়ুয়া (২৪) এবং সুজন দাশ (২৮)।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৩ এপ্রিল রাতে মামলার বাদীনি তার স্থানীয় এক বন্ধুর বাসায় বিঝুর (বৈশাখী উৎসব) নিমন্ত্রণ শেষ করে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা করার সময় পথিমধ্যে অভিযুক্ত পাঁচজন যুবক ওই কলেজ ছাত্রীকে ভয় ভীতি দেখিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক এগুজ্যাছড়ি ফরেস্ট অফিসের কালভার্টের নিচে দলবেঁধে ধর্ষণ করে। ওই কলেজ ছাত্রীর এক বন্ধু ঘটনাস্থলে এসে অভিযুক্ত যুবকদের বাধা প্রদান করলে তাকে বেঁধে বেধড়ক প্রহার করা হয়। এসময় ৩ নম্বর আসামি সুমন্ত চাকমা ধর্ষণের ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। পরবর্তীতে অঞ্জন তঞ্চঙ্গ্যা এবং রুজন দাশ কলেজছাত্রীকে মামলা না করার জন্য হুমকি প্রদর্শন প্রয়োজনে তার বাবাকে হত্যা করার হুমকি এবং ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিবেন বলে হুঁশিয়ারি করেন। পরে ওই ছাত্রী চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে’ চিকিৎসা নেন। হাসপাতালের ছাড়পত্রেও ‘গ্যাং রেপ’ এর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনার পর ২৩ জুন আবারো অভিযুক্তরা যুবকরা আবারো ধর্ষণের হুমকি দেন ওই ছাত্রীকে। ২৮ জুন কলেজছাত্রী বিলাইছড়ি থানায় মামলা করতে গেলে থানা মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করে। পরে ১২ আগস্ট আত্মহত্যার চেষ্টা করেন কলেজছাত্রী।

বিলাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ( ওসি) মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, মামলা না নেওয়ার বিষয়টি সঠিক নয়। ঘটনার অনেক পরে স্থানীয় এক হেডম্যান অভিযোগটি দিতে এসেছেন। আমি উনাকে বলেছি, ভিকটিম যেহেতু জেলা শহরে থাকেন সেক্ষেত্রে আদালতে মামলা করতে পারেন কিংবা বিলাইছড়ি থানাতেও মামলা করা যাবে। তবে ভিকটিম ও তার পরিবারকে অবশ্যই আসতে হবে। সূত্র: parbattanews.com

ভিকটিমের আইনজীবি অ্যাডভোকেট সালিমা ওয়াহিদা জেনি জানিয়েছেন, ঘটনার পর চিকিৎসা নেওয়ার পর মেয়েটি গত মাস খানেক আগে রাঙামাটি আদালতস্থ আইনজীবি ভবনে আমার চেম্বারে আসে। কিন্তু সে মানসিকভাবে অত্যন্ত দূর্বল এবং আতঙ্কগ্রস্থ অবস্থায় ছিলো। তাকে আমরা বিভিন্নভাবে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে কিছুটা আত্ম প্রত্যয়ী করে তুলি। এরপর তার সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করে লিগ্যাল এইড এ অভিযোগ দাখিল করি। পরবর্তীতে লিগ্যাল এইডের নির্দেশনায় আমি মঙ্গলবার ৩০শে আগষ্ট রাঙামাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল এ এই মামলার ফাইলিং করেছি। আদালত অভিযোগটি আমলে নিয়ে বিলাইছড়ি থানাকে মামলা নিতে এবং তদন্ত করে রিপোর্ট দাখিল করতে নির্দেশনা প্রদান করেন।

তিনি জানান, মূলত: ‘গণধর্ষণের শিকার কলেজছাত্রীকে ঘটনার পর থানায় মামলা না করতে চাপ প্রয়োগ এবং ধর্ষণের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে বলে হুমকি দেয় আসামিরা। পরবর্তীতে আসামিরা কলেজছাত্রীকে ভিডিও প্রকাশ করে দেবে; এমন হুমকি দিয়ে আবারও একইভাবে ধর্ষণে বাধ্য করতে থাকে। পরে নিরূপায় কলেজছাত্রীটি আমাদেরকাছে আসে এবং লিগ্যাল এইড এর সার্বিক সহযোগিতায় আদালতে মামলা দায়ের করেছে। সূত্র: সিএইচটি টাইমস ২৪.কম।

বিলাইছড়ির এই গণধর্ষণের ঘটনা কয়েকমাস আগের হলেও মিডিয়ার সুবাদের জানাজানি হয়েছে দুইদিন আগে। এই দীর্ঘ সময় ধর্ষকগং ও স্থানীয় প্রথাগত উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ ধর্ষিতাদের সুবিচার পাইয়ে দেয়ার কথা বলে মামলা না দিতে বাধা সৃষ্টি করে এসেছে। অথচ পাহাড়ে কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে এবং তার সাথে যদি অউপজাতীয় কোনো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় এ সকল প্রথাগত নেতৃবৃন্দ ঝাঁপিয়ে পড়ে। উপজাতীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রথাগত সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রচারণা চালিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এর সাথে সুর মিলিয়ে জাতীয় চিহ্নিত কিছু রাজনৈতিক সংগঠন, বিশেষ করে বাম ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো, চিহ্নিত কিছু বুদ্ধিজীবী, এনজিও ও মানবাধিকার কর্মী, এক শ্রেণীর আইনজীবীরা তাল মিলিয়ে সরকার ও যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। কিন্তু এ কিশোরীর ক্ষেত্রে তার লেশমাত্র দেখা যায় নি।

অথচ চার বছর আগে এই ফারুয়াতেই সংঘটিত আরেকটি ঘটনায় সম্পূর্ণ ভিন্নচিত্র দেখা গিয়েছিল। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে সেই ঘটনার দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। ২০১৮ সালের জেএসএস সন্ত্রাসী কর্তৃক একেরপর এক আওয়ামী নেতার উপর হামলা ও কয়েকজনকে হত্যার পর স্থানীয় আওয়ামী নেতাসহ শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রবল দাবীর মুখে উপজাতীয় সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ অভিযান শুরু করে যৌথবাহিনী। এরই অংশ হিসেবে ২২ জানুয়ারি গভীর রাতে রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ফারুয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের ওড়াছড়ি গ্রামে অভিযান চালায় তারা। এসময় তারা একটি মারমা বাড়িতে তল্লাশী করে। পরদিন থেকে সন্ত্রাসীদের পৃষ্ঠপোষক রাজনৈতিক সংগঠন কর্তৃক ঐ বাড়ির দুই মারমা বোনকে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানীর অভিযোগ করা হয় যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে। ইতোপূর্বেও যখনই যৌথবাহিনী সন্ত্রাসী ধরার জন্য অভিযান পরিচালনা করেছে তাদের থামাতে উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা অভিযানকে বিতর্কিত করতে নানা অপপ্রয়াস চালিয়েছে। অভিযোগের পর থেকেই উপজাতীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রথাগত সংগঠন ও নেতৃবৃন্দ যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে ভয়াবহ প্রচারণা চালিয়ে আন্দোলন শুরু করে। এর সাথে সুর মিলিয়ে জাতীয় চিহ্নিত কিছু রাজনৈতিক সংগঠন, বিশেষ করে বাম ধারার রাজনৈতিক সংগঠনগুলো, চিহ্নিত কিছু বুদ্ধিজীবী, এনজিও ও মানবাধিকার কর্মী, এক শ্রেণীর আইনজীবীরা তাল মিলিয়ে সরকার ও যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। স্থানীয় সার্কেল চিফের ইয়ান ইয়ান এই আন্দোলন ও প্রচারণায় নেতৃত্ব দেন। যদিও ডাক্তারি পরীক্ষায় ঐ দুই মারমা বোনের ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানীর কোনো আলামত বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

মূলত বিলাইছড়ি উপজেলায় আ’লীগ নেতাদের উপর জেএসএস’র হামলায় পুরো উপজেলায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাই নিরাপত্তা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দুই ব্যক্তিকে আটকের পরের দিন আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) পক্ষ থেকে গণমাধ্যমের কাছে একটি বিবৃতি পাঠিয়ে দাবি করা হয় যে, অভিযানের রাতে নিরাপত্তা বাহিনীর কতিপয় সদস্যের হাতে ওই এলাকায় দু’জন মারমা কিশারী ধর্ষণের শিকার হয়। আর এ ঘটনার পর থেকে পাহাড়ের বিভিন্ন আঞ্চলিক রাজনৈতিক এবং সশস্ত্র দলগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকসহ নানা মাধ্যমে কথিত এ ঘটনাকে রং, রূপ রস দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে  তুলতে থাকে।  সন্ত্রাসী আটক অভিযানকে  ভিন্ন খাতে প্রবাহিতের চেষ্টা চালালে শান্তির পাহাড় আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এদিকে ঘটনার পরের দিন কথিত ধর্ষিত দুই কিশোরীকে কে বা কারা দুর্গম বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়ন থেকে এনে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়।  খবর পেয়ে প্রশাসন দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে ঘটনার সতত্য যাচাইয়ের তৎপরতা শুরু করে। পুলিশ ও  জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ হাসপাতালে পৌঁছে দু’কিশোরীর জবানবন্দী রেকর্ড করানোর ব্যবস্থা নেয়।

ঘটনার তৃতীয় দিন  (২৩ জানুয়ারি)  দু’কিশোরীকে নিজের জিম্মায় নেয়ার জন্য পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীদের নিয়ে রানি ইয়েন ইয়েন হাসপাতালে অবস্থান নেয় এবং প্রশাসনের সাথে ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ করেন।  এদিকে হাসপাতালে গিয়ে দুই কিশোরীর সাথে কথা বলেন, চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য বাঞ্চিতা চাকমা, এডভোকেট সুষ্মিতা চাকমাসহ আরো বেশ কয়েকজন। পরিদর্শন শেষে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় ও রানি ইয়ান ইয়ান সাংবাদিকদের বলেন, হাসপাতালে কিশোরী দুটি মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন তাই তাদেরকে রানীর জিম্মায় নিতে চান তারা। সার্কেল চিফের স্ত্রী দুই কিশোরীকে নিজের জিম্মায় নিতে রাঙামাটি আদালতের দারস্থ হন। আদালত কিশোরী দুটির ডাক্তারি পরীক্ষা ও বয়স নির্ধারনী পরীক্ষা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুই কিশোরীকে হাসপাতালে রাখার নির্দেশ দেন।

এদিকে বাড়ি থেকে তুলে এনে ২৩ জানুয়ারি দুই কিশোরীকে বা কারা হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরের দিন অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি রাঙামাটি আসেন কিশোরীদ্বয়ের পরিবার। ওইদিনেই তারা  (দুপুরে) রাঙামাটি প্রেসক্লাবে  এক সংবাদ সন্মেলনের আয়োজন করে। আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নিজের দুই মেয়ের কথিত ধর্ষণ নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। তার দুই মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা  তারা সম্পূর্ণটাই মিথ্যা বলে দাবি করেছেন। পাহাড়ের একটি আঞ্চলিক দল বরং ধর্ষণের মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে তাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে এবং রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে হীন ষড়যন্ত্রে লীপ্ত বলে তারা জানান।

কিশোরীর পিতা সংবাদ সম্মেলনে বলেন, চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি রাতে জোড় করে তাঁর দুই কিশোরি মেয়েকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন চালায় একদল অজ্ঞাত যুবক। কিন্তু প্রাণহানীর ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারিনি তারা।  আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কে বা কারা ধর্ষণ করা হয়েছে এমন অভিযোগে তার দুই মেয়েকে ২৩ জানুয়ারি দুপুরে  কে বা কারা রাঙামাটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। অথচ এ ঘটনায় তিনি এবং তার  স্ত্রী কিছুই জানেন না বলেও  জানান।

এদিকে ‘আমরা ভাল আছি, শান্তিতে আছি। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করছি। আর কোন অসুবিধা নেই আমাদের। আমাদের মা-বাবা এবং ভাই-বোনকে নিয়ে ভাল সময়  কাটাচ্ছি’। এভাবে আনন্দ-উল্লাসে অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেন রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলায় কথিত নির্যাতিত দুই মারমা কিশোরী। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ দুপুরে ওই দু’কিশোরী সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিব্যক্তিগুলো এভাবেই প্রকাশ করে। ওই দু’কিশোরীর বাবা জানান, এ অঞ্চলের কিছু আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতির শিকার হয়েছে আমার মেয়েরা এবং আমার পরিবার। প্রতিনিয়ত ভয়ে থাকতাম আমার মেয়েদের হারানোর এবং নিরাপত্তা নিয়ে। আর আমার মেয়েদের নিজের কাছে রাখতে চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করি এবং উচ্চ আদালত আমার এ আবেদন শুনে আমার মেয়েদের আমার কাছে রাখার নির্দেশ প্রদান করেন। এর চেয়ে আনন্দ আর কি হতে পারে? (সূত্র: সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন আর্কাইভ)।

উল্লিখিত দুটি ঘটনা পাহাড়ের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। পাহাড়ে নারী নির্যাতনে সংঘটিত শত শত ঘটনার উদাহরণ। শুধু তাই নয়, এমনো দেখা গেছে পাহাড়ে কোনো উপজাতীয় নারী নির্যাতনের খবর প্রকাশের পর সাথে সাথে এ নির্যাতনের দায়ভার বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে উপজাতীয় নেতৃবৃন্দের মাঠ গরম করার পর যখন প্রকৃত নির্যাতনকারী হিসেবে উপজাতিদের নাম বেরিয়ে আসে তখন আন্দোলনকারী উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ গা ঢাকা দেয়। এমনই একটি ঘটনার উদাহরণ ইতি চাকমা হত্যাকাণ্ড। ২০১৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে জেলা সদরের আরামবাগ এলাকায় দুর্বৃত্তরা খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইতি চাকমাকে গলা কেটে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের পর দায়ভার বাঙালিদের উপর চাপিয়ে তিন পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম ও রাজধানী শহরে ব্যাপক আন্দোলন করে উপজাতীয় আঞ্চলিক দল ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি ও সংগঠন। কিন্তু পুলিশী তদন্তে প্রকৃত দেখা যায়, খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ইতি চাকমার সাথে সহপাঠি রিপেল চাকমা ওরফে রাজু চাকমা ওরফে রনি চাকমার দীর্ঘ দিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। রনি ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি  কলেজ শাখার প্রচার সম্পাদকও। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রেমের সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় ইতি চাকমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে রনি চাকমা। সে পরিকল্পনা মতে, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ রাতে  জেলা সদরের আরামবাগ এলাকায় ভগ্নিপতির বাসায় ইতি চাকমাকে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ সময় ভগ্নিপতি অটল চাকমা ছিল বাইরে আর বোন ছিল চাকুরির সুবাদে দীঘিনালায়। হত্যাকাণ্ডে রনি ও তুষার চাকমাসহ ৫জন অংশ নেয়। ধর্ষকরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। (সূত্র: সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন আর্কাইভ)।

লক্ষ্য করার বিষয় হলো, এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঙালি বিদ্বেষী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল স্বয়ং খুনী রণি চাকমা নিজেও। এদিকে খুনী হিসেবে উপজাতীয় যুবকদের নাম প্রকাশিত হওয়ার পর সকল প্রকার বিচারের দাবীতে উচ্চকিত কণ্ঠস্বর নিমীলীত হয়ে যায়। শুধু ইতি চাকমা একা নন, অনুসন্ধানে দেখা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে কোনো নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেই প্রত্যক্ষদর্শী না থাকলে উপজাতি এই সব সংগঠনগুলো এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট বিভিন্ন সংগঠন যেমন সিএইচটি কমিশন, কাপেং ফাউন্ডেশন এমনকি মানবাধিকার কমিশনও তার দায় বাঙালী ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর চাপিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চালায়। কিন্তু তদন্ত শেষে বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় ঐ সকল ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে পাহাড়ীরাই জড়িত। কিন্তু যখনই এসকল ঘটনায় পাহাড়ীদর নাম আসে তখন এসকল সংগঠন নীরব হয়ে যায়। কেন তাদের এই দ্বিমূখী আচরণ? বালাতি ত্রিপুরা, বিশাখা চাকমা, উ প্রু মারমা, সবিতা চাকমাসহ এরকম আরো অসংখ্য হত্যা বা ধর্ষণের উদাহরণ দেয়া যায় যাতে প্রত্যক্ষদর্শীর অভাবে বাঙালীদের দায়ী করে ব্যাপক অপপ্রচার করলেও পরে তদন্তে পাহাড়ীদের নাম আসায় এসকল সংগঠন নীরব হয়ে গিয়েছে।

এ ধরণের আরো কিছু উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।  ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সাথে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় অস্বীকৃতি জানানোর কারণে সন্ত্রাসীরা গত ৪ জুলাই ২০১৭ তারিখে রাঙামাটির নানিয়ারচরের লম্বাছড়ি থেকে মদন চাকমা নামে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের আস্তানা থেকে কৌশলে মদন চাকমা পালিয়ে যেতে গেলে সন্ত্রাসীরা ক্ষিপ্ত হয়ে মদন চাকমার নিজ বাড়ি থেকে তার স্ত্রী শুবলপুরি চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপ শুবলপুরি চাকমাকে অপহরণ করে যৌন কাজে ব্যবহারের জন্য আটকে রাখে। পরে মদন চাকমার অভিযোগ ও তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে তার স্ত্রীকে উদ্ধার করে নিরাপত্তাবাহিনী। এই ঘটনায় জড়িত থাকায় অমরেশ চাকমা নামে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের একজন গ্রেফতার হয়।

২০১৬ সালের ১৮ নভেম্বর রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলার নানাপুরণ গ্রামে নিজ বাড়ী থেকে অস্ত্রের মুখে জোসনা চাকমাকে তুলে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপ সমর্থিত সংগঠন যুব পরিষদ কর্মীরা। গলায় ও পায়ে শিকল পরিয়ে দীর্ঘ ২ মাস নির্যাতন করা হয় তাকে। পরে নিরাপত্তাবাহিনী তাকে উদ্ধার করে। রাঙামাটি প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে অপহৃত জোসনা চাকমা ও তার স্বামী অপু চন্দ্র সিংহ এসব নির্যাতনের বর্ণনা দেন। ভালবেসে বাঙালি হিন্দু ছেলে অপু চন্দ্র সিংহকে বিয়ে করার কারণে জোসনা চাকমাকে এই নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের পক্ষে কাজ করতে রাজি না হওয়ায় মিতালী চাকমা নামে রাংগামাটি সরকারী কলেজের ডিগ্রী ৩য় বর্ষের এক কলেজ ছাত্রীকে টানা তিন মাস তাদের আস্তানায় আটকে রেখে শারীরিক অত্যাচার ও ধর্ষণ করে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সদস্যরা। গত ১৭ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মিতালী চাকমাকে রাঙামাটি সদরের সাপছড়ি ইউনিয়নের বোধিপুর নিজ বাড়ি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সদস্যরা।  মিতালী চাকমাকে দলে যোগ দেয়ার জন্য চাপ দিলে তিনি রাজী না হওয়ায় তাকে ধর্ষণ করে গর্ভবতী করে মানসিক দৃঢ়তা ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় গ্রুপটি। সিদ্ধান্ত মোতাবেক তিন মাস ধরে মেয়েটির উপর নির্যাতন চালায় তারা। অপহৃত মিতালী চাকমাকে প্রায় ২ মাস পরে (১৯ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে) উদ্ধার করে যৌথবাহিনী। উদ্ধার হওয়ার পর খাগড়াছড়িতে সাংবাদিক সম্মেলন করে একথা জানায় মেয়েটি।

গত ১ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা-বাঘাইহাট সড়কের শুকনাছড়ি এলাকা থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ৪র্থ বর্ষের ছাত্রী রিমি চাকমাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিলো ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। অপহরণের পর এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক অভিযানে নামে বাঘাইহাট ও দিঘীনালার সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর সদস্যরা। এসময় সেনাবাহিনীর ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সন্ত্রাসীরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে এক পর্যায়ে রাত দশটার দিকে শুকনাছড়িতে স্নেহ কুমার চাকমার বাড়ির কাছে উক্ত শিক্ষার্থী রিমি চাকমাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সন্ত্রাসীরা।

খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার ক্ষেত্রলাল ত্রিপুরার মেয়ে দীপা ত্রিপুরাকে গত ১২ এপ্রিল ২০১৫ তারিখে অপহরণ করে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কর্মীরা। অপহরণের পর একটি জুম ঘরে আটক করে দীপা ত্রিপুরাকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে পিসিপি’র এসব সন্ত্রাসীরা। এসময় পুরো গণ-ধর্ষণের দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করে তারা। গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তারিখে মাটিরাংগার বাইল্যাছড়ি এলাকা হতে চলন্ত বাস থেকে স্বামীর সামনে থেকে নয়ন ত্রিপুরা ওরফে ফাতেমা বেগমকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। নয়ন ত্রিপুরার অপরাধ ছিলো সে ভালবেসে বাঙালী ছেলেকে বিয়ে করেছিলো।

গত ৩০ মে ২০১৬ তারিখে, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থেকে আঞ্চলিক সংগঠণ জেএসএস (সন্তু) গ্রুপ এর হাতে অপহৃত হন অবসর প্রাপ্ত সার্জেন্ট মুকুল চাকমা। যিনি এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ। ঘটনার পর বিভিন্ন চড়াই উৎরাই পেরিয়ে থানায় মামলা দায়ের করার পর থেকে স্থানীয় সন্ত্রাসী কর্তৃক নানান রকম হুমকির সম্মুখীন হয়েছে মুকুল চাকমার স্ত্রী এবং কন্যা নমিসা চাকমা। চট্টগ্রাম নাসিরাবাদ মহিলা কলেজের অনার্সের ছাত্রী নমিসা চাকমা নিরাপত্তাহীনতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে এখন তারা সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে আত্নগোপনে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মা এবং তারা দুই বোন এখন আর পৈতৃক ভিটায় যেতে পারছেন না।

গত ২৯ মে ২০১৬ তারিখে, রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলাতে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল জেএসএস(সন্তু) গ্রুপ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) অর্থ সম্পাদক সুনীতিময় চাকমা এর নেতৃত্বে প্রায় ২০ জনের একটি দল আয়না চাকমা নামক এক কিশোরীকে অপহরণ করে। এরপর গহিন জঙ্গলে নিয়ে আয়না চাকমাকে যৌন নির্যাতন করে তারা।

গত জুন ২০১৩ তারিখে, বাঙালী মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে রাঙামাটির কুতুকছড়িতে চলন্ত অটোরিক্সা থেকে নামিয়ে রিনা ত্রিপুরা নামে এক পাহাড়ি যুবতিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সন্ত্রাসীরা। যার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।  অপহৃত রীনা ত্রিপুরার বাড়ি বান্দরবানের লামা উপজেলার কুমারী পাড়ার ইয়াং ছড়া গ্রামে। একই ভাবে ২০১৫ সালের মার্চ মাসের দিকে ভালোবেসে এক বাঙ্গালী ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে খাগড়াছড়ি জেলার গুইমারা থানাধীন হাফছড়ির থোয়াই অং মারমা‘র মেয়ে উমাচিং মারমা ও তার পরিবারকে নির্যাতনসহ সে পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে ইউপিডিএফ (প্রসীত) গ্রুপের সন্ত্রাসীরা ও স্থানীয় পাহাড়ী জনপ্রতিনিধিবৃন্দ। তারা বাঙালী স্বামীকে ত্যাগ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে মেয়েটির প্রতি। কিন্তু মেয়েটি তা অস্বীকার করায় ঐ সন্ত্রাসীরা উমাচিং মারমাকে বেঁধে একটি কক্ষে আটকে রাখে এবং অমানুষিক নির্যাতন করে বাঙালী স্বামীকে ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু মেয়েটি তাতে রাজি না হয়ে সকল অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করতে থাকে। এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে মেয়েটি পালিয়ে ঢাকায় তার স্বামীর কাছে চলে যায়।

উপজাতি এই সকল সংগঠনগুলো তাদের মা-বোনদের শুধু ধর্ষণ আর নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয় না। তাদের সহিংসতার শিকার হতে হয় অবুঝ শিশুদেরকেও। এমনই একটি উদাহরণ হলো মৃত নরোত্তম ত্রিপুরার মেয়ে কৃত্তিকা ত্রিপুরা। গত ২৮ জুলাই ২০১৮ তারিখে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নের নয়মাইল এলাকায় স্কুলছাত্রীর কৃত্তিকা ত্রিপুরা(১২) কে হত্যা করা হয়। কৃত্তিকা ত্রিপুরা ছিলো নয় মাইল ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। ঘটনার পর পুলিশ ও এলাকাবাসী পাশের বাগান থেকে রাত সাড়ে দশটায় নিহতের লাশ উদ্ধার করে। পরবর্তীতে, স্কুলছাত্রী কৃত্তিকা ত্রিপুরাকে বিভৎস হত্যার দায় শিকার করে পুলিশের নিকট জবানবন্দি প্রদান করে এই ঘটনায় আটক জেএসএস এমএন লারমা গ্রুপ সমর্থিত যুব সমিতির নেতা রবেন্দ্র ত্রিপুরা ওরফে শান্ত।

কৃত্তিকা ত্রিপুরা হত্যার আগে নয়মাইল এলাকার মৃত নরোত্তম ত্রিপুরার ঘরে বসেই চাঁদা উত্তোলন করতো শান্ত। কৃত্তিকা ত্রিপুরার মা অনুমতি ত্রিপুরা তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে কৃত্তিকা ত্রিপুরাকে নৃসংশভাবে হত্যা করে এবং ঘটনা ঘটানোর পর কাউকে না জানানোর জন্যে হুমকি প্রদান করা হয়। হত্যার পর নিজেদের দোষ ধামাচাপা দিতেই কয়েক বাঙ্গালী যুবকের নাম জড়িয়ে তাদেরকে ধর্ষণ ও হত্যার জন্য দায়ী করে সভা সমাবেশ করে

জেএসএস,ইউপিডিএফসহ বিভিন্ন উপজাতীয় সংগঠন। রাজধানী ঢাকা ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে এই ঘটনাকে পার্বত্য বাঙালী বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরিতে ব্যাপকভাবে প্রচারও করে তারা। এই ঘটনার পর থেকে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এমনকি জাতিসংঘের বৈঠকেও ধর্ষণ ও হত্যাকারী হিসাবে বাঙালীদের দায়ী করে বিভিন্ন কর্মসূচী ও অপপ্রচার চালানো হয়। ১৮ মার্চ ২০১৮ রাঙামাটিতে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) দুই গ্রুপের মধ্যে সংর্ঘষে একজন গুলিবিদ্ধ এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মন্টি চাকমা ও ওই সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দয়া সোনা চাকমাকে অস্ত্রের মুখে গুম করা করে তাদের বিরোধী পক্ষ। দীর্ঘদিন এ দুই নেত্রী অপহৃত থাকলেও এ নিয়ে উল্লিখিত গোষ্ঠীকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। (সূত্র: সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন আর্কাইভ)।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এতো দীর্ঘ প্রমাণ হাজির করে কী বোঝানো হয়েছে? এর মাধ্যমে বাঙালি কর্তৃক ধর্ষণকে সমান্তরাল করার চেষ্টা হয়েছে কীনা এ প্রশ্নও উঠতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা তা নয়। ধর্ষক ধর্ষকই। তার কোনো জাত বিচার হতে পারে না। এ লেখার উদ্দেশ্য সে সকল উপজাতীয় ও প্রথাগত নেতৃবৃন্দ এবং তাদের প্রতি পক্ষপাত দুষ্ট সহানুভূতিশীল গোষ্ঠীর দ্বিচারী মুখোশ উন্মোচন যারা মানবাধিকার ও ক্ষুদ্রনৃগোষ্ঠীর অধিকারের অন্তরালে মূলত তাদের নিষ্পেষণে লিপ্ত। কেননা, বাঙালি ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে রেটিনা চাকমাকে যখন উপজাতীয় সন্ত্রাসীরা ধর্ষণের জন্য নিলামে তুলেছিল তখনো তাদের মুখে রা শব্দটি পর্যন্ত শোনা যায়নি। উল্টো ওই বাঙালি ছেলেকে চাকরী থেকে ছাঁটাই করতে তার কর্মস্থলে সুপারিশ করেছিলেন এক জাতীয় রাজনীতিবিদ।

পাহাড়ে যখনই কোনো উপজাতীয় নারী ধর্ষিতা ও নির্যাতিতা হয় উপজাতীয় সম্প্রদায় কর্তৃক তখনই এসকল সামাজিক নেতৃবৃন্দ প্রথাগত বিচারের কথা বলে তাদের দেশে প্রচালিত আইন ও আদালতের আশ্রয়ে ন্যায়বিচার পেতে বাধার সৃষ্টি করে। উপজাতীয়দের প্রথাগত বিচারে ধর্ষণের শাস্তি ধর্ষকেকে একটি শুকর জরিমানা। অর্থাৎ যার যত শুকর থাকবে তিনি তত ধর্ষণ করে শুকর জরিমানা দিয়ে পার পেয়ে যাবেন। অনেকক্ষেত্রে জরিমানাকৃত শুকর জবাই করে তার রক্ত দিয়ে ধর্ষিতাকে স্নান করিয়ে এবং সেই রক্ত পাড়ায় ছিটিয়ে পাড়া পবিত্র করা হয়। লেখিকা রোকেয়া লিটা তার ‘ডুমুরের ফুল’ ফিকশনে এ ঘটনার উল্লেখ করলে উপজাতীয় ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে গণধর্ষণ করে হত্যার হুমকি দেয়া হয়।

এরকমই একটি ঘটনা ঘটে রাঙামাটি জেলার কাউখালীর ঘাগড়া ইউনিয়নের বেতছড়ি উপজাতীয় পাড়ায় ১৬ বছরের এক চাকমা কিশোরী স্কুল ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায়। ২০১৮ সালের ২ আগস্ট বৃহস্পতিবার বিকাল ৫টায় ঐ কিশোরীর বাড়ীর পার্শ্বে তারই প্রতিবেশী মৃত সবিক্কা চাকমার ছেলে রিপন চাকমা (২৫) কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়। এ ব্যাপারে ধর্ষিতার বাবা মা রাতে থানায় মামলা করার সিদ্ধান্ত নিলেও স্থানীয় কার্বারী, মাতাব্বর ও পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপের ভয়ভীতির কারণে মামলা না করেই বাড়ী ফিরে আসেন। ধর্ষিতা কিশোরীর বাবা সবিচন্দ্র চাকমা ও মা পূর্ণিমা দেবীর সাথে কথা বললে তারা পার্বত্যনিউজকে জানায়, গত ২ আগস্ট বিকাল ৫টায় তাদের একমাত্র মেয়ে কাউখালী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণীর ছাত্রী ১৬ বষয় বয়সী অন্তিকা চাকমা (ছদ্ম নাম), সুপারী বিক্রি করতে পার্শ্ববর্তী বাড়ীতে যায়। সেখান থেকে বাড়ী ফেরার পথে একই এলাকার মৃত সবিক্কা চাকমার ছেলে রিপন চাকমা (২৫) জোরপূর্বক তাদের একমাত্র মেয়েকে মুখে কাপড় চেপে ধরে পাশ্ববর্তী জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণ করে।

সন্ধ্যায় তাদের মেয়ে অন্তিকা চাকমা (ছদ্ম নাম), বাড়ী ফিরে কান্না কাটি করতে থাকে এবং বিষয়টি বাবা মা বলে। রাত সাড়ে ন’টায় দূর্গম পাহাড় অতিক্রম করে মেয়েকে নিয়ে হাসপতালে ছুটে আসেন বাবা সবিচন্দ্র চাকমা ও মা পুর্ণিমা চাকমা। কিন্তু মামলা থেকে বিরত রাখা ও ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্থানীয় কার্বারী জয়ধন চাকমা ও এলাকার মাতব্বর হিসেবে পরিচিত কার্যা চাকমা। তারা ধর্ষিতার বাবা মাকে বিভিন্ন হুমকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে মিমাংসার কথা বলে রাতেই এলাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। স্থানীয়ভাবে কী বিচার করা হবে জানতে চাইলে জবাবে ধর্ষিতার বাবা পার্বত্যনিউজকে জানান, সামাজিক রীতি অনুসারে ধর্ষককে ৫০ বেত্রাঘাত এবং ধর্ষিতাকে একটি শুকর প্রদান করার মধ্যেমেই এমন জঘন্য কাজের বিচার কাজ সম্পন্ন করা হয় বলে তিনি জানান। কিশোরীর বাবা জানান, সামাজিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মামলা মোকাদ্দমা করতে গেলে তাদের উপর নির্যাতন চালানো হবে এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও রয়েছে বলে তিনি জানান। তবে তিনি জানান, যত হুমকিই আসুক সামাজিক প্রথার নামে এমন অন্যায় আমরা মেনে নেব না। আমরা ন্যায় বিচার চাই এবং প্রশাসনের সহযোগিতা চাই। এদিকে ঐ এলাকায় গত এক বছরে পাহাড়ী যুবকদের দ্বারা অর্ধ ডজন ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও বেত্রাঘাত এবং শুকর দানের মাধ্যমে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে স্থানীয়ভাবে মিমাংসা করা হয়েছে বলে জানালেন ঐ কিশোরীর বাবা সবিচন্দ্র চাকমা।

ফারুয়ার গণধর্ষণের শিকার কিশোরী ও তার পরিবারকে মামলা তুলে নেয়ার জন্যে একইভাবে চাপ দিয়ে আসছে এই স্থানীয় রাজনৈতিক ও প্রথাগত নেতৃবৃন্দ। তাই পাহাড়ের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ফারুয়ার গণধর্ষণের শিকার কিশোরীটি যেন একইভাবে পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতির বলি হয়ে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত না হয়।

লেখক: সম্পাদক, পার্বত্যনিউজ, চেয়ারম্যান, সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশন।


Exit mobile version