“জেএসএস ও ইউপিডিএফ মূল সংগঠনের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে সরে যাওয়ার অর্থ সংগঠন দুইটি নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে। এছাড়াও গত বছর দেড়েক সংগঠন দুটি তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করেনি। এসব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অভিমত হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে পাহাড়ের দুই বৃহৎ উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠন। বিশেষ করে পাহাড়ের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী থেকে এ ধারণা আরো জোরালো হয়েছে।”
কতোটা প্রস্তুত বাংলাদেশ

পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক নতুন খেলার আভাস

fec-image

পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। এর সাথে ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগর ও সন্নিহিত অঞ্চল কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, যোগাযোগ ও কৌশলগত গুরুত্ব ও নানা সমীকরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যায় বহু মাত্রিকতা যুক্ত করেছে। এটা শুধু যে মিয়ানমারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে বলে তাই নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়া, রাখাইন কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের বিভিন্ন উদ্যোগ, মিয়ানমারের বুড্ডিস্ট স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির উত্থান অন্যতম কারণ।

মেহেদী হাসান পলাশ

কনকনে শীতের হিমেল হাওয়ার মধ্যেই সারাদেশের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে নির্বাচনী উত্তাপ। গত ১৬ জানুয়ারি খাগড়াছড়ি সদর ও লামা পৌরসভা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এই নির্বাচনী উত্তাপ। ধাপে ধাপে পাহাড়ের আরো ৫টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যেই স্থানীয় সরকার পরিষদের সবচেয়ে বড় নির্বাচন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে নির্বাচন কমিশন। বর্তমানে দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। এরমধ্যে ৪ হাজার ১০০টি ইউপির নির্বাচন আয়োজনে প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তবে এর আগেই দেশের ২৫৯টি পৌরসভার নির্বাচন শেষ করতে চায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য অনুযায়ী, ৩২৯টি পৌরসভার মধ্যে ২৫৯টিতে নির্বাচন করতে আইনগত বা সীমানা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা নেই। এই ২৫৯টি পৌরসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ বিবেচনায় ভোটের ধাপ নির্ধারণ করা হচ্ছে।

এদিকে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে ঘিরে সারাদেশের গ্রাম, গঞ্জ ও পৌর এলাকা এখন নির্বাচনী আলোচনায় সরগরম। সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে মাঠে নেমে পড়েছেন। ভোটারদের মন জয় করতে বাড়ি বাড়ি ছুটছেন। সারাদেশের মতো স্থানীয় পরিষদের এই নির্বাচনী ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ভূ-খণ্ড পার্বত্য চট্টগ্রামেও। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টের বরাতে জানা যায়, তিন পার্বত্য জেলায় পৌরসভা নির্বাচন চলমান অবস্থায়ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ঢেউ লেগেছে প্রবলভাবে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা ইতোমধ্যেই মাঠে নেমেছে। ভোটারদের মন জয়ের পাশাপাশি দলীয় মনোনয়নের জন্যও তারা দৌড়ঝাপ শুরু করেছে। কেননা, গতবারের মতো এবারেরও চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে।

তবে দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভূ-প্রকৃতি, জনবৈচিত্র্যের কারণে যেমন, তেমনি উপজাতীয় আঞ্চলিক রাজনীতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী কার্যক্রমের কারণে এই অঞ্চলের যেকোনো নির্বাচন বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের নির্বাচনের মতো নয়। এ অঞ্চলের নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকে নিরাপত্তা ইস্যু। কেননা উপজাতীয় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো অস্ত্রের জোরে নির্বাচনকে তাদের পক্ষপুটে নিতে চায়। তার জন্য নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, অপহরণের মতো কাজ করতেও তারা কুণ্ঠিত হয় না। এক্ষেত্রে ২০১৯ সালের ১৮ মার্চ রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় নির্বাচনী কর্মকর্তাদের উপর সন্ত্রাসীদের ব্রাশফায়ারে কমপক্ষে ৭ জন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা নিহত ও অন্তত ১৬ জন আহত হওয়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। শুধু নির্বাচনী কর্মকর্তা নয়, তাদের পরিকল্পনার বাইরে নিজ জাতির কেউ নির্বাচন করলে বা নির্বাচিত হলে তাদের চরম পরিণতি ভোগ করতে হয়। নানিয়ারচরের উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার নির্মম হত্যাকাণ্ড তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কাজেই এহেন ঘটনা প্রতিরোধে এখন থেকেই সুপরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি গ্রহণ না করলে আসন্ন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধা করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তবে এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। সে আলোচনায় আসার আগে তিন পার্বত্য জেলার বিগত স্থানীয় সরকার পরিষদ নির্বাচনগুলোর দিকে একটু আলোকপাত করে নেয়া প্রয়োজন।

সিএইচটি রিসার্চ ফাউন্ডেশনের আর্কাইভ থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সর্বমোট ১১৯টি ইউপির মধ্যে ১১৩টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ৬টি ইউপি নির্বাচন স্থগিত হয়। ১১৩টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ৩৬টি, বিএনপি ২২টি, জেএসএস(মূল) ১৫টি, ইউপিডিএফ ৩১টি, জেএসএস(সংস্কার) ৫টি, স্বতন্ত্র ৩টি, বাঙালি সংগঠন ১টি ইউপিতে জয়লাভ করে। পরবর্তীকালে স্থগিত নির্বাচনগুলো অনুষ্ঠিত হয়।

অন্যদিকে ২০১৬ সালের সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনের জেলাওয়ারি হিসাবে দেখা যায়, রাঙামাটি জেলায় ৪৯টি ইউপির ২৫টিতে জেএসএস সমর্থিত প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। বাকী ২৪টিতে তারা পরাজিত হয় (বিএনপি ১টি, আওয়ামীলীগ ১৩টি, ইউপিডিএফ ৮টি, স্বতন্ত্র ১টি ও জেএসএস লারমা ১টি)।

খাগড়াছড়ির ৩৯টি ইউপির মধ্যে ৩৭টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ২টির ফলাফল স্থগিত থাকে। নির্বাচন হওয়া ৩৭টি ইউপির মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৩টি, বিএনপি ৩টি, ইউপিডিএফ ১৫টি, জেএসএস (সংস্কার) ৩টি ইউপিতে জয়লাভ করলেও জেএসএস (মূল) ও বাঙালি সংগঠনগুলো এ জেলায় কোনো ইউপিতে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়নি।

অন্যদিকে বান্দরবানের ৩১টি ইউপির মধ্যে ২৮টিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ ১২টি, বিএনপি ১২টি, জেএসএস (মূল) ৩টি ও স্বতন্ত্র ১টি আসনে জয়লাভ করে। ইউপিডিএফ ও বাঙালি সংগঠন এ জেলায় কোনো ইউপিতে জিততে পারেনি। পূর্বেই বলা হয়েছে, সমতলের নির্বাচন ও পাহাড়ের নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এখানে নির্বাচন মানেই উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর অস্ত্রের ঝনঝনানী, খুন, অপহরণ, নির্যাতন, রক্তপাত। এক্ষণে বিগত ইউপি নির্বাচনের সময়কালের ঘটনাবলীর দিকে আলোকপাত করাতে চাই।

বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মংপ্রু মারমার কথা বলা যায়। গত ১৩ জুন ২০১৬ তারিখে জেএসএস (সন্তু লারমার গ্রুপ) কর্তৃক অপহৃত হন তিনি। এরপর থেকে অদ্যবধি খোঁজ নেই তার। স্বামীর অপেক্ষায় আজো পথপানে চেয়ে চোখের পানি ফেলছেন মংপ্রু মারমার স্ত্রী সামা প্রু মারমা। তার অপরাধ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৪শ’ উপজাতি সম্প্রদায়ের লোক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এরপর অনেকেই জেএসএস সন্তু গ্রুপের হুমকির কারণে আর আওয়ামী লীগে সক্রিয় থাকতে পারেননি। বিশেষ করে ২০১৭ সালের শেষের দিকে জেএসএস সন্তু গ্রুপের হুমকির মুখে আওয়ামীলীগ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে রাঙ্গামাটির জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি ও বাঘাইছড়ির শত শত উপজাতিরা।

একইভাবে আওয়ামী লীগ করার অপরাধে গত ৫ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রাম চরণ মারমা ওরফে রাসেল মারমাকে পিটিয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় ফেলে রেখে যায় জেএসএস সন্তু গ্রুপের ১০-১২ জনের একটি দল। ওই দিনই রাত ৮টার দিকে জুরাছড়ি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও উপজেলা আওয়ামী যুবলীগের সহ-সভাপতি অরবিন্দু চাকমাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

৬ ডিসেম্বর মধ্য রাতে নিজ ঘরে ঢুকে মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ঝর্ণা খীসা ও তার পরিবারের আরও দুই সদস্য কুপিয়ে জখম করা হয়। এরও আগে গত ২০ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে বিলাইছড়িতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি স্বপন কুমার চাকমা, যুবলীগ নেতা রিগান চাকমা, ইউপি সদস্য অমৃত কান্তি তঞ্চংগ্যা, কেংড়াছড়ি মৌজার হেডম্যান সমতোষ চাকমাকে মারধরের ঘটনা ঘটে।

গত নির্বাচনের আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে শাসকদল আওয়ামী লীগের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে, তারা রাঙামাটিতে ৪৯টি ইউপির মধ্যে ১৯টিতে প্রার্থী হতে আগ্রহী হওয়ার মতো কাউকে না পাওয়ায় নমিনেশন দিতে পারেনি। তবুও কয়েক দফায় নির্বাচন পেছাতে হয়েছে। অনেক জায়গায় নামকাওয়াস্তে নমিনেশন দেয়া হয়েছে। প্রার্থীরা মাঠে দাঁড়াতেই পারেনি। এ অবস্থা দেখা গিয়েছে খাগড়াছড়িতেও। সেখানে নমিনেশন দেয়া গেলেও আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীই মাঠে থাকতে পারেনি। এমন অবস্থায় আওয়ামী লীগ নেতৃবন্দ সংবাদ সম্মেলন করে তাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ দলীয় কার্যালয়ে এমনি এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক পার্বত্য বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ও রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দীপংকর তালুকদার বলেন, ‘পাহাড়ে কেউ শান্তিতে বসবাস করতে পারছে না। কিছু উগ্র জুম্ম সশস্ত্র সন্ত্রাসীর কাছে জিম্মি রয়েছে পাহাড়ের সাধারণ মানুষ। অস্ত্রের ভয়ে বাধ্য হয়ে চাঁদা দিতে হচ্ছে পাহাড়ে উৎপাদিত কলা থেকে শুরু করে প্রতিটি জিনিসপত্রের। চাঁদা না দিলে অপহরণ, খুন, গুম, হত্যাকাণ্ডে ভয়ে নিরাপত্তাহীনতায় থাকতে হয় তাদের।’

তিনি বলেন, ‘এসব সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা এখন প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া শুরু করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। তাদের অবৈধ অস্ত্রের ভয়ে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও প্রার্থী হিসেবে অংশ নিতে চাইছে না কেউ। সুস্থ নির্বাচনের জন্য পার্বত্যাঞ্চল থেকে অবৈধ অস্ত্রধারীদের নিশ্চিহ্ন করা প্রয়োজন।’

সাবেক এ প্রতিমন্ত্রী অভিযোগ করে বলেন, ‘নির্বাচনের আগেই স্থানীয় নামধারী সন্ত্রাসী গ্রুপের ভয়ে আওয়ামী লীগের কোনো নেতাকর্মী প্রার্থী হতে চাইছে না। যার কারণে রাঙামাটি ৪৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৯টি ইউনিয়নে প্রার্থী দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবৈধ অস্ত্রধারীদের হুমকির কারণে রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যানগণ দলীয় সমর্থনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি অবিলম্বে পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে নিরাপত্তা বাহিনীর সমন্বয়ে চিরুণী অভিযান চালানোর জন্য জোর দাবি জানান।’

এবারে অবশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতি। তিন পার্বত্য জেলায় যে পৌরসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে এ পর্যন্ত তা শান্তিপূর্ণ। হত্যা, অপহরণ, এমনকি কোথাও কোনো সহিংসতার খবরও শোনা যায়নি, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের দৃশ্যমান চিত্রের সাথে একেবারে মেলানো যায় না। এর কারণ তিন পার্বত্য জেলার নির্বাচনী মাঠ থেকে হঠাৎ উধাও স্থানীয় দুই বৃহৎ আঞ্চলিক সংগঠন। গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত খাগড়াছড়ি সদর ও লামা পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়নি ইউপিডিএফ ও জেএসএস। একইভাবে মাটিরাঙ্গা, রাঙামাটি সদর ও বান্দরবান সদর পৌরসভা নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না দল দুটি। স্থানীয়ভাবে শক্ত অবস্থান থাকার পরও সংগঠন দুটি নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অধিবাসীদের মধ্যে বিস্ময়াভাব লক্ষণীয়। শুধু অংশ না নেয়া নয়, নির্বাচনী কোনো কার্যক্রমে তাদের কোনো অংশগ্রহণও দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে তিন পার্বত্য জেলায় শুরু হয়েছে জল্পনা, কল্পনা, বিশ্লেষণ। কেন উক্ত দুই আঞ্চলিক সংগঠন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না? এক্ষেত্রে তিনটি সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যায়।

  • ১. সাংগঠনিকভাবে উক্ত দুইটি রাজনৈতিক সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়েছে, নির্বাচনে অংশ নেয়ার মতো সাংগঠনিক শক্তি ও ভিত্তি বর্তমানে অনুপস্থিত।
  • ২. বর্তমান নির্বাচনী প্রবণতা অনুযায়ী সরকার বিরোধী সংগঠনের জয়লাভের সম্ভাবনা না থাকায় তারা নির্বাচন বয়কট করেছে।
  • ৩. নিয়মতান্ত্রিক বা সাংবিধানিক রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে উক্ত দুইটি রাজনৈতিক সংগঠন।

উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করে বলা যায়, বর্তমান তিন পার্বত্য জেলায় জেএসএস ও ইউপিডিএফ মূল অংশের সাংগঠনিক ভিত্তি মোটেই দুর্বল নয়। বরং অঞ্চলভেদে সংগঠন দুটি তাদের শক্তিশালী অবস্থান এখনো ধরে রাখতে পেরেছে। অন্যদিকে সংগঠন দুটি বর্তমান সরকারের অধীনে বর্তমান নির্বাচনী ট্রেন্ডের মধ্যেই বেশ কয়েকটি স্থানীয় সরকার ও জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক বিশ্লেষকদের মতে, জেএসএস ও ইউপিডিএফ মূল সংগঠনের নির্বাচনী কার্যক্রম থেকে সরে যাওয়ার অর্থ সংগঠন দুইটি নিয়মতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে। এছাড়াও গত বছর দেড়েক সংগঠন দুটি তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালনা করেনি। এসব পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অভিমত হচ্ছে, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে যাচ্ছে পাহাড়ের দুই বৃহৎ উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠন। বিশেষ করে পাহাড়ের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী থেকে এ ধারণা আরো জোরালো হয়েছে।

৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত বিপুল পরিমাণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের শান্তিচুক্তির বর্ষপূর্তি পরবর্তীকালে পাহাড়ের শীর্ষস্থানীয় এক উপজাতীয় নেতা তার অনুসারীদের বলেছিলেন, যে উদ্দেশ্যে আমি শান্তিচুক্তি করেছিলাম, তার কিছুটা অর্জিত হয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান চুক্তির মাধ্যমে এর অধিক অর্জন সম্ভব নয়। কিন্তু আমার যে বয়স তাতে এই বয়সে আর পাহাড়ে, জঙ্গলে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই জুম্ম জাতির অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তোমরা প্রস্তুতি নাও। প্রয়োজনে পাহাড়ে শান্তিচুক্তির পূর্বাবস্থায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। বিশেষ করে উপজাতীয় তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এই শীর্ষ নেতা তাদেরকে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সীমান্ত পাড়ি দেয়ার আহ্বান জানান। একই সাথে যারা যাবে না তাদের যেকোনো পরিণতির দায় তিনি নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। শীর্ষ নেতার এই আহ্বানের পর বিশেষ করে বান্দরবান ও রাঙামাটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে উপজাতীয় তরুণ ও কমিউনিটি লিডারগণের সীমান্ত পাড়ি দেয়ার খবর মেলে। বিশেষ করে ২০২০ সালের প্রথমার্ধে বান্দরবান, কাপ্তাই ও রাজস্থলী এলাকার তরুণ ও কমিউনিটি লিডারদের একটি অংশকে মাঝে মাঝেই বেশ কয়েক মাসের জন্য হাওয়া হয়ে যেতে দেখা গিয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া এখনো চলমান রয়েছে। তবে ইতোমধ্যে হাওয়া হয়ে যাওয়া গ্রুপের একটি অংশ ফিরে এসে বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে বলে জানা গেছে। অতি সম্প্রতি সম্প্রীতির বান্দরবানে সিক্স মার্ডারসহ যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেগুলো তারই অংশ বিশেষ হতে পারে।

এরই অংশ হিসেবে গত ২৫ ডিসেম্বর ৫১তম সীমান্ত সম্মেলনে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাফিনুল ইসলাম ভারতের মিজোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি থাকার কথা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এসব ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য তার ভারতীয় কাউন্টার পার্টকে অনুরোধ করেন। জবাবে ভারতীয় পক্ষ থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের মাঝামাঝি মিয়ারমার থেকে ভারতের মিজোরাম হয়ে একটি বিরাট অস্ত্রের চালান পার্বত্য চট্টগ্রামে ঢুকেছে। রাঙামাটির থেগামুখ চ্যানেল দিয়ে ঢোকা এই চালানে রকেট লঞ্চার, মর্টার, গ্রেনেড, ভারী মেশিনগান ও বিপুল পরিমাণ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গোলাবারুদ রয়েছে। এছাড়াও একই বছরের ২০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ-মিজোরাম সীমান্তে একটি বিরাট অস্ত্রের চালান আটক করে বিএসএফ। এ চালানে ২৮টি একে-৪৭, ১টি একে-৫৬ ও ১টি কারবাইনসহ মোট ৩০টি অস্ত্র ও ৭৮৯৪টি গুলি উদ্ধার করা হয়। এর কিছুদিন পর ৭ ডিসেম্বর ২০২০ সালে বাংলাদেশ- মিজোরাম সীমান্তে আরো একটি বিশাল অস্ত্রের চালান আটক করা হয়। এ চালানে ২৮টি একে-৪৭, ১টি একে-৫৬, ১টি একে-৭৪, ১টি .৩২ বোর বন্দুক ও ৪৪৯১ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী সূত্রে গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে দাবী করা হয়, এই দুইটি চালানই মিয়ানমার থেকে মিজোরাম হয়ে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের গন্তব্যে যাচ্ছিল।

৭ ডিসেম্বর ২০২০ সালে বাংলাদেশ- মিজোরাম সীমান্তে আটককৃত বিশাল অস্ত্রের চালান

 

পার্বত্য চট্টগ্রামে এখন যে ধরনের সহিংসতা ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে তাতে রকেট লঞ্চার, মর্টার ও গ্রেনেডের মতো যুদ্ধাস্ত্র প্রয়োজন হয় না। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এ ধরনের অস্ত্র কেন আনছে উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর সশস্ত্র শাখা? এসব অস্ত্রের টার্গেট কারা? উত্তর একটাই বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তথা বাংলাদেশের অখণ্ডতা। সূত্র মতে, পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পাহাড়ের অবস্থা শান্তিচুক্তি পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিরাপত্তা বাহিনীর আগে ও তাদের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক সংগঠন দণ্ডায়মান রয়েছে। সেকারণে নিরাপত্তা বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার আগে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলো ধ্বংস করার কৌশল নিয়ে এগুচ্ছে সশস্ত্র উক্ত সংগঠন দুটি। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারও অনেকটাই অবগত হয়েছে। সেকারণেই হয়তো সরকার শান্তিচুক্তির পর প্রত্যাহারকৃত পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পে পুলিশ ও বিজিবি মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে।

শুরু থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল দেশীয় এবং কিছুটা আঞ্চলিক সমস্যা। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট কক্সবাজারে তৃতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমনের পর পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যায় নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এখন পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। এর সাথে ভারত মহাসাগর তথা বঙ্গোপসাগর ও সন্নিহিত অঞ্চল কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, যোগাযোগ ও কৌশলগত গুরুত্ব ও নানা সমীকরণ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যায় বহু মাত্রিকতা যুক্ত করেছে। এটা শুধু যে মিয়ানমারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে বলে তাই নয়, বরং বৈশ্বিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বৃদ্ধি পাওয়া, রাখাইন কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও যোগাযোগের বিভিন্ন উদ্যোগ, মিয়ানমারের বুড্ডিস্ট স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির উত্থান অন্যতম কারণ।

স্মর্তব্য যে, ২০১৯ সালের মাঝামাঝি থেকে বছরব্যাপী ভারতের বিতর্কিত এক বাঙালি সাংবাদিক ভারতীয় বিভিন্ন অখ্যাত গণমাধ্যমে নামে বেনামে একের পর এক প্রতিবেদনে নানা গল্প ও কল্প কাহিনী লিখে প্রচার করেন যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী আরাকান আর্মিকে অস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা করছে। তার এ ধরনের প্রতিবেদন রচনার মূল উদ্দেশ্য ছিলো, মিয়ানমার আর্মিতে বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করা এবং তাদের দিক থেকেও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি যে সে কাজে অনেকখানি সফল হয়েছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় জেএসএসের সাথে মিয়ানমারের যোগাযোগ বৃদ্ধিতে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২০ সালে জেএসএসে একাধিক উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি মিয়ানমারে গিয়ে সেদেশের গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর অফিসিয়ালদের সাথে বৈঠক করেছে। এরপর থেকেই বান্দরবানের বিভিন্ন স্থান থেকে উপজাতীয় যুবক শ্রেণীর লোকেরা হাওয়া হয়ে গেছে এবং বেশ কয়েকমাস পর ফিরে এসেছে। বান্দরবানের মুরং সম্প্রদায় শুরু থেকে শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে বসবাস করছে। শুধু তাই নয়, বরং আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তারা লড়াই করেছে দীর্ঘদিন। সেই মুরং সম্প্রদায়কে চন্দ্রপাহাড় ইস্যুতে ইউপিডিএফ ও জেএসএসের সাথে মিলে আন্দোলন করতে দেখে অনেককেই বিস্ময় প্রকাশ করতে দেখা গেছে। মুরংদের এই মানসিক পরিবর্তনের পেছনে মিয়ানমারের হাত থাকতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কেননা, মিয়ানমারের সাথে তাদের নানা মাত্রিক মিল রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের যেকোনো উত্তেজনায় রামুস্থ ১০ পদাতিক ডিভিশন সর্বপ্রথম মুখোমুখি হবে। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামস্থ ২৪ পদাতিক ডিভিশন ব্যাক আপ ফোর্স হিসেবে যেন সহায়তায় এগিয়ে যেতে না পারে সেজন্য তাকে আটকাতে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যস্ত রাখার কৌশল হিসেবে মিয়ানমার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

চায়না-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোর

 

আমরা সকলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক গুরুত্ব জানি। শুধু বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন বলেই নয়, এশিয়ান হাইওয়ে, ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, আসিয়ান কমিউনিকেশন্স, চাইনিজ ওবিওআর প্রকল্প ও তার বিরুদ্ধে উপআঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ এ সবকিছুই বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপর দিয়ে।

অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে এনার্জি হাঙ্গার দেশ চায়না মালাক্কা প্রণালীর উপর থেকে নির্ভরতা কমাতে যে স্ট্রিং অভ পার্লস বা মুক্তার মালা নৌ সিল্ক সংযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে তারও গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সম্প্রতি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপে মার্কিন নেভির বিশ্রামের সুযোগ পাওয়ার পর চায়না মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প অনুসন্ধানে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে কারণে গোয়াদরের সিপিইসি প্রকল্পের মতো বাংলাদেশের সোনাদিয়ার ডিপ সি পোর্টের অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর মিয়ানমারের সাথে একই আদলে সিএমইসি মাল্টি মোডাল প্রজেক্ট শুরু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় মিয়ানমারের কিয়াকফু ও ইয়াঙ্গুনে দুইটি সমুদ্রবন্দর সড়ক যোগাযোগে মান্দালয়ে একত্রিত হয়ে চায়নার কুনমিং পর্যন্ত গিয়েছে। এদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী চায়নার সিএমইসি প্রকল্পের বিপরীতে ভারত মিয়ানমারের সিটুয়েতে আরেকটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে তাদের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট শুরু করেছে। কোলকাতা সমুদ্র বন্দর থেকে ৫৪০ কি.মি. দুরে কালাদান নদীর মোহনায় সিটুয়েতে এই বন্দর নির্মিত হচ্ছে। ভৌগোলিকভাবে ভারত মহাসাগরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আরাকানের অবস্থান। রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের পর আরাকানের বিশাল এলাকায় হংকংয়ের মতো শিল্প ও বাণিজ্যের কেন্দ্র বানানোর মিয়ানমারের স্বপ্নে সারথি হতে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো প্রবল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শোনা যায়, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সাথে চায়নার সুসম্পর্কের উপর ভিত্তি করে আরাকান আর্মি ভারতীয় কালাদান প্রজেক্টের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কাজেই সেই আরাকান আর্মির সাথে বাংলাদেশের যেকোনো সম্পর্কের প্রচারণা ভারত ইতিবাচকভাবে দেখবে না এটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পররাষ্ট্রনীতিতে চায়নার বিশেষ গুরুত্ব পাওয়ার সাথে মিজোরামে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নবাদীদের নতুন করে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাওয়ার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কিনা তা সতর্কতার সাথে খতিয়ে দেখা দরকার।

ভারতীয় কালাদান প্রজেক্ট

 

নব্বই দশকে স্নায়ুযুদ্ধ সমাপ্তের পর বর্তমানে নতুন করে চায়না-মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধ শুরুর পর আমেরিকা ও তার মিত্রদেশগুলো চায়না থেকে তাদের শিল্প-বিনিয়োগ ভিন্ন দেশের স্থানান্তর করছে। স্থানান্তরিত এসব শিল্প কারখানার একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য বাংলাদেশ। এছাড়াও সম্প্রতি বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল ও দ্বীপগুলো বিশেষ করে মহেশখালী, মাতারবাড়ি, সোনাদিয়া, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে যে বিপুল বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলছে তার ব্যাক স্টেপও এই পার্বত্য চট্টগ্রাম। এদিকে রোহিঙ্গা সমস্যাকে কেন্দ্র করে পার্বত্য চট্টগ্রাম সন্নিহিত কক্সবাজারে বিপুল পরিমাণ বিদেশি সংস্থার অবস্থান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসা নামক জঙ্গী সংগঠনের সক্রিয় উপস্থিতি পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়, গভীর বন আরসা বা যে কোনো জঙ্গী ও সন্ত্রাসীদের জন্য লোভনীয় আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে। আবার চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের সাতবোন রাজ্যের সাথে ট্রানজিট যোগাযোগ, তিনটি স্থল বন্দরের কার্যক্রম চালু হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে।

সবকিছু মিলে পার্বত্য চট্টগ্রাম অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, যোগাযোগ ও কৌশলগত নতুন ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চলেছে। সেকারণে স্থানীয় উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার ইঙ্গিতের সাথে উপরোক্ত ভূ-রাজনীতির দাবা খেলার কোনো সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা জরুরি। একই প্রেক্ষাপটে পার্বত্য চট্টগ্রামের নতুন চ্যালেঞ্জ ও ইনসার্জেন্সি মোকাবেলায় বিদ্যমান কৌশলগুলোকেও বর্তমান ভূ-রাজনীতির নিরিখে পুনর্মূল্যায়ন করে যুগোপযোগী কৌশল প্রণয়ন সময়ের দাবি।email:[email protected]

Print Friendly, PDF & Email
ঘটনাপ্রবাহ: জেএসএস, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মিয়ানমার
Facebook Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও পড়ুন